হস্তশিল্পীদের কর্মে সাফল্য ও সুনাম। সন্তানের সঙ্গে মতবিরোধ হতে পারে। ধর্মকর্মে মনোযোগ বাড়বে। ... বিশদ
মোটামুটি মাঝরাতে কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে বিশেষ কেউ খেয়ালই করবেন না যে বহু মানুষ রাস্তার ধারে ঘুমিয়ে আছে অথবা জানতে চাইবেন না, কেন এই মানুষগুলির জন্য রাতের কোনও আশ্রয় নেই। গাড়িতে দিল্লির যেকোনও রাস্তার মোড় পেরতে থাকুন দেখতে পাবেন, কিছু বাচ্চা ভিক্ষে করছে কিংবা ফুল, তোয়ালে, নকল বই প্রভৃতি বেচছে। কিন্তু কারও মনে এই স্বাভাবিক প্রশ্নটি জাগবে না যে, এই শিশুগুলি স্কুলে যায় না কেন? ভারতের অনেক জায়গাই রুক্ষ, শুষ্ক। সেসব জায়গা ধরে গাড়ি চালাতে থাকুন দেখবেন, কোথাও জলের চিহ্নমাত্র নেই! ওইসব জমিতে কিছুই জন্মাতে পারে বলে মনে হয় না। তবুও হাজার হাজার মানুষ ওইসব জমিতেই বসবাস করে। কিন্তু খুব কম লোকেরই মনে এই প্রশ্নের উদয় হয় যে, এত এত মানুষের তবে জীবিকার উৎস কী?
কংগ্রেসের ইস্তাহারে (লোকসভা, ২০২৪) স্বীকার করা হয়েছে যে, বিগত বছরগুলিতে, বিশেষ করে গত তিন দশকে ভারতের অর্থনীতির কিছু বিকাশ হয়েছে। ক্রমে বেড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্য, প্রত্যেকের হাতে একটি মোবাইল ফোন, বিভিন্ন রাজ্যে যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তা এবং আরবান ইন্ডিয়ার ‘টাউন স্কোয়ার’ হয়ে উঠেছে যেগুলি—যেমন ঝলমলে মল, সিনেমা এবং পাব প্রভৃতিতেই রয়েছে এই বৃদ্ধির স্বয়ংপ্রকাশ। তবে, এমন ‘উজ্জ্বল ভারত’-এর ছবিও কিন্তু পূর্বে বর্ণিত কুৎসিত সত্যগুলিকে আড়াল করতে পারে না। এগুলি আমাদের ব্যর্থতার সত্যটিকেই মনে পড়ায় এবং এসব আমাদের যেসব নীতির পরিণাম, সেগুলিকে শুধরে নেওয়ার সুযোগও বইকি।
অর্থনীতিতেই সমাজের প্রতিফলন
রাষ্ট্রসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি অনুসারে তারাই দরিদ্র যাদের মাথাপিছু আয় প্রতিমাসে শহরবাসীর ক্ষেত্রে ১২৮৬ টাকা এবং গ্রামবাসীর ক্ষেত্রে ১০৮৯ টাকা পর্যন্ত। ভারত জুড়ে এই দারিদ্র্য রেখার নীচে রয়েছে ২২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ। তবে এই হিসেবটাও যথাযথ নয়, বরং মারাত্মক গলদই রয়েছে এতে। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব অনুসারে, নীচের দিকের ৫০ শতাংশ বা ৭১ কোটি মানুষের হাতে রয়েছে জাতীয় সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশের মালিকানা। অন্যদিকে, জাতীয় আয়ে তাদের অংশভাক ১৩ শতাংশ মাত্র। সরকারের পারিবারিক ভোগব্যয় সমীক্ষা (এইচসিএসই) অনুসারে, নীচের দিকের ৫০ শতাংশ ভারতবাসীর প্রতিমাসে গৃহস্থালির খরচ গ্রামাঞ্চলে ৩,০৯৪ টাকা এবং ২,০০১ টাকা শহরাঞ্চলে। এবার বলুন, একেবারে নীচের ২০ শতাংশ মানুষের ভোগব্যয় আন্দাজ করার জন্য কি বিরাট গাণিতিক দক্ষতার দরকার পড়ে? ওই হতভাগ্য মানুষগুলি বস্তুত কোনোকিছুরই মালিক নয়। তাদের আয়পত্তর যৎসামান্য। একটি গৃহস্থ হিসেবে তারা যেটুকু খরচ করে সেটুকু না করলে এই পৃথিবীতে অস্তিত্ব রক্ষা করাই সম্ভব নয়। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই), ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের র্যাঙ্ক ১১১তম।
এইচসিএসই অনুসারে, গরিবদের মধ্যে ওবিসিরা একটা গড়পড়তা অবস্থানে রয়েছে। সবচেয়ে গরিব এসসি এবং এসটি শ্রেণির মানুষজন। এটা কোনও অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে, অর্থনৈতিক স্তর বিন্যাসটি কয়েক হাজার বছরের পুরনো। এতেই প্রতিফলিত হয় সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস। সামাজিক স্তর বিন্যাসটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বর্ণের উপর ভিত্তি করে। অত্যন্ত দরিদ্র এবং নিপীড়িত মানুষজন ন্যূনতম মজুরিতে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলি করতে বাধ্য হয়। ১৫ কোটি ৪০ লক্ষ নারী-পুরুষ যৎসামান্য জীবিকার সন্ধানে মনরেগা প্রকল্পে নাম লিখিয়েছে। বছরে ১০০ দিনের জায়গায়, তাদের কাজ দেওয়া হয় গড়ে মাত্র ৫০ দিন।
