মাতৃসূত্রে বিপুল অঙ্কে বিত্তলাভ হতে পারে। কর্ম ও ব্যবসায় ক্রমোন্নতি। ঈশ্বর চিন্তায় মনে শান্তিলাভ। ... বিশদ
তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়ছেন। সে সন্দেশখালিই হোক বা সাধু-সন্ত। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এক দশক দেশ শাসনের পরেও বলার মতো তিনি কিছুই করতে পারেননি। তাঁর ঝুলিতে নেই অটলবিহারী বাজপেয়ির সোনালি চর্তুভুজের মতো কোনও উজ্জ্বল প্রকল্প। আছে শুধু ভবিষ্যতের গ্যারান্টি, যা কোটি কোটি মানুষের মতে, সবটাই ধাপ্পা।
লোকসভা নির্বাচনে প্রচারের বিষয় সাধারণত কী হয়? বিরোধী দলগুলি জানায়, তারা ক্ষমতায় এলে কী করবে। নির্বাচনের আগে দেওয়া অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি প্রায় কোনও দলই রাখে না। যেমন ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি সুইস ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালাধন দেশে ফিরিয়ে প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ও বছরে ২কোটি চাকরির দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রাখেননি। শুধু বিজেপি নয়, এই রকম অনেক প্রতিশ্রুতিই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দেয়, কিন্তু রাখে না।
আর ক্ষমতাসীন দল দেশবাসীকে জানায়, গত পাঁচবছরে সরকার কী করেছে এবং আগামী দিনে কী করতে চায়। এক কথায় জনগণের কাছে শাসক দল সরকারের কাজের ‘রিপোর্ট কার্ড’ পেশ করে। সুতরাং মোদিজির কী উচিত ছিল? গত দশ বছরে তাঁর সরকার কী কাজ করেছে, তার হিসেব দাখিল করা।
নরেন্দ্র মোদি বলতে পারতেন, ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কত ছিল এবং পেট্রল ও ডিজেল কত টাকা লিটার দরে বিক্রি হতো। আর তাঁর আমলে অপরিশোধিত তেলের দাম কত এবং ডিজেল, পেট্রল কী দামে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলতে পারতেন, কংগ্রেস আমলে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার কত ছিল, আর এখন কত! নরেন্দ্র মোদি আর কী বলতে পারতেন? তিনি ক্ষমতায় বসার আগে বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে ভারতের ঋণ কত ছিল এবং এখন তা কত হয়েছে। কংগ্রেস আমলের তুলনায় এখন বেকার বেড়েছে নাকি কমেছে। বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি। তাঁর আমলে কত নতুন চাকরি পেয়েছে এবং তাতে কত বেকার কমেছে।
এই সমস্ত কথা তুলে ধরলেই দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যেত। দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত, কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপি সরকার ভালো নাকি খারাপ। এমনকী মানুষ এও বুঝতে পারত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই সেরার সেরা কি না! এমনকী অটলজির চেয়ে নরেন্দ্র মোদি কতটা সফল, সেটাও তাঁর ভক্তরা বুঝতে পারতেন। মোদিজি নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়ে এসব কিছুই বলছেন না। উল্টে দাবি করছেন, তিনি নাকি ঈশ্বরের বরপুত্র। আর নোটবন্দির প্রসঙ্গ ভুলেও মুখে আনছেন না। অথচ একটা সময় নোটবন্দিকেই মোদি সরকারের বিরাট সাফল্য বলে বিজেপি প্রচার করেছিল।
নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহরা সে সবের ধারেকাছে না গিয়ে কেবল সন্দেশখালির কথা বলছেন। একটা পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা ইস্যুকে জোর করে গেলাতে চাইছেন। এখন আবার পড়েছেন সাধু-সন্তদের নিয়ে। কামারপুকুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণের একটা অংশকে উল্লেখ করে মেরুকরণের রাজনীতি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
অনেকে বলছেন, নরেন্দ্র মোদি অঙ্ক কষে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কার্তিক মহারাজের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচনের আগে কার্তিক মহারাজ বিজেপিকে ভোট দিন, এই কথাটিই শুধু বলেননি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির পক্ষে তিনি জোরদার সওয়াল করেছেন। তিনি ৩৭০ ধারা বিলোপ সহ বিভিন্ন ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কার্তিক মহারাজ নির্বাচনের আগে ঠিক কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, সমস্ত হিন্দুকে অনুরোধ করব, আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে আমরা সেই জায়গায় যাব, যিনি ভারতবর্ষের পরিচালক, যিনি ভারতবর্ষের সিংহপুরুষ, যিনি কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করেছেন, যিনি সিএএ প্রবর্তন করছেন আমরা তাঁর পিছনে দাঁড়াব। তাঁর হাতকে শক্ত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
