যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
‘মা কালী গো আমায় ছেড়ে কোথায় গেলে?’— কলকাতার উপকণ্ঠে কাশীপুর গ্রাম। সেখানে এক বাগানবাড়ি যার এক পাশে প্রবাহিত মা গঙ্গা। সেই সুরধুনী সংলগ্ন কাশীপুর শ্মশান বিখ্যাত হয়ে উঠবে যে ব্যক্তির ভগবতী তনুকে অগ্নিদগ্ধ করে, সেই মানুষটির সহধর্মিণীর মুখে এ কী আর্তনাদ! স্বামী কখনও মা কালী হতে পারে? তিনি কালীসাধক, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরকে মাতৃসাধনায় পুত পবিত্র করে তুলেছিলেন। সেখানেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন জগদম্বার বালক। তিনিই রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দেবালয়ের আরাধ্যা দেবী ভবতারিণীকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁর পাশেই তাঁর স্ত্রী সারদা যে অপূর্ব কালীসাধিকা রূপে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিলেন তাঁর খবর আমাদের অনেকেরই অজানা। বাংলায় নারীর কালীসাধনার বৈচিত্র্য প্রসঙ্গে আমরা আলোচনা করব। বিশেষত, কালীসাধক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্ত ও অনুরাগী পরিমণ্ডলের সঙ্গে যেসমস্ত নারী যুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের জীবনে কালীসাধনাকে তুলে ধরব এই অবসরে।
শ্রীমা সারদার জীবনে কালীসাধনা বা শক্তিসাধনার প্রকাশ বৈচিত্র্যে পূর্ণ। কতভাবে তিনি দেবী আরাধনা করেছিলেন এবং কতভাবে তিনি দেবী রূপে আরাধিত হয়েছিলেন দু’টির তালিকাই অসংখ্য। শ্রীরামকৃষ্ণ সারদার কথা বলতে গিয়ে বলছেন, ‘ও আমার শক্তি’। আবার অন্যত্র কটুভাষী ভাগনে হৃদয়কে বলছেন, ‘দ্যাখ হৃদু, আমাকে যা খুশি বলিস, কিন্তু ওকে (সারদা) কিছু বলিস না। ওর ভিতর যে আছে সে ক্রুদ্ধ হলে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর রক্ষা করতে পারবেন না।’ আর সারদা? তিনি তো নিজেই ষোড়শী রূপে স্বামীর পূজা গ্রহণ করেছেন। আবার দেবী ভবতারিণীকে এক ফলহারিণী কালিকাপূজার দিনে রঙ্গনফুল দিয়ে অসাধারণ মালা গেঁথে নিবেদনও করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নিশ্চয়ই জানতেন, তাই মন্দিরে গিয়ে সেই মালা ধারণ করে দেবীরূপ জ্বলজ্বল করছে দেখে আনন্দিত হয়ে শ্রীমাকে ডেকে পাঠান তিনি। বলেন, ‘মায়ের কি রূপ খুলেছে দেখে যাক’।
আর শ্রীমায়ের জীবনে কালীভাবনা? খুব বেশি করে তা বাঙময় হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ঘটনায়। একবার কালীঘাটে কালীমন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছেন শ্রীমা। পুজো দেওয়া শেষে নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের প্রসাদি সিঁদুর মাথায় পরিয়ে দিতে দিতে এগিয়ে আসছেন, হঠাৎ একটি মেয়ের কপালে সিঁদুর স্পর্শ করতেই মেয়েটি চমকে ঊঠল। শ্রীমা ভাবলেন মেয়েটি কোনভাবে আঘাত পেয়েছেন। তিনি, ‘আহা তোমার লাগল’ বলে মেয়েটির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন তাঁর কপালে তৃতীয় চক্ষু জ্বলজ্বল করছে, আর এই সেই তৃতীয় নয়নে তিনি সিঁদুর দিয়েছেন। দেবীর আসল রূপটি দেখতে পেয়েই সারদাদেবী বলে উঠলেন, ‘আহা মা, কী রূপ না দেখালে!’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আবেগে তাঁর চোখদু’টি মুদে এল। চোখ খুলে তিনি আর সেই মেয়েটিকে দেখতে পেলেন না।