আয়-উপার্জনের বিপরীত প্রান্তে যারা রয়েছে, এবার তাদের দিকে তাকানো যাক। জনসংখ্যার শীর্ষ ১০ শতাংশের উপার্জন জাতীয় আয়ের ৫৭.৭ শতাংশ। মাত্র ৯,২২৩ জনের আয়ের অংশ হল ২.১ শতাংশ। অন্যদিকে, ৯২,২৩৪ জনের অংশভাক হল ৪.৩ শতাংশ আয়৷ এক-একটি ৩ কোটি ২২ লক্ষ থেকে ৮ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকা দামের ল্যামবাগিনি গাড়ি ২০২৩ সালে ভারতে বিক্রি হয়েছি ১০৩টি! কর্পোরেটগুলির পাশাপাশি, ৩৬২ জন ধনী ব্যক্তি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হেতু ৭৫৭ কোটি টাকার ‘কুখ্যাত’ নির্বাচনী বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলগুলিকে ‘দান করেছিল’। সংশ্লিষ্ট সবক’টি রাজনৈতিক দলকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে ওই দাতারা।
‘আচ্ছে দিন’ কি এসে গিয়েছে? ভারত কিংবা ভারতীয়রা কি ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে উঠেছে? ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ শুধুমাত্র চীনের সঙ্গে (হ্যাঁ, যে দেশের সৈন্যরা ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করার পর ভারতীয় সেনাদেরই টহল রুখে দিয়েছিল) ২০২৩-২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটা কি ‘অমৃতকাল’-এ ভোর? জনগণের সঙ্গে আর কতদিন প্রতারণা ও মিথ্যাচার চলবে?
দুই নির্ণায়ক
যতক্ষণ না রাজনৈতিক দলগুলি স্বীকার করে যে ভারতীয় রাজনীতি এবং অর্থনীতির দুটি নির্ণায়ক হল—জাতি এবং বৈষম্য—দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং নিপীড়নের মূলে আমরা আঘাত হানতে সক্ষম হব না। ‘উন্নয়ন’ নিয়ে বিজেপি যে ‘ন্যারেটিভ’ বানায় বা কাহিনি ফাঁদে, কংগ্রেসের ইস্তাহার তার কালো দিকগুলির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ওইসঙ্গে জনগণের কাছে কয়েকটি সাধারণ প্রতিশ্রুতিও রাখা হয়েছে:
এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের কাছে—
• দেশব্যাপী আর্থ-সামাজিক এবং জাতিভিত্তিক জনগণনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করা হবে। ভবিষ্যতে ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য শক্তিশালী কর্মসূচি গ্রহণের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হবে এই উদ্যোগটি।
• এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণের ৫০ শতাংশের সীমা প্রত্যাহার করা হবে।
• এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের জন্য সংরক্ষিত শূন্যপদের গত একবছরের সমস্ত ‘ব্যাকলগ’ পূরণ করা হবে।
যুবকদের কাছে—
• পাস করা হবে শিক্ষানবিশ অধিকার আইন। এক বছরের জন্য শিক্ষানবিশ রাখা হবে। দেওয়া হবে বছরে ১ লক্ষ টাকা স্টাইপেন্ড প্রদানের গ্যারান্টি। সব শেষে মিলবে চাকরি।
• কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় ৩০ লক্ষ শূন্যপদ পূরণ করা হবে।
• শিক্ষাঋণ বাবদ গৃহীত অর্থের কিছু বকেয়া থাকলে মকুব করা হবে সেটি। এছাড়া মকুব করা হবে অনুরূপ ঋণের উপর প্রদেয় সুদের অনাদায়ী অংশ।
মহিলাদের কাছে—
• চালু করা হবে মহালক্ষ্মী প্রকল্প। তার মাধ্যমে সবচেয়ে গরিব পরিবারের প্রতিটিকে দেওয়া হবে বছরে ১ লক্ষ টাকা।
• মনরেগার কাজে দৈনিক ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ বাড়িয়ে করা হবে ৪০০ টাকা।
• কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ করা হবে মহিলাদের জন্য।
গরিবের প্রতি নজর বৃদ্ধি
আগামী মাসে আমরা যে নয়া নির্বাচিত সরকার পাব, তাকে নীতিগতভাবে অবশ্যই হতে হবে ‘দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত’ মানুষের জন্য নিবেদি প্রাণ। কংগ্রেসের ইস্তাহারে এই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দিকটি স্বীকার করা হয়েছে। স্বভাবতই ইস্তাহারটি উঠে এসেছে দেজুড়ে চর্চার কেন্দ্রে। বিজেপির বাকশক্তি থেকে অর্থশক্তির বেশিরভাগটাই খরচ হয়ে গিয়েছে কংগ্রেসের ইস্তাহারকে নিন্দেমন্দ করতে—আরও যথার্থ বলতে গেলে বলতে হয় যে, কংগ্রেসের ইস্তাহারের ‘কাল্পনিক সংস্করণ’ প্রচারে।
মোট সাতদফার এই নির্বাচনটি স্থিতাবস্থা ‘রক্ষায়’ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং স্থিতাবস্থা ‘নষ্ট’ করতে মরিয়া দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধে পর্যবসিত হয়েছে। সকলে সৌভাগ্য ফেরার প্রত্যাশায় থাকুন আপাতত ৪ জুন পর্যন্ত।
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত