যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
প্রথম অধ্যায়ে জীবন যা যা কাজ দিয়েছিল, সবই প্রায় করে ফেলেছেন তাঁরা। গোছানো সংসার। সন্তানদের বড় করা। প্রিয় মুখগুলোর সুখের খোঁজে চুলে পাক ধরেছে। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরেছে অনেকখানি। তবু যেন নিজের জন্য বাঁচা হয়নি। নিজেকে ভালোবাসতে ভুলেছেন কবেই! কেউ ৪০ পেরিয়েছেন সদ্য। কেউ বা ৭০-এর দরজায় দাঁড়িয়ে। কারও স্বামী চলে গিয়েছেন মাত্র কয়েক মাস। কারও সন্তান বিদেশের ঠিকানায় স্থায়ী বসত গড়েছে। আর তাঁদের শরীর, মন জুড়ে নেমেছে একাকিত্বের বিকেল। মনমরা আলোয় কোনও উত্তাপ নেই। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙলে মন প্রশ্ন করে, কার জন্য বাঁচব? তাই নতুন করে বাঁচার হদিশ খুঁজে নিয়েছেন তাঁরা ‘প্রবাহিনী’-র দরবারে। যার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন নৃত্যশিল্পী মধুবনী চট্টোপাধ্যায়। যিনি প্রাথমিকভাবে নাচ ও অন্যান্য সৃজনশীল ভাবনা থেকেই ২৩ বছর আগে শুরু করেন জাহ্নবী।
‘প্রবাহিনী’-র ভাবনার শুরু কীভাবে? মধুবনী জানালেন, ৩২ বছরের শিল্পী জীবনে কর্মসূত্রে নানা বয়সের মানুষের সঙ্গে তাঁর নিত্য যোগাযোগ। বিশেষত নাচ সংক্রান্ত ব্যাপারে ছোটদের নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু এই মাঝারি বয়সের মানুষদের নিয়ে খুব বেশি কাজ করা হয়নি। ‘প্রায়শই ফোন আসত। মধুবনী আমরা ‘জাহ্নবী’-তে যুক্ত হতে চাই। কিন্তু নাচ তো সম্ভব নয়। আর কোন সূত্রে যুক্ত করা যায়? একদিন রাত ১১টার পর একটা ফোন আসে। ভদ্রমহিলা কোনও ভূমিকা ছাড়া বললেন, ‘শোনো, তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। তুমি আমার খুব কাছের। সেই দাবি থেকে বলছি। আমি এবং আমার কয়েকজন বান্ধবী জাহ্নবীর সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। সেটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে সেই রাস্তা তৈরি করো। কারণ এই একাকিত্ব নিয়ে আমরা বাঁচতে পারছি না। প্রতিদিন সকালে উঠে মনে হয় কেন বেঁচে আছি?’ তখন আমি ভাবলাম একটা কমিউনিটি তৈরি করলে কেমন হয়? যেখানে কোনও শর্ত নেই। একটা খোলা জায়গা। যেখানে ওঁরা আসবেন, নিজেদের মতো করে সম্পর্ক তৈরি করবেন। এখন একটা এমন সময় এসছে আমি নিজেও বুঝতে পারি, পরিবারকে বাড়াতে হবে। সেখানে রক্তের সম্পর্ক নয়, বাইরের সম্পর্ক, বৃহৎ পরিবার। আমি নিজে এটাতে বিশ্বাসী। এতে আমার একাকিত্বের কোনও জায়গা নেই। কোনও ডিপ্রেশন নেই। এদের ভালো রাখাটা আমার বিরাট দায়িত্ব। সেটা যদি প্রত্যেকের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় তাহলে সকলেই তার ভাগ পাচ্ছেন’, বললেন মধুবনী।
নাচের পাশাপাশি নিয়মিত নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন মধুবনী। কখনও তা জায়গা করে নেয় সমাজমাধ্যমে। কখনও বই আকারে প্রকাশিত হয়। মধুবনী লক্ষ্য করেছেন তাঁর লেখার সঙ্গে সবথেকে বেশি কানেক্ট করতে পারেন চল্লিশোর্ধ্ব মহিলারা। তাঁর কথায়, ‘আমার লেখা অনেকে পড়েন। এই বয়সের মহিলারা বেশি পড়েন। তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি তাঁদের চিনি না। কিন্তু তাঁদের কাছে আমি একজন আত্মীয় বা কাছের মানুষ হয়ে উঠছি অজান্তেই। ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করছেন। নিজেদের যাবতীয় মানসিক সমস্যার কথা বলছেন। আসলে ওঁদের কথা বলার লোক নেই। অসম্ভব একাকিত্ব। প্রায় সকলেই অত্যন্ত ভালো পরিবার থেকে আসছেন। আর্থিকভাবে সচ্ছল। ছেলেমেয়ে মানুষ হয়ে গিয়ে বাইরে কর্মরত। অনেকের স্বামী চলে গিয়েছেন। প্রচণ্ড ডিপ্রেশন। সেটা কাটানোর জন্য প্রবাহিনীর মতো একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি।’
