যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
শবনের বুক চিরে রেলগাড়ি দেখতে অপু-দুর্গার ছুট!
দৌড়ের রোমান্টিসিজম হিসেবে এই কোলাজ বাঙালির মনের গভীরে সযত্নে রাখা। কিন্তু দৌড়ের মাধ্যমে প্রতিবাদ? দৌড়ের গতিতে শোকের ভার ভুলতে চাওয়ার আর্তি? দৌড়ের এমন ব্যঞ্জনা বাঙালির কাছে এখনও বেশ অচেনা। সেই অচেনা কাজটিই সেরেছেন কলকাতার ভূমিকন্যা সোহিনী চট্টোপাধ্যায়। পেশায় সাংবাদিক সোহিনী একজন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্র সমালোচক।
এই দৌড়ের শুরুটা খুব আনন্দের ছিল না। ছোটবেলায় পার্ক স্ট্রিটের পার্ক ম্যানসনে ঠাকুরমা-ঠাকুরদার সঙ্গে থেকে বড় হওয়া সোহিনীকে ঘুরতে হয়েছে নানা প্রদেশ। বাবার চাকরির সূত্রে গোটা ভারতের নানা বড় শহরে বাস করতে করতে দেশকে দেখেছেন বিভিন্ন আয়নায়। বেঙ্গালুরুতে নতুন চাকরির শুরুতেই এল দুঃসংবাদ। ছেলেবেলার নরম দিনের সঙ্গী ঠাকুরমা আর নেই। নতুন চাকরি, বললেই ছুটি মেলে না। অগত্যা বুকের মধ্যে রয়ে গেল শোক। সেই শোকের ভার এত গাঢ় হল যে তাকে ঝেড়ে ফেলতে বেশ বেগ পেতে হল সোহিনীকে। শোকমুক্তির পথ হিসেবেই তিনি আঁকড়ে ধরলেন দৌড়কে।
কিন্তু এত কিছু চারপাশে থাকতে দৌড় কেন? প্রশ্নটা শুনে ফোনের ওপারে সোহিনীর গলায় যেন সেই দৌড় শুরুর দিনগুলোর স্মৃতি। আমি মনে করেছিলাম ওই গভীর শোক থেকে আমাকে টেনে বের করে আনার জন্য সেই সময় একটা দ্রুত ধাবমান, গতিশীল মাধ্যম চেয়েছিলাম। তাই দৌড়কেই বেছে নিলাম। তাছাড়া দৌড় এমন এক কাজ, যা শুরু করার জন্য আলাদা করে কোনও প্রস্তুতির দরকার পড়ে না। একটা ঠিকঠাক জুতো হলেই চলে যায়। আলাদা পোশাকও লাগে না। ধীরে ধীরে শোক ও বিষাদের ভার থেকে বেরিয়ে এলাম।
দিল্লির বসন্তকুঞ্জে নিজের কলোনির পাশের পার্কে ভোর বা সন্ধেয় দৌড় শুরু করলেন সোহিনী। এই দৌড়ের মাধ্যমেই সোহিনী সচেতনভাবে লক্ষ করলেন চারপাশের নানা খুঁটিনাটি। তাঁর খেয়াল হল দিল্লিতে তিনি ছাড়া আর কোনও মেয়ে তো দৌড়ায় না! মেয়েরা হাঁটে। ছেলেরা দৌড়ায়। সমাজ যেন মেয়েদের জন্য বেঁধে দিয়েছে নানা নিয়ম। বিধিনিষেধ। এই সময় বেরনো, এই সময় ঢোকা, কোথায় কার সঙ্গে কথা বলবে, কতটুকু বলবে, কতটুকু হাসবে, কত জোরে কথা বলবে সব যেন মেয়েদের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া। সোহিনী অনুভব করলেন মেয়েদের এই কুণ্ঠা থেকে বেরনোর প্রয়োজনীয়তা। বুঝলেন রাস্তায় নামার মধ্যে দিয়েই মেয়েরা নিজের অধিকার বুঝে নিতে সক্ষম হবে।
একসময় সোহিনী বিদেশে যান উচ্চশিক্ষার জন্য। তখনই দিল্লিতে ঘটে গেল নির্ভয়াকাণ্ড। ২৩ বছরের প্যারামেডিক্যাল ছাত্রীর মৃত্যু হল নারকীয় গণধর্ষণে। সারা দেশ উত্তাল। প্রতিবাদে ফেটে পড়ার মধ্যেও কোথাও যেন মেয়েটির দিকেই আঙুল তুলছে দেশের একাংশ। তাঁর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করলেও কোথাও যেন গুঞ্জন উঠছে ওত রাতে মেয়েটির ওখানে যাওয়ার কী দরকার? কেন গেল, কার সঙ্গে গেল ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের ঘূর্ণিপাকে সোহিনী কোথাও বুঝলেন, একটি মেয়ের দৌড়ও এই সমাজ ভালো চোখে দেখে না। সকলের চোখেই তা যেন এক তাজ্জব ঘটনা! তখনই মনে মনে ঠিক করলেন আর পার্কে নয়, এবার সটান রাস্তায় নামতে হবে। পথে নেমেই চিনতে হবে পথ। তাঁর কথায়, ওই সময় ২৩ বছরের ওই প্যারামেডিক্যাল ছাত্রীর জন্য যেখানে যেখানে প্রতিবাদ হয়েছে, মিছিল হয়েছে সর্বত্র রাস্তায় নেমে হেঁটেছি। আমার এই দৌড়ের অভ্যেস ছিল বলেই আমি বেশ বুঝতাম মেয়েদের পদে পদে যেন লক্ষ্মণরেখা!এই ঘেরাটোপের উত্তর একমাত্র স্পোর্টসের মাধ্যমেই
দেওয়া সম্ভব।
সেই শুরু মেয়েদের স্পোর্টসের ইতিহাসকে দুই মলাটে ধরা। দেশের খেলোয়াড় মেয়েদের সংগ্রাম ও নানা মাইলস্টোন পেরনোর গল্পের মধ্যে দিয়েই সোহিনী ধরেছেন ভারতের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক চিত্রকে। ভারতের মেয়েদের ইতিহাসও সেখানে মিলেমিশে গেল। সোহিনী বইয়ের নাম দিলেন ‘দ্য ডে আই বিকেম আ রানার’। ১০টি অধ্যায়ে ধরা রয়েছে মেরি ডি’সুজা, কমলজিৎ সান্ধু, পি টি ঊষা, শান্তি সৌন্দরাজন, পিঙ্কি প্রামাণিক, দ্যুতি চাঁদ, ললিতা বাবর ও ইলা মিত্রদের বেড়ে ওঠা, খেলার জন্য সংগ্রাম ও সাফল্যের খতিয়ান। আর একটি অধ্যায়ে সোহিনী লিখেছেন নিজের এই বই লেখার নেপথ্যকাহিনি। খেলোয়াড়দের পথ বড় সহজ পথ নয়। আর সেই কঠিন পথেই মেয়েদের জয়ধ্বজা যাঁরা উড়িয়েছেন, তাঁদের পথের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা বাধা, বিপদ, রোমাঞ্চ, সংকীর্ণতা, যাপনের বিপন্নতা ও জয়ের উদ্ভাসকে নিজের কলমে ধরেছেন সোহিনী।
বইয়ের ভাবনার প্রসঙ্গে বললেন, ‘আসলে যে কোনও খেলার বই একরকম জাতীয়তাবাদ ও রাজনীতির বই হয়ে যায়। কারণ খেলা কখনও দুই দেশের কূটনীতি ও রাজনীতির বাইরে নয়। আমি চাইনি এই বই আর পাঁচটা খেলার বই হয়ে বেঁচে থাকুক। বরং আমি চেয়েছি এই বই ‘নাগরিকত্বের’ নতুন পরিচয় দিক। মেয়েদের প্রথম শ্রেণির নাগরিকের সম্মান দেওয়ার অন্যতম দলিল হয়ে থাকুক।’
সোহিনী চেয়েছেন যে ভারত শুধুই পুরুষের কাজ ও কীর্তি দেখে ইতিহাস বানিয়েছে, সেই দেশ সাধারণ খেটে খাওয়া মেয়েদের কাজ দিয়েও তার আর্থ সামাজিক, সামাজিক ইতিহাসকে চিনুক। তাই তাঁর বইয়ে উঠে আসে ঊনিশ শতকের শেষ ভাগের কথা। যখন ধীরে ধীরে নানা দেশ স্বাধীন হচ্ছে। একটু একটু করে আবিশ্বের খেলার দুনিয়া বদলে যাচ্ছে। সংঘবদ্ধভাবে হচ্ছে নানা সমিতি। ১৮৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড খেলল প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ। ১৮৯৬ সালে তৈরি হল মডার্ন ওলিম্পিক। ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠা হল ফিফা। ১৯১৩-য় তৈরি হল ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন। জাতীয়তাবাদকে ঝালিয়ে নেওয়ার মঞ্চ হয়ে উঠল স্পোর্টস। এমন সময়ে দাঁড়িয়েও মেয়েরা কিন্তু সেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক! সোহিনীকে ভাবিয়েছিল মার্কিন মুলুক ও ইংল্যান্ডের ব্যবস্থা। মেয়েদের অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘মার্কিন দেশ ও ব্রিটেনে তো মেয়েদের ভোটাধিকার দেওয়ার চলও ছিল না। সেই অধিকার তাঁরা পান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। যুদ্ধ চলাকালীন দেশকে শ্রম দেওয়ার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করার পুরস্কার হিসেবে। বিনিময় প্রথায়! একসময় মেয়েদের ভোটদান নিয়ে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, মেয়েরা ভোটের অধিকার পেলেই যে