এটা কি কোনও সাধুর ভাষা হতে পারে? সাধু-সন্তরা সকলের প্রণম্য। তাঁদের ধর্ম ও কর্ম একটাই, মানবসেবা। তাঁরা রাজনীতি, ক্ষমতা, সংসার থেকে শত হস্ত দূরে থাকেন। সর্বত্যাগী বোঝাতে ধারণ করেন গেরুয়া বসন। তাঁরা সবাইকে আপন করে নেওয়ার দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী। তাই বয়সে বড়রাও তাঁদের নতমস্তকে প্রণাম জানান। তাঁদের কাছে জাতি ধর্ম, উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, কোনও ভেদাভেদ থাকে না। মা সারদা বলেছিলেন, ‘আমি সৎ-এরও মা, অসৎ-এরও মা। আমি সকলের মা।’ সেই কারণেই মা সারদা আজ ঘরে ঘরে পূজিত হন।
কার্তিক মহারাজ হয়তো অনেকেরই শ্রদ্ধার পাত্র, ভরসার কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করেন। কিন্তু তিনি কি এই সব ‘সাধু গুণে’র অধিকারী? নির্বাচনের আগে কালীমন্দিরে দাঁড়িয়ে দেওয়া কার্তিক মহারাজের বক্তব্য শুনলে যে কেউ তাকে রাজনৈতিক নেতার ভাষণ বলেই ভুল করবেন।
এই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘কেউ কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচার করতেই পারেন। যিনি সেটা করতে চান বুকে দলীয় প্রতীক লাগিয়ে করুন। কোনও ধর্মীয় সংগঠন বা সংস্থার নাম ভাঙিয়ে নয়।’ আর তাতেই গায়ে ফোস্কা পড়েছে বিজেপির। মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায় চর্চা হতেই পারে। কিন্তু তা জায়গা করে নিয়েছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। ভাবা যায়?
কার্তিক মহারাজের এই বক্তব্যকে সমর্থন করেননি অধিকাংশ সাধু-সন্ত। এমনকী তিনি যে সংস্থার সঙ্গে যুক্ত সেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘও নয়। তারা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের পাশে থাকেন। নানাভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আর রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ সাধু-সন্তদের অবস্থান ও ভূমিকা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে। বলেছে, বেলুড় মঠ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এখানকার সন্ন্যাসীরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন না। এমনকী ভোটও দেন না। ভক্তরা কাকে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে হস্তক্ষেপও করেন না।
বঙ্গ রাজনীতিতে কট্টর মমতা বিরোধী বলে পরিচিত অধীর চৌধুরীও এই ইস্যুতে কার্তিক মহারাজেরই সমালোচনা করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কার্তিক মহারাজের হয়ে ব্যাট ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কট্টর মুসলিমদের চাপে সাধুসন্তদের উপর আক্রমণ করছেন। মুসলিম ভোট এককাট্টা করাই তাঁর উদ্দেশ্য।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হিন্দু বিরোধী প্রমাণের চেষ্টা নতুন কিছু নয়। একুশের বিধানসভা ভোটের আগেও বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়ে মুসলিম তোষণকারী তকমা সেঁটে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে যে লাভ হয়নি, সেটা ভোটের ফলেই প্রমাণ হয়েছে। শুধু সংখ্যালঘু ভোটের উপর নির্ভর করে যে বাংলায় ২১৩টি আসন জেতা সম্ভব নয়, সেটা জানার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
এবারও বিজেপি পরিকল্পনা করে বাংলায় ভোট মেরুকরণের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপি তবুও মুসলিম প্রার্থী দিয়েছিল। কিন্তু এবার ৪২টি আসনের একটিতেও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি। উদ্দেশ্য, বিজেপি হিন্দুদের দল, এই বার্তা দেওয়া। সেই কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন সাধুর দিকে রাজনীতি করার অভিযোগ তুললেই তাকে ইস্যু করছে বিজেপি।
লোকসভা নির্বাচন হোক বা বিধানসভা নরেন্দ্র মোদিই বিজেপির মুখ। প্রচারের দৌলতে বিজেপি আর মোদি সমার্থক হয়ে গিয়েছে। তাঁর আগে বা পরে কেউ নেই। মোদি ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বিজ্ঞাপনের পিছনে খরচ করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তা সত্ত্বেও নির্বাচনের দফা যত এগচ্ছে, ততই যেন টলে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাসের ভিত। তাই বাংলায় এসে শুধুই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুঁত খুঁজে বেড়াচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদি বুঝে গিয়েছেন, লোকসভা নির্বাচনেও বাংলায় বিজেপির ভরসা সেই নেগেটিভ ভোট। তাই তিনি যতই ঠকঠকান না কেন, ঘি বেরবে না। কারণ ভাঁড়ার শূন্য।