‘প্রবাহিনী’তে কী কী হয়? মধুবনী জানালেন, ‘জাহ্নবী’র একটা অংশ এই ‘প্রবাহিনী’। সেখানে সপ্তাহের একটা দিন বিকেলে দু’ঘণ্টার জন্য ২৫ জন মহিলা একত্রিত হন। মাসের একটা দিন মনোবিদ নীলাঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। সেদিন নিজেদের যাবতীয় মনখারাপ মনোবিদের সঙ্গে ভাগ করে নেন তাঁরা। প্রতি মাসে একটা দিন উপস্থিত থাকেন মহিলা পুরোহিত তথা অধ্যাপিকা নন্দিনী ভৌমিক। তিনি নানারকম আধ্যাত্মিকতার চর্চার মাধ্যমে সকলের মানসিক উত্তরণ ঘটান। নানাভাবে অনুপ্রেরণা দেন। মাসের একদিন কোনও এক রন্ধন বিশারদকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা রয়েছে মধুবনীর। তিনি নানা ধরনের রান্নার গল্প করবেন। পুরনো, নতুন নানা রেসিপি নিয়ে সেদিন আড্ডা জমবে। ‘আসলে এঁদের নতুন করে কিছু শেখাতে হচ্ছে না। প্রত্যেকে সব ব্যাপারে সক্ষম। এমন রান্না করে আনেন, খেলে অবাক হতে হয়। একজন আসেন হাওড়া ডুমুরজলা স্টেডিয়ামের কাছ থেকে। সকলের জন্য রান্না করে এনেছিলেন। এতদিন শুধু বর আর মেয়ের জন্য রান্না করেছেন। এখন আরও ২০ জনের জন্য করছেন। সেটার অন্য আনন্দ আছে। চোখমুখ ঝকঝক করছে। মন ভালো রাখে’, অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন শিল্পী।
শুধু বিশেষজ্ঞরা নন। মধুবনী নিজে প্রবাহিনীর সদস্যদের সময় দেন। কীভাবে? ‘একদিন বললাম চলো সবাই বসে কোলাজ করি। প্রচুর কাগজ, রং আনা হল। অর্ধেকজন কোলাজ করেননি কখনও। জানেন না। হেঁশেল ঠেলেছেন আজীবন। এখনও যৌথ পরিবারে রয়েছেন। ‘প্রবাহিনী’তে আসবেন বলে সকাল থেকে সব কাজ সেরে রেখেছেন। তাঁদের করা কোলাজ দেখে মনে হল এতো সব লুকনো ট্যালেন্ট! যেগুলো কোনওভাবে প্রকাশ হয় না। সেটা বিরাট খারাপ লাগার জায়গা। কোনওদিন আবার আমরা একসঙ্গে গোল হয়ে বসে সেলাই করি। আগেকার দিনে ঠাকুরমা, দিদিমারা যেমন করতেন। সেটা করতে করতে প্রত্যেকে তাঁদের সেই সপ্তাহের একটা ভালোলাগা, একটা খারাপ লাগার কথা বলছেন। আমাদের এখানে যা গল্প হচ্ছে সেটা বাইরে বেরবে না। একে অপরের প্রতি সেই বিশ্বাস রয়েছে। এখানে নতুন করে বন্ধু তৈরি হচ্ছে। একজনের সমস্য হলে আরও পাঁচজন তার পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন।’
প্রবাহিনীর সদস্যদের করা নানা সেলাই বা কোলাজ ভবিষ্যতে বিক্রির কথা ভেবেছেন মধুবনী। তাঁর পরিকল্পনা, ‘আমি নিজে খুব সেলাই করতে ভালোবাসি। এঁরা প্রত্যেকে সুন্দর সেলাই করেন। আমি আমতায় রামকৃষ্ণ প্রেমবিহার আশ্রমে যাই। সেখানে মহারাজের অধীনে অনেক দুঃস্থ মেয়েরা কাজ করে। তাদের দিয়ে হ্যান্ড এমব্রয়ডারি করিয়ে মার্কেটিং করব ভেবেছিলাম একসময়। উপার্জিত অর্থ শুধু জিনিসের দাম বাদ দিয়ে পুরোটাই ওরা পাবে। ব্র্যান্ডের নাম ভেবেছিলাম আমার প্রপিতামহীর নামে ‘হেমনলিনী’। উনি অসাধারণ সেলাই করতেন। এখনও সেই পরিকল্পনা মাথায় আছে। ভাবছি এর সঙ্গে প্রবাহিনীর সদস্যদেরও যুক্ত করব। সেলাই করা একটা থেরাপি। আমি বড় কোনও কাজের আগে বসে সেলাই করি। মনঃসংযোগ বাড়ে। রঙিন সুতো মন ভালো করে।’
