ঘরে বা পথেঘাটে পড়ে গিয়ে শরীরে বড় আঘাত পেতে পারেন। আমদানি রপ্তানির ব্যবসা ভালো হবে। ... বিশদ
শুধু ঈশ্বরই নন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছের মানুষদের, প্রিয় পরিজনদেরও নতুন নামে ডাকতেন। তাঁর স্নেহ-প্রেম-অনুরাগে সেই নাম পেত নতুন মহিমা।
তাঁর জীবনের প্রথম বান্ধবীকেই সম্ভবত প্রথম নতুন নামে ডেকেছিলেন। তিনি মারাঠি কন্যা আনা তড়খর। নব্যতরুণ কবিকে বিলাত যাবার আগে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচিত মুম্বই (তৎকালীন বোম্বে)-এর এক মারাঠি পরিবারে। সেই পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বিদুষী কন্যা আনা কিশোর কবিকে বিলাতি আদবকায়দা শেখাতেন। ইনিই কবির জীবনের প্রথম নায়িকা। কবির চেয়ে আনা বয়সে সামান্য বড় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গলায় গান শুনতে আনা খুব ভালোবাসতেন, বলতেন ‘রবি তোমার গান শুনলে আমি মরণ থেকেও জেগে উঠতে পারি’— এই কথারই রেশ ধরে রবীন্দ্রনাথ কি পরে গীত রচনা করেন—
‘‘তোমার কাছে এ বর মাগি
মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে’’
রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন আনা তাঁর কাছ থেকে একটি নতুন নাম চেয়েছিলেন। কবি তাঁর নবলব্ধা এই বান্ধবীকে ডেকেছিলেন ‘নলিনী’ নামে। এটি কবির প্রিয় নাম। শুধু তাই নয় আনাকে নিয়ে লেখা কবিতাতেও তিনি এই নামটি যুক্ত করে লেখেন—
‘শুন, নলিনী খোল গো আঁখি
ঘুম এখনো ভাঙিল না কি।
দেখ, তোমারি দুয়ার পরে
সখি, এসেছে তোমারি রবি’
রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন—‘এই ঘুম ভাঙানিয়া গানই রবীন্দ্রজীবনের প্রথম প্রেমসঙ্গীত।’
রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের নানা কাব্য-নাটকে ‘নলিনী’ নামটি বারবার এসেছে। হয়তো এভাবেই কবি তাঁর প্রথম সখীকে স্মরণ করেছেন।
এরপর ইংল্যান্ডে গিয়ে কবি ছিলেন ড. স্কটের পরিবারে। তাঁর তিন মেয়ের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়েছিল। যাঁরা প্রথমে অচেনা ভারতীয় তরুণকে এড়িয়ে গেলেও পরে বাঁধা পড়েছিলেন বন্ধুত্বের বন্ধনে। এঁদের মধ্যে লুসি স্কট ছিলেন কবি-অনুরাগিণী। তাঁদের নতুন নাম দিয়েছিলেন কি না জানা যায় না, কিন্তু সন্ধ্যাসঙ্গীতের একটি কবিতায় সেই বিদেশিনী কন্যাদের চিরজীবী করে রেখেছেন। অনুভবের গভীরতায় অনন্য সেই কবিতার নাম ‘দু’দিন’।
‘এই যে ফিরানু মুখ/ চলিনু পুরবে
আর কি রে এ জীবনে ফিরে আসা হবে।....
হু হু করে উঠিবেক সহসা এ হিয়া
সহসা এ মেঘাচ্ছন্ন স্মৃতি উজলিয়া,....
