পারিবারিক ঝামেলার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। প্রেম-প্রণয়ে শুভ। অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষে মানসিক চাপ বৃদ্ধি। প্রতিকার: আজ দই খেয়ে ... বিশদ
অঘ্রাণ আর মাঘ মাসে শীতের পিঠেপুলির সুবাসের সঙ্গে বাতাসে ভাসে সানাইয়ের সুর। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই প্রজাপতির মতো উড়ে আসে তেল-হলুদ ছোঁয়ানো ‘যদিদং হৃদয় মম’ অথবা ‘শুভ বিবাহ’ লেখা নেমন্তন্নের চিঠি। বিয়ে মানেই দিন-ভর খাওয়া-দাওয়া, হাসি, মজা, হুল্লোড় আর সাজগোজের নানান জল্পনা-কল্পনা। বিয়েবাড়ির আবহে থাকে উৎসবের আমেজ। বিয়ে নামক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সূচনা হয় এক নিবিড় সম্পর্কের। আর নতুন জীবনের শুভ মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে চেষ্টার শেষ থাকে না দু’পক্ষেরই। আয়োজনে থাকে নিত্যনতুন চমক। প্রাতিষ্ঠানিক বিয়ের নানা রকম নিয়ম-নীতিও রয়েছে। যার শুরু হয় পাটিপত্র দিয়ে। আশীর্বাদ, পানখিলি, দধিমঙ্গল, গায়ে হলুদ, শঙ্খকঙ্কণ, বর-বরণ, সপ্তপদী, শুভদৃষ্টি, মালাবদল, সম্প্রদান, অঞ্জলি, সিঁদুরদান, কন্যা বিদায় তার ওপরে বধূবরণ, বউভাত, অষ্টমঙ্গলা বা দ্বিরাগমন হয়ে ঘটে বিয়ের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি। আবহমানকাল থেকে চলে আসা সুপরিচিত সব প্রথা আর ধারাবাহিক অনুষ্ঠানমালা চলতেই থাকে। ঘন ঘন শাঁখ, উলুধ্বনি আর নানা স্ত্রী আচার বিয়ের অনুষঙ্গ হিসেবে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে। বাসরঘরের হুল্লোড়, শয্যাতুলুনি নিয়ে দু’পক্ষের মিষ্টিমধুর তরজা উৎসবমুখর বিয়েবাড়ির খুব পরিচিত দৃশ্য। একটা সময় ছিল যখন বাড়িতে ভিয়েন বসত। কম করে আট-দশ দিন ধরে আত্মীয়স্বজনরা থাকত। তাদের নিয়ে বড় হলঘরে বা উঠোনে সার সার কলাপাতা পেতে লুচি, আলুর ছেঁচকি, মিষ্টি, মাছ ভাজা, ঝোল, ভাত আর অম্বল দিয়ে খাওয়া-দাওয়া। আর এই সমস্ত ঘরোয়া খাওয়া-দাওয়া সামলাতেন বাড়ির ও আশপাশের বাড়ির গিন্নিরা। বরযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা হতো কাছের পড়শির বাড়িতে। সে সময়ে বিয়ের কার্ডেও থাকত কবিতার দু-চার ছত্র। যেমন, ‘দয়াময় বিশ্বপতি এই ভিক্ষা চাই, চিরদিন সুখী যেন এরা দুটি হয়’ অথবা ‘বধূমাতা হয়ে তুমি কর আগমন, ধন্য হও পুণ্য হোক সেই শুভক্ষণ।’
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সনাতন এই বিয়ের রীতি-নীতির বহু পরিবর্তন ঘটেছে। আধুনিক প্রজন্ম নিজস্ব চিন্তা ও চেতনা দিয়ে অন্যরকম ভাবছে। সবাই মিলে হইহই, কেনাকাটা, বাড়িঘর সাজানো থেকে প্রণামী, স্ত্রী আচার ও মন্ত্র পড়ে বিবাহে এই নব্য প্রজন্ম কি আগ্রহী নাকি একেবারে উল্টোপথে হাঁটতে চাইছে জেনারেশন ওয়াই? শুধুমাত্র সই-সাবুদে আর নির্দিষ্ট আয়োজনেই কি সন্তুষ্টি খুঁজছে তারা? নাকি আজও প্রথা মেনে সাবেক কালের নিয়মের ঘেরাটোপেই সারতে চাইছেন আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ে?
আইটিতে কর্মরতা সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অন্বেষা বসুর মতে, ‘সই-সাবুদে বিয়েটা সেরে ফেলাই বেটার। দশজন লোক ডেকে খাওয়া-দাওয়া এক ধরনের মজা নিশ্চয়ই। তবে অচেনা লোকজন যাকে হয়তো আমি কোনওদিন চোখে দেখিনি অন্য কোনও আত্মীয়-পরিচিতির সুবাদে তিনি আসবেন, খাবেন, চলে যাবেন এর মধ্যে কোনও যৌক্তিকতা আছে বলে আমার তো মনে হয় না। যেহেতু আমি কর্মরতা, সেহেতু সময়টাও বিরাট ফ্যাক্টর। বিশ দিন ছুটি নিয়ে এই আনন্দ সাগরে গা ভাসানোর মতো ব্যাপার তো কিছু নেই। ছেলে-মেয়ের দু’জনের দু’জনকে চেনা, পারস্পরিক বিশ্বাস আর অল্প কিছু খুব কাছের আত্মীয় আর বন্ধুদের নিয়েই আমি জীবনের নতুন ইনিংসটা শুরু করতে চাই।’
টাইম ইনস্টিটিউটের কেরিয়ার কাউন্সেলর ও নাট্যকর্মী শ্রীজাতা সেনগুপ্তের কথায়, ‘রীতি-নীতি মেনে বিয়ের কোনও ব্যাখ্যা বা প্রয়োজনীয়তা আজকের দিনে নেই বলেই আমি মনে করলেও কোথাও একটা প্রভাব রয়েছে গুরুজনদের ভালোবাসা বা আশীর্বাদের। এতদিন ধরে চলে আসা একটা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের গুরুত্ব পুরোপুরি অস্বীকারও করা যায় না। তবে কিছু নিয়মের ব্যক্তিগতভাবে আমি ভীষণ বিরোধী। যেমন সম্প্রদান যেখানে অন্যান্য দানপত্রের সঙ্গে যেন মেয়েটাকেও দানসামগ্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। পাশাপাশি অভিভাবকের ইচ্ছে-অনিচ্ছের মূল্য দিয়ে ও নিজের মতামতকে মান্যতা দিয়ে জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা ফেলতে চাই।’
কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের মাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড ভিডিওগ্রাফির পড়ুয়া সৌঋতা মজুমদারের কথায়, ‘রিচুয়ালসের ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটেছে। বৈদিক যুগে বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়েদের যথেষ্ট মান্যতা দেওয়া হতো। সমানাধিকার ছিল। সেখানে যতদূর আমার মনে পড়ছে তাতে তেরোটা রীতির কথা বলা আছে। যেটায় মেয়েদের অসম্মান ছিল না। পরবর্তী সময়ে সিঁদুর পরিয়ে, শাঁখা, পলা, লোহা পরিয়ে একজন নারীকে চিহ্নিত করে দেওয়া যে তিনি বিবাহিত। এবং কোনও একজনের সম্পত্তি। এটা কেন হবে? একটা মেয়েকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখানোর প্রথাতে আমি বিশ্বাসী নই একেবারেই। আমি এমন কিছু নিয়ম মানব না যা শুধুই মেয়েদের জন্য বরাদ্য। অনেক জায়গায় বিয়ের এই শাঁখা, সিঁদুর-এর মাহাত্ম্যকে বোঝাতে রোমান্টিসিজমের তকমায় মুড়ে তার বাণিজ্যিকিকরণও করা হয়। যার মধ্যে আমি অন্তত কোনও যৌক্তিকতা দেখি না। বিয়েতে ট্রাডিশনকে ছুঁড়ে ফেলার কথা বলছি না। শুধু মেয়ে হিসেবে সম্মানটা চাই।
আমার কাছে বিয়ে মানে একটা পার্টনারশিপ। সেখানে কেবলমাত্র একজন নারীর জন্য নির্দিষ্ট যা কিছু নিয়ম এই প্রথা মেনে নিতে আমি একেবারেই রাজি নই। হইচই, হাসি, আনন্দ করতে আমি রাজি শুধু বিয়েতে পুরুষতান্ত্রিকতার তীব্র উত্তাপটা আমি মানতে চাই না। স্বাধীন ব্যক্তিত্ব ও মতাদর্শের সাম্য নিয়েই আমি নতুন জীবনে পা দিতে চাই।’
বহুজাতিক বঙ্গ সংস্থার ফিনানশিয়াল অ্যানালিস্ট ব্যাঙ্গালোর কল্যাণনগরের বাসিন্দা গুঞ্জা গুপ্তার কাছে বিয়ে মানে দুটো মানুষের মন। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসা। এগুলো থাকলে বিয়েটা কোর্টে অথবা মন্দিরে যেখানেই হোক তাতে কিছু যায় আসে না। আর বিয়ে টিকিয়ে রাখতে গেলে সাবেকি নিয়ম, স্ত্রীআচার পালন করতে হবে এমনটাও তো হয়। বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, খুব আড়ম্বরপূর্ণ রীতিনীতি মেনে বিয়ে ছ’মাসেই ভেঙে গেছে। অথচ সেখানে কলমের আঁচড়ের বন্ধন আজীবন রয়ে গেছে। তাই গুঞ্জার মতে জীবনে যাদের কোনও ভূমিকা নেই, আশীর্বাদ নেই, কখনও গাইড করেনি নিছক হই-হল্লার জন্য তাদের আপ্যায়ন একরকম অপ্রয়োজনীয়। তাতে যদি পাঁচজন লোক ওই বিশেষ দিনে উপস্থিত হয় তিনি তাতেই খুশি।
কেননা তাদের উপস্থিতিটা তাঁর কাছে খুব গুণুত্বপূর্ণ। ফলে দু’তরফ থেকে রেজিস্ট্রেশনের পর একটা বড় পার্টি কাছের মানুষজনদের নিয়ে এটাই ঠিক। তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া এখন ছেলেমেয়ে সব্বাই কাজ করি আমরা। এত ছুটিই বা কোথায় যে দশদিন ধরে বিয়ের পর্ব চলবে। একদিনই যথেষ্ট। বেশিদিন ধরে ভূরিভোজ, ঠাট্টা-ইয়ার্কির পরই হবে নিন্দে-সমালোচনা। এটা হলে ভালো হতো, ওটা না হলেই চলত। পয়সা খরচ করে এসবের কোনও দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। মনের মানুষের হাত আমি আমার মতো করে ধরতে চাই।’
একেবারে উল্টো সুরে বক্তব্য শুনলাম বরানগরের নূপুর সিকদার ধরের কাছ থেকে। নূপুরের বক্তব্য ‘আমি ভীষণভাবে বিশ্বাস করি আচার-অনুষ্ঠান, নিয়ম-নীতিতে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই রীতিগুলোয় আমার প্রবল বিশ্বাস। আমি মনে করি বেশির ভাগ মেয়েই এই দিনটার স্বপ্ন দেখে। ঝলমলে সাজ, আত্মীয়-পরিজন সবার সম্মিলিত আনন্দও আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একে অপচয় আমি মনেই করি না। কেননা সমস্ত অনুষ্ঠানের পিছনেই কারও না কারও রুজি-রোজগার জড়িয়ে থাকে। প্রথম থেকেই হবুবরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে আমি নারাজ।’ এ তো গেল বিশ্বায়নের সময়ে দাঁড়ানো আগামী প্রজন্মের মতামত। পরিশেষে একটাই কথা বলার যে, পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর মনুষ্যত্বের মঙ্গলালোকে আলোকিত হোক, সুন্দর হোক আগামীর দাম্পত্যজীবন।