শুধু যে গৃহবধূরা প্রবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এমন নয়। কর্মরতারাও এখানে খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব আকাশ। মধুবনীর উপলব্ধি, ‘কর্মরতারা বাইরে নানা সমস্যার সঙ্গে যুঝছেন। এখানে এসে সেগুলো বলে হালকা হতে পারেন।’ কয়েক মাসেই প্রবাহিনীর সদস্যদের অনেকটা বদলে যেতে দেখেছেন মধুবনী। কেমন সেই বদল? স্পষ্ট বললেন, ‘২-৩ জনের স্বামী মারা গিয়েছেন সম্প্রতি। চূড়ান্ত ডিপ্রেশন। প্রথম প্রথম এসে শুধু কাঁদতেন। বিবর্ণ। এটা করব না, সেটা করব না বলতেন। তিন মাসে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতেন। এখন আর সেটা খান না। সপ্তাহের একটা দিনের জন্য বাকি দিনগুলো কাটাচ্ছেন। একটা দিন নতুন কিছু করব, সেই রেশ নিয়ে সারা সপ্তাহ কাটছে। ‘জাহ্নবী’র দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজোয় সকলে আনন্দ করলেন। স্বামী নেই বলে পুজোর কাজ করবেন না, এমন নয়। একজন বললেন, ‘স্বামী চলে যাওয়ার পর মাকে বলেছিলাম তোমার মুখ দেখব না এ বছর। সেই এখানে এসে মাকে পায়েস রেঁধে খাওয়াচ্ছি।’ এই আনন্দটা অন্যরকম।’
প্রবাহিনী আসলে মধুবনীর কেরিয়ারেও একেবারে নতুন ধারার কাজ। তাই খানিক বিরূপ অভিজ্ঞতারও সাক্ষী তিনি। জানালেন, নানা মানসিকতার মানুষ আসেন। নিরাপত্তার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে তেমনভাবে না ভাবলেও ইদানীং এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন তিনি। অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, ‘এক মহিলা এলেন। প্রথম ফোনে বললেন, স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে। চারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। আগামিকাল কী খাব জানি না। সল্টলেকে থাকি। কী করব? আমি বললাম, আপনি কোনও কিছু না ভেবে চলে আসুন। তিনি এলেন। এতদিন মানুষ দেখছি, ওঁকে প্রথম দিন দেখে ভাবলাম, গল্পটা বোধহয় অন্যরকম। ধীরে ধীরে দেখলাম, উনি থাকেন নিউ আলিপুরে। স্বামীর সঙ্গেই থাকেন। একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আসলে ওঁর এটা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। এতদিন নিরাপত্তার দিকটা আলাদা করে ভাবার কথা মনে হয়নি। কারণ যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই খুব ভালো। এবার সকলেরই আধার কার্ড জমা নিতে হবে। কারণ এটা ঝুঁকিরও।’
শুধুমাত্র সাপ্তাহিক বৈঠক নয়। প্রবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ভবিষ্যতে নানা পরিকল্পনা রয়েছে মধুবনী। তিনি বললেন, ‘ওঁদের স্টেজে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। একটা মানুষ সারা জীবন শুধু হেঁশেল ঠেলে এবং ছেলেমেয়ে মানুষ করে হঠাৎ করে ফুরিয়ে গেল। এটা কেন হবে? এরা বলত, আমাদের তো আর জীবনে কিছু বাকি নেই। সব শেষ। আমি বলতাম, শেষেরও শুরু আছে। এখন যেটা শুরু করবে এটা নিজের জন্য। নিজেকে ভালোবাসো। সুন্দর সাজো। আনন্দ করো। চলো একসঙ্গে বাজার করি, খেতে যাই, কিছু না হোক
একটু হাঁটি।’
১৪ বছর বয়স থেকে মঞ্চে মধুবনীর পেশাদার জীবন শুরু। পেশাদার এবং ব্যক্তি জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়েছেন তিনি। প্রবাহিনী কি তাঁর জন্যও কোথাও খোলা আকাশের ঠিকানা? হেসে বললেন, ‘আসলে এটা শুরু করতে পেরে আমি অনেক অভিভাবক পেলাম। বাকি আমার সঙ্গে যারা আছে তারা আমার থেকে ছোট। আমি তাদের অভিভাবক। কান্না পেলে আমার ছেলেমেয়েদের সামনে চোখের জল ফেলতে পারব না। কারণ ওদের শক্তির জায়গা আমি। কখনও মনখারাপ হলে আমি জানি, প্রবাহিনীর একজন কেউ থাকবেন, যার সামনে আমি হালকা হতে পারি। আমাকে নিয়ে কেউ পরিহাস করার নেই। ওরা কেউ আমাকে বিচার করতে আসেননি। জীবনের সম্পর্কের জায়গায় দেখেছি বেশিরভাগ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। এখানে আমার আড়াল করার কিছু নেই। এখন ভাবি, গোটা পৃথিবীটাই একটা স্টেজ। আমি সেখানে ওদের সকলকে নিয়ে সেলিব্রেট করব। একা তো ভালো থাকা যায় না।’
এক অপূর্ব হাসি ছড়িয়ে দিলেন মধুবনী। ভাসিয়ে দিলেন সদর্থক ভাবনা। তার উত্তাপেই নতুন করে ভালো থাকতেন শিখছেন প্রবাহিনীরা।