একটি মুখের ছবি উঠিবে জাগিয়া’
জীবনের পরিণত পর্বে কবির সঙ্গে পরিচয় হয় আর্জেন্টিনার বিদূষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে। কবির প্রৌঢ় প্রহরের এই তরুণী বান্ধবীর সঙ্গে তাঁর সখ্য আজ ইতিহাস। দীর্ঘ দু’মাস তিনি ভিক্টোরিয়ার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়ার তিনি নতুন নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’। ‘ভিক্টোরিয়া’ শব্দের অনুষঙ্গেই এই নামকরণ। এসময় লেখা ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেন ভিক্টোরিয়াকে—‘বিজয়ার করকমলে’ শেষ জীবনেও কবি ভিক্টোরিয়ার সখ্যকে স্বীকার করে অন্তিমপর্বের কয়েকটি কবিতার (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থে সংকলিত) ‘বিদেশের প্রেয়সী’ এই অভিধায় স্মরণ করেছেন তাঁর বিজয়াকে।
কবিজীবনের প্রেরণারূপিণী নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ নানা নামে স্মরণ করেছেন। কবির সাত বছর বয়সে ন’বছরের কাদম্বরী এসেছিলেন ঠাকুর পরিবারে জ্যোতিদাদার স্ত্রী নতুন বউঠান হয়ে। নানা কবিতায়, গানে নানা নামে তাঁকে ডেকেছেন কবি। একটি গ্রন্থ উৎসর্গে লিখেছেন—
‘শ্রীমতী হে—কে’
এই ‘হে’ কার নাম এই সম্বন্ধে একাধিক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। কারোর মতে গ্রিকদেবী ত্রিমুণ্ডী ‘হেকেটি’-র নামে এই বিশেষণ। কাদম্বরী দেবীর জীবনে তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রভাব ছিল। বা অন্যভাবে বলা চলে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন তিন বিখ্যাত জনকে—কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী, স্বামী জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ও দেবর রবীন্দ্রনাথ। এছাড়া ‘অলীকবাবু’ নাটকে নায়িকা ‘হেমাঙ্গিনী’ চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন। সেই নামের সংক্ষিপ্ত আকার হিসেবে ‘হে’ নামের প্রয়োগ এমন মতও প্রচলিত।
কবির শেষ জীবনের কাব্য ‘আকাশ প্রদীপ’-এর একটি অনবদ্য কবিতা—‘শ্যামা’। এই স্মৃতিজারিত কবিতার বালিকাবধূ যে শ্যামলবরণী লাবণ্যময়ী নতুন বউঠান, তা বোঝা যায়। ‘শ্যামা’ যেন নতুন বউঠানেরই কবি প্রদত্ত নতুন নাম।
জীবনের প্রেরণাদাত্রী প্রিয় সখী ছাড়া কাছের অন্য মানুষদেরও নানা নতুন নামে ডাকতেন কবি। তাঁর স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবীকে নাম দিয়েছিলেন— ‘মাংপবী’ তাঁর মংপুর বাসভবনে থাকাকালীন এই নামকরণ। আবার অমিয় চক্রবর্তীর বিদেশিনী স্ত্রীর নতুন নাম দেন হৈমন্তী, হিমের দেশের কন্যা বলেই সম্ভবত এই নামকরণ। মধুকণ্ঠী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম ছিল অণিমা। ‘কণিকা’ নাম কবির দেওয়া। সেই সঙ্গে তাঁর ডাক নাম ‘মোহর’-কে অতিরিক্ত স্নেহাদরে ‘আকবরী মোহর’ নামে ডাকতেন।
শুধু মেয়েদেরই নয় তাঁর প্রিয় সচিব ও ভাইপোদেরও কখনও নতুন নামে আবার কখনও বা গানের বাণীতে বেঁধেছেন। সচিব সুধাকান্ত রায় চৌধুরীকে কৌতুকছলে নাম দিয়েছিলেন—সুধোড়িয়া। তাঁর অতিপ্রিয় দুই ভাইপো গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথকে গানের কথায় বেঁধে রাখার অপূর্ব নিদর্শন পাই। ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’— বসন্তের এই গানে কবি এঁদের দু’জনকে বন্দি করেছেন অপরূপ ছন্দে। এই গানের সঞ্চারীতে পাই—
‘হে রো হে রো অবনীর রঙ্গ
গগনের করে তপোভঙ্গ’
সম্ভবত গগনেন্দ্রনাথের অঙ্কনরত মগ্ন অবস্থায় ছোট ভাই অবনীন্দ্রনাথ কিছু চপলতা করেন তখনই রবীন্দ্রনাথের এই গীতরচনা। তাঁদের আর এক ভাই ‘সমরেন্দ্রনাথ’-কেও একই গানে বেঁধেছিলেন—
‘হাসির সমরে তার মৌন রহেনা আর
কেঁপে কেঁপে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।’
পরে অবশ্য ‘সমর’ শব্দটি বদলে ‘হাসির আঘাত’ শব্দ প্রয়োগ করেন।
এমন আরও অনেক নামকরণ হয়তো কবি করেছেন যা সব আমাদের গোচরে আসেনি।
নামকরণ প্রসঙ্গে সবশেষে উল্লেখ করি কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীকে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ভবতারিণী। বিয়ের সময় সেই নাম বদলে নতুন নাম দেওয়া হয় ‘মৃণালিনী’। হয়তো রবি নামের সঙ্গে মিলিয়েই এই নামকরণ। তবে কবির বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের একটি আশীর্বচনে কবির স্ত্রীরূপে ‘স্বর্ণমৃণালিনী’ শব্দটি ছিল। সেটিও এই নামকরণের কারণ হতে পারে।
কিন্তু আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—স্ত্রীকে কি রবীন্দ্রনাথ নতুন কোনও নামে ডাকেননি? ‘মহুয়া’ কাব্যগ্রন্থে ‘মহুয়া’ কবিতার শেষে কবি লিখেছিলেন—
‘কানে কানে কহি তোরে
বধূরে যেদিন পাবো, ডাকিব মহুয়া নাম ধরে’
হয়তো নিভৃতে কোনও অন্তরঙ্গ নামে ডেকেছিলেন— যা আমাদের অজানা। তবে কথোপকথনে মৃণালিনীদেবীকে কখনও ছোটবউ, কখনও ‘রথীর মা’ বলে উল্লেখ করেছেন, সেখানে মিশেছিল প্রথানুগতি। কিন্তু মৃণালিনীদেবীকে
লেখা কবির চিঠিতে আমরা পেয়েছি অন্তরঙ্গ সম্বোধনের আভাস। ‘ছোটবউ’ থেকে ‘ছুটকি’ নামের মধ্যে এক স্নেহাসিক্ত কৌতুকাভাস মিশে আছে। এসবের বাইরে অন্য একটি নামে মৃণালিনী দেবীকে ডেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই স্নিগ্ধ মধুর নাম— ‘দুটি’। এই সম্বোধনে ধরা পড়েছে এক আন্তরিক হৃদয়বত্তা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন সব কর্মযজ্ঞের অবসানে ঘরোয়া পরিবেশে চান ক্ষণিকের অবকাশ। সেই অবসরের মুক্তি মেলে ‘ছুটি’ নামে। কর্মব্যস্ত প্রহর শেষে হয়তো কবি পত্নীর কাছে মেলে বিশ্রাম তাই তাঁর নতুন নাম ‘ছুটি’।
প্রিয়জনকে বিশেষ নামে ডাকাকে কবি অমর করে রেখেছেন ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে। নায়ক অমিত লাবণ্যকে দিয়েছে নতুন নাম ‘বন্যা’ আর লাবণ্য তার অন্তরতম অমিতকে দিয়েছে নতুন নাম ‘মিতা’।
এই নাম দুটি অনুরাগের নিবিড়তায় আজ ‘মিথ’-এ পরিণত। নামকরণের এই অন্তরঙ্গতা বোঝাতে অমিত বলেছে— ‘এ নাম হল বীজমন্ত্রের মতো, এ শুধু আমার মুখে আর তোমার কানে’
এই অনুভবেই ধরা আছে প্রিয়জনকে নতুন নামকরণের অনুরাগ রঞ্জিত মাধুরী। কবি নিজেই বলেছেন—
‘আমরা যাহাকে ভালোবাসি তাহার একটা
নতুন নামকরণ করিতে চাই।’
প্রিয়জনের নতুন নামকরণ তাই ভালোবাসার অনন্য উপহার।