তারা বাইরের সব কাজ পুরুষদের সঙ্গে করবে এমন নয়, তবে তারা ভোটাধিকার পেলে সুনাগরিক হবে, ভালো স্ত্রী হবে, ভালো মা হয়ে উঠতে পরবে। অর্থাৎ মেয়েরা কোথাও যেন সেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, ভালো স্ত্রী, ভালো মা হয়ে ওঠাই যাদের লক্ষ্য। যাদের ভোট দেওয়ার অধিকারও দুনিয়ার ইতিহাসে লড়াই করে নিতে হয়। একদম এই সাধারণ মেয়েদের দিয়েই দেশের ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করেছি আমি। উঠে এসেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে তৈরি খেলার দুনিয়ার নানা ঘটনাক্রম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে মেয়েদের সাফল্যের গল্প।’
খেলোয়াড়রা শুধু খেলাতেই মন দেননি। যুগের হাওয়ায় তাঁরা কেউ হয়তো জড়িয়ে পড়েছেন ত্রাণ আয়োজন, বিপ্লব বা দিনবদলের দলে। পাশাপাশি চলেছে খেলার চর্চা। সেই প্রসঙ্গে বলা যায় ইলা মিত্রের কথা। ১৯৪০ ও ১৯৪৪-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ওলিম্পিক হয়নি। হলে সেখানে ইলা মিত্র নির্বার্চিত হতেন ভারতের প্রথম মহিলা অ্যাথলিট হিসেবে। তেভাগা আন্দোলনের এই নেত্রীর জীবন, রাজনীতি, মাত্র ১৮ বছর বয়সে রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ পাওয়া ইত্যাদি যাপনের সঙ্গে তাঁর খেলাধুলার অনুশীলনও ধরা হয়েছে একটি অধ্যায়ে। তেমনই গরিব ঘর থেকে উঠে আসা, শুধু সরকারি চাকরিকে লক্ষ্যবস্তু করে অ্যাথলেটিক্স অভ্যাস করা দ্যুতি চাঁদ কীভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন, তাঁর দিদি
সরস্বতী চাঁদ কীভাবে দ্যুতির অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন রয়েছে সেইসব ঘটনার কথাও। পিঙ্কি প্রামাণিকের জীবনসংগ্রাম ও মামলা লড়ে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার দুস্তর লড়াইয়ের সঙ্গে ধ্বনিত হয়েছে মেয়েদেরই জয়যাত্রার গান। ললিতা বাবরের ম্যারাথনার হয়ে ওঠার গল্পও যেমন সেই গানের শব্দে যোগ করেছে দিনবদলের সুর। সোহিনীর এই পরিকল্পনায় পাশে ছিল নিউ ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন। বইয়ের কাজ এগতে বিশেষ গ্রান্টের ব্যবস্থা করে এই সংস্থা। সেই ফেলোশিপ এই বই তৈরির নেপথ্যে বেশ কিছুটা ভূমিকা নেয়।
ভারতের মহিলা দৌড়বিদদের জীবনকথার প্রাঙ্গনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সোহিনী যেন আয়না ধরেছে নানা মহিলা স্প্রিন্টার, ম্যারাথনার, রানারের জীবনে। আর তাঁর জীবনের নানা ঘটনা ও ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে সোহিনী মিশিয়েছেন সেই সময়ের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতির কথা।
দৌড়ের ট্র্যাকে মেয়েদের যত অশ্রু রক্ত ঘাম ঝরেছে, সোহিনীর কলমের কালি যেন ততই সেসব ক্লেদের বাগানে ফুটিয়েছে সংগ্রামের, নৈতিক জয়ের গোলাপচারা। সাংবাদিক সোহিনী তাঁর পেশাদার চোখ ও শানিত বুদ্ধি নিয়ে দৌড়বিদদের জীবনমহলে উঁকি দিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য ভারতের বুকে উঠে আসা দামাল কিশোরীরা। যারা একদিন ম্যারাথনের পথঘাট বা দৌড়ের ট্র্যাকে রেখে আসবে পায়ের দাপটে। আর মনের দাপটে লিখে ফেলবে সমানাধিকারের ম্যানিফেস্টো। ভারতের ভাগ্যবিধাতা কি সেদিন একটু মুচকি হাসবেন?