শ্রীমা সারদাদেবীর জীবনে বিভিন্ন রূপে দেবী এসেছেন। যখন তিনি কিশোরী, সেই দিনগুলির স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, ছোট থেকেই তাঁর সঙ্গে তাঁরই মতো দেখতে একটি মেয়ে সর্বক্ষণ ঘোরাঘুরি করত। তিনি ঘাস কাটতে পুকুরে নামলে সেই মেয়েটিও আরেক আঁটি ঘাস কেটে এনে দিত। কত গল্প, কত কথা! কিন্তু তৃতীয় কেউ এলে আর তাকে দেখতে পাওয়া যেত না। এই অদ্ভুত মেয়েটি কে? এই নিয়ে কোনওদিন প্রশ্ন তোলেননি সারদামণি। শুধু কি তাই? তিনি যখন প্রথমবার দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে আসছেন তখন পথের মধ্যেই প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন। পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বিপদে পড়ে এক চটিতে আশ্রয় নেন। রাতে সারদা দেখলেন এক কালো মেয়ে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এমন কালো মেয়ে তিনি নাকি আগে কখনও দেখেননি। মেয়েটিকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোথা থেকে আসছ?’ মেয়েটি উত্তর দিলেন, ‘দক্ষিণেশ্বর থেকে’! দক্ষিণেশ্বর শব্দটি কানে যেতেই আক্ষেপে বলে ঊঠলেন সারদা, ‘ আমি ভেবেছিলুম দক্ষিণেশ্বর যাব, তাঁর সেবা করব। কিন্তু এবার বোধহয় হল না।’ এই কথা শোনামাত্র সেই কালো মেয়ে বললেন, ‘সে কী, সেখানে যাবে বইকি! আমি যে সেখানে তোমার জন্য তাঁকে বেঁধে রেখেছি’। এই কথা শুনে বিস্মিত সারদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আমাদের কে হও গা?’ কালো মেয়েটি বলল, ‘আমি তোমার বোন’। দক্ষিণেশ্বরের দেবী ভবতারিণী সেই মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণকে বেঁধে রেখেছেন। কেন? সারদার জন্য। কারণ তিনি সারদার বোন হন।
শেষে একটি স্মৃতিচারণের উল্লেখ করতেই হবে। জয়রামবাটি থেকে কামারপুকুর চলেছেন সারদা। পিতৃগৃহ থেকে শ্বশুরালয়। তিনি পালকিতে বসে, পালকির পাশে চলেছেন ভাশুর রামেশ্বরের পুত্র শিবরাম। চট্টোপাধ্যায় পরিবারে তিনিই একটু বেশি তাঁর খুড়িমাকে পছন্দ করেন। গ্রামের পথ ছেড়ে ধানক্ষেত ডিঙিয়ে পালকি যখন প্রায় কামারপুকুর পৌঁছে গিয়েছে তখন শিবরাম পালকি নামিয়ে খুড়িমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজ বলতে হবে তুমি আসলে কে?’ নিরুপায় সারদা প্রথমে বললেন, ‘কে আবার? তোর খুড়ি’। তাতে ফল হল না। শিবরাম স্পষ্ট জানালেন সঠিক উত্তর না পেলে তিনি খুড়িমাকে সেখানেই ফেলে গ্রামের দিকে পা বাড়াবেন। বিপাকে পড়ে সারদা ধীর স্বরে উত্তর দিলেন, ‘লোকে বলে কালী’।
শ্রীরামকৃষ্ণ, ভবতারিণী এবং সারদা— এদের মধ্যে সম্পর্ক কী? সারদার কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ মা কালী। মা ভবতারিণীর কাছে সারদা তাঁর বোন। আর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে এই দুই নারী, চিন্ময়ী ও মৃণ্ময়ীর সম্পর্কে কেমন? এর উত্তর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই দিয়েছেন। তখন শ্রীরামকৃষ্ণর মা চন্দ্রাদেবী নহবতে বাস করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাদেবী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘যে মা মন্দিরে আছেন, যে মা নহবতে আছেন, আর তুমি— সকলকেই আমি আনন্দময়ী জননী বলে মনে করি।’ ভবতারিণী, চন্দ্রাদেবী আর সারদা, তিনে এক একে তিন। এক কালী তাঁর তিন রূপ। সারদা নিজ স্বরূপে কালী হয়েও তিনি স্বামী শ্রীরামকৃষ্ণকে কালী রূপে আরাধনা করেছেন, সেবা করেছেন। অধ্যাত্ম সাধনার ইতিহাসে এ এক অতি বিরল ঘটনা।
রানি ও ভবতারিণী
শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনকে আবর্তিত করে যেসব নারী নিজেদের মহিমাময় সাধন জীবন প্রকাশ করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রথম রানি রাসমণির নাম উল্লেখ করতে পারি। বৈষ্ণব পরিবারে লালিত হওয়া রানি রাসমণির জীবনে দেবী কালীকে নিয়ে যে লীলা কাহিনি গড়ে উঠেছিল তা একটি কল্পকাহিনির থেকে কম কিছু নয়। কাশী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন কিন্তু দৈবাদেশে তিনি দেবালয় প্রতিষ্ঠা করলেন। যতদিন দেবীমূর্তি স্থাপনা সম্পূর্ণ না হয়েছে ততদিন তিনি রানি হয়েও হবিষ্যান্ন গ্রহণ ও মাটিতে শয়ন করেছেন। মূর্তি গঠিত হয়েছে কিন্তু দেবালয় সম্পূর্ণ নয়, দেবী আবার তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন, ‘কতদিন আমাকে বাক্সবন্দি রাখবি?’ সত্বর প্যাঁটরা খুলে রানি দেখেন বাক্সবন্দি দেবী মূর্তি ঘেমে উঠেছেন। তাই দ্রুত বৈষ্ণবদের পালিত তিথি স্নানযাত্রাতেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছেন রানি রাসমণি। তারপর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর কাছে দেবী ভবতারিণীই ছিলেন আরাধ্যা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রানি তাঁর জমিদারীর কাগজপত্রে সই করতেন, ‘কালীপদ অভিলাষী শ্রীরাসমণি দাসী’ হিসেবে। রানি কেবল দেবীভক্ত ছিলেন না , তিনি বাংলায় এমন এক কালীমন্দির তৈরি করেছিলেন যে মন্দিরের মধ্যে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব ভাবধারা সম্মিলিত হতে পেরেছিল। কেবল তাই নয়, তিনি এই কালীবাড়ি ও তার সংলগ্ন উদ্যানকে তত্কালের সাধু সন্ন্যাসীদের আখড়া, পরস্পর সম্মিলিত হওয়ার স্থান করে তুলেছিলেন। ভারতের স্বদেশি আন্দোলনের বিপ্লবীরাও তাঁদের ক্ষাত্রবীর্য উন্মোচনের জন্য মহাশক্তির আরাধনার সূচনা করেছিলেন এই দেবালয়ের আরাধ্যাদেবী ভবতারিণীকে
সামনে রেখে।
যোগেশ্বরীর যোগ ঐশ্বর্য
‘বাবা তুমি এখানে? আমি তোমায় গঙ্গাতীরে খুঁজে বেড়াচ্ছি!’ বকুলতলার ঘাটে নৌকা থেকে নামতে এই আলুলায়িত কেশী ব্রাহ্মণীকে দেখেছিলেন গদাধর চট্টাপাধ্যায়। দেখামাত্রই ভাগনে হৃদুকে বলেছিলেন তাঁকে ডেকে আনতে। এঁর কথাই ভবতারিণী জানিয়েছেন আজ। আর সেই ব্রাহ্মণীও জগদম্বার আদেশ পেয়েছেন। দেবী তাঁকে আদেশ করেছেন গদাধরের সাধনে সহায়তা করতে। তাই উপস্থিত হয়েছেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী যোগেশ্বরী। পূর্ববঙ্গের যশোর জেলায় কোনও তন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই ভৈরবী যোগেশ্বরী। আনুমানিক ১৮২২ সালে তাঁর জন্ম হয়। তিনি তন্ত্রসিদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি। কেবল চৌষট্টিটি তন্ত্রশাস্ত্রে ও তন্ত্রতত্ত্বে পারদর্শিনী ছিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্র সাধনার গুরু ছিলেন তিনি। কেবল তাই নয়, যখন যোগেশ্বরী দক্ষিণেশ্বরের আগমন করেন তখন শ্রীরামকৃষ্ণ অঙ্গে দুরারোগ্য ব্যধি। সর্বাঙ্গে তাঁর দহন ও তীব্র জ্বলন। গঙ্গার জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকেন তিনি। রানির জামাই মথুরবাবু অনেক কবিরাজ বৈদ্য দেখিয়েছেন কিন্তু কেউ সুস্থ করতে সফল হননি। যোগেশ্বরী রোগের লক্ষণ শুনে বলেছেন, এ কোনও দেহজ রোগ নয়! এ হল মহাভাবের প্রকাশ! উনিশরকম ভাবের সমষ্টিতে এই মহাভাবের সৃষ্টি। মহাভাব জনিত জ্বলন রাধারানি ও শ্রীচৈতন্য জীবনেও পরিলক্ষিত হয়। ভৈরবী গাত্রজ্বালা উপশমের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ অঙ্গে চন্দনের লেপ দিতে শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হলেন রামকৃষ্ণ। কিন্তু মথুরবাবু তবুও ভৈরবী উক্ত ছোট ভট্চাজ গদাধর চট্টোপাধ্যায়ে অবতার হওয়ার তত্ত্বকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। মূলত তিনি ভৈরবী ব্রাহ্মণী সম্বন্ধেও সন্দিহান হয়ে উঠলেন। একে পরমাসুন্দরী, তায় একাকী ভ্রমণ করেছেন তীর্থে তীর্থে! এই নারীর অতীত কী? বিশেষত সরল সহজভাবে ভোলা ছোট ভট্চাজের রক্ষার জন্যও ভীত হন তিনি। একদিন দেবীমন্দিরে বসে আছেন মথুরবাবু, পাশ দিয়ে ভৈরবীকে যেতে দেখে ব্যঙ্গ করে বলে ওঠেন, ‘কিগো ভৈরবী, তোমার ভৈরব কোথায়?’ যোগেশ্বরী স্থির নেত্রে মথুরবাবু দিকে তাকিয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন কালীপদে পড়ে থাকা শিবের মূর্তির দিকে। শান্ত স্বরে জানালেন, ‘ওই আমার ভৈরব।’ মথুরবাবু ভৈরবীর এই উত্তরেও নিবৃত্ত হলেন না , তিনি আবার সরব হলেন , ‘ওটি তো অচল, সচল ভৈরবের কথা বলছিলাম।’ এবার ভৈরবীর মোক্ষম উত্তর, ‘অচল শিবকে যদি সচলই না করতে পারব তবে ভৈরবী হয়েছি কেন?’ ভৈরবীর গম্ভীর স্বরে নীরব হয়ে যান মথুরবাবু।
ভৈরবী ব্রাহ্মণী ছিলেন যোগ বিভূতি সম্পন্ন এক উঁচুদরের সন্ন্যাসিনী। তিনি কেবল আহূত পণ্ডিতদের সম্মুখে শ্রীরামকৃষ্ণের অবতার তত্ত্বকে প্রমাণ করেননি। তিনি তন্ত্রের দুরূহ সাধনাগুলি সম্পন্ন করিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণকে দিয়ে। বিভিন্ন পর্যায়ের তন্ত্রোক্ত অনুষ্ঠানগুলি ভৈরবী পালন করিয়ে ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণকে দিয়ে। যোগিনী তন্ত্রে সিদ্ধাসনের জন্য নর, মহিষ, মার্জার, শিবা, সর্প, সারমেয় ও বৃষভ — এই পাঁচটির মুণ্ড দিয়ে আসন তৈরির কথা বলা হয়েছে। যোগেশ্বরী সেই সব জোগাড় করে আসন তৈরি করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজ ভক্তদের দুটি মুণ্ডাসনের কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে বেলগাছের নীচে তিনটি নরমুণ্ড প্রোথিত ছিল এবং পঞ্চবটীর তলায় পঞ্চপ্রকার জীবের পাঁচটি মুণ্ড প্রোথিত ছিল। সাধনায় সিদ্ধ হওয়ার পর সেই আসন শ্রীরামকৃষ্ণ ভেঙে ফেলেন এবং মুণ্ডগুলি গঙ্গায় বিসর্জিত হয়। কেবল আসন নয় নির্জন বনাঞ্চলে সকলের অলক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণকে শবসাধনার মতো কঠিন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়েছিলেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী। এইভাবে ভৈরবী তন্ত্রোক্ত পথে শ্রীরামকৃষ্ণকে সিদ্ধিলাভ করিয়েছিলেন। এক নারী হয়ে সাধন জ্ঞানের যে সমৃদ্ধি ভৈরবী দেখিয়েছিলেন তা বিস্মিত করে।
কেবল এই তিন নারী নন, কালী সাধনা বা শক্তিসাধনায় শ্রীরামকৃষ্ণ নারীভক্তদের মধ্যে আর একজনের নাম উল্লেখ করতে পারা যায় । তিনি হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত শিবপুর নিবাসী নবগোপাল ঘোষের স্ত্রী নিস্তারিণী দেবী। তিনি নাকি মা ছিন্নমস্তার ভাবে ভাবিত ছিলেন। যখন শেষ বয়সে অসুস্থ হন তখন কারও স্পর্শ সহ্য করতে পারতেন না আর ছিন্নমস্তার ভাবে নিজের মাথাটি ধরে থাকতেন। সর্বশেষে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম সন্ন্যাসিনী ভক্ত গৌরী মার কথা বলতেই হয়। যাঁকে বলা হতো ‘কালীঘাটের মেয়ে’ কারণ তাঁর জন্ম কালীঘাট অঞ্চলে। গৌরী মায়ের গর্ভধারিণী রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন দেবী ভক্ত! শ্রীমায়ের মধ্যে তিনি দেবী দুর্গাকে দেখেছিলেন।
সাধন জীবন এক নদীর প্রবাহের মতো। কত তরঙ্গ এসে মিলিত হয়, সংযুক্ত হয় তারপর এক রেখায় বয়ে চলে। যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে যে সাধিকাদের জীবন আবর্তিত হয়েছিল তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন অসাধারণ জীবনের অধিকারিণী। তাঁদের জীবন নীরব কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বে বাঙ্ময়।