দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় বা অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে অর্থাগমের উত্তম যোগ। ভুল পরিকল্পনায় কাজকর্মে বাধা আসতে পারে। ... বিশদ
এই ধরনের ফোন অনেকেই পেয়েছেন।
যাঁরা লোভে পা দিয়ে ওটিপি নম্বর জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। এগুলো আসলে প্রতারণার কল। বর্তমানে এই ধরনের প্রতারণা বেড়েই চলেছে। রাজনীতিও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনের সবক্ষেত্রেই প্রতারককে ঠিকমতো চিনতে না পারলে, সবকিছু কিন্তু নিমেষে শেষ হয়ে যাবে।
১৫ লক্ষ টাকা পুরস্কার প্রাপ্তি সংক্রান্ত প্রতারণার গল্প শোনার পরই অনেকেরই মনে পড়তে পারে দশ বছর আগের কথা। সেদিনও ছিল আজকের মতো এমনই ভোটের হাওয়া। সারা দেশের বিভিন্ন মঞ্চে গিয়ে এক নেতা বারবার বলে গিয়েছেন, ‘আপনারা আমাকে ভোট দিন, আমি বিদেশ থেকে সমস্ত কালো টাকা উদ্ধার করে নিয়ে এসে আপনাদের ব্যাঙ্কে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করে দেব।’ গোয়েবলসের থিয়োরির মতো তিনি একই কথা বারবার বলে মানুষের মনে অনায়াসে বিশ্বাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ৫৬ ইঞ্চি ছাতির সাহসিকতার উপর মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন। মানুষ তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের অ্যাকাউন্টে আর ১৫ লক্ষ টাকা ঢোকেনি। কালো টাকা বিদেশ থেকে আসেনি। নীরব মোদিরা তাঁদের আমলেই ব্যাঙ্ক লুটেপুটে পালিয়েছেন। তাঁর আমলেই দেশের গুটিকয় ধনী ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন। এখন কালো টাকা আনার কথা তিনি মুখেও আনেন না। নীরব মোদিদের গ্রেপ্তার করার কথাও বলেন না।
এখানেই শেষ নয়, তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বছরে দেশের দু’কোটি যুবককে চাকরি দেব।’ মানুষ আবার তাঁকে বিশ্বাস করলেন। উল্টে দেখা গেল, বহু মানুষ তাঁদের চাকরি হারালেন। দেশের চাকরির জগৎকে শ্মশান বানিয়ে তুললেন। সেই শ্মশানে বসেই যেন শুরু হয়েছে তাঁর ক্ষমতা দখলের সাধনা।
‘ভাঁওতাদ প্রতিশ্রুতির একটা একটা করে প্রমাণ রয়ে গিয়েছে বিজেপির ইস্তাহারে। এখনও গুগল খুললে পাওয়া যাবে বিজেপির প্রথম ও দ্বিতীয় লোকসভা ভোটের ইস্তাহার। সেই ইস্তাহার ছিল প্রতিশ্রুতির গঙ্গাসাগর। একটি প্রবাদ আছে, ‘স্বপ্নে পোলাও রান্না করলে বেশি করে ঘি ঢালো।’ সুতরাং যে প্রতিশ্রুতি পালনের দায়বদ্ধতা নেই, তাতে যত ইচ্ছে জল মেশাও। কংগ্রেস শাসনকালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিষোদ্গার করে ইস্তাহারে বিজেপি বলেছিল, ‘ক্ষমতায় এলে তাদের অগ্রাধিকার হবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ।’ কিন্ত কী দেখা গেল? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ে ব্যাপক ফাটকাবাজি হল। সর্ষের তেল সহ অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাতারাতি বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের পকেটে হাজার হাজার কোটি টাকা ভরে দেওয়া হল। তবে তা একতরফা ছিল না। বেওসায়িদের একাংশও বিজেপির তহবিলে গোপনে টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করলেন। শাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিজেপি কীভাবে একের পর এক চাঁদা নেওয়া বা ‘তোলাবাজি’ করেছে, আজ আর তা দেশের মানুষের কাছে লুকোছাপার ব্যাপার নয়।
মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করার বহু দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন বহু শাসক। কিন্তু গত দশ বছরে মানুষকে ধনেপ্রাণে মারার এমন নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতা এর আগে কোনও শাসকই দেখাতে পারেননি। এমন নজির যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁর নাম হল নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। কিন্তু মানুষের কাছে বারবার অসত্য প্রতিশ্রুতির টোপ ফেললেই কি মানুষ তা গিলে নেন? না, তা নেন না। বিগত দু’টো নির্বাচন মোদির মুখোশ খুলে দিয়েছে। দেশ থেকে কালো টাকা মুছে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যিনি, তাঁরই দলের তহবিলে জমছিল গোপন অনুদান। কে দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে, তার ইতিহাস গোপন করার কী মরিয়া চেষ্টা! কিন্তু গোটা গেমটারই চালিয়াতি ফাঁস হয়ে গেল। ধর্ম নিয়ে যাঁদের ব্যবসা, তাঁদের সামনেই ধর্মের কল বাতাসে নড়ে গেল। কীভাবে বড় বড় কোম্পানিকে ভয় দেখিয়ে তাদের বাড়িতে ইডি পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেল করে পার্টি টাকা আদায় করত, তা আজ জলের মতো পরিষ্কার। যে কোম্পানি লোকসানে চলছে, সেও শত শত কোটি টাকা গেরুয়া বাবাজিদের তহবিলে তোলা দিয়েছে। সেই তোলাবাজির গোপন কথা ফাঁস হতেই দেশজুড়ে ধিক্কার। কিন্তু মুখে কুলুপ ৫৬ ইঞ্চি অ্যান্ড কোম্পানির। এসব কথা কিন্তু ইস্তাহারে পাওয়া যাবে না।
বিগত দশ বছরের ইতিহাস মানুষের কাছে সেই বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস। একবার চোখ বুজে বড় বড় প্রতিশ্রুতিগুলো বসে পাঁচ মিনিটের জন্য ভাবুন। বুঝতে পারবেন, দেশের নাগরিক হিসাবে আপনি কতখানি প্রতারিত হয়েছেন। ১৫ লক্ষ টাকা , দু’কোটি চাকরির পরেও রয়েছে অজস্র প্রতিশ্রুতি। আচ্ছে দিন। পেয়েছেন? পাননি। না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা! বিরোধীদের খাওয়া বন্ধ করার ফাঁকে দেখা গেল নিজেরাই গলা পর্যন্ত খেয়ে বসে আছেন। ঢেকুর তোলার জায়গা পর্যন্ত নেই। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে অর্থাৎ ২০২২ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি মানুষের মাথায় পাকা ছাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেখানেও ব্যর্থ। করোনার সময় বারবার দেখা গিয়েছে মোদি সরকারের অমানবিক মুখ। দেশের কালো টাকা ধরার নামে নোটবন্দি করলেন। বললেন, ‘আমাকে পঞ্চাশ দিন সময় দিন, আমি দেশের অর্থনীতি বদলে দেব।’ এক্ষেত্রে তিনি কথা রেখেছেন। অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছেন, কিন্তু সেটা অক্ষমের হাতে পড়ে তলিয়ে যাওয়ার লজ্জা! দেশের বৈদেশিক ঋণ ক্রমেই বাড়ছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো আমরাও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি ঋণের জালে, আর সরকার অসত্য তথ্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, ‘সব ঠিক হ্যায়’।
২০১৪ সালে দেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল প্রায় ৫৬ লক্ষ কোটি টাকা। দশ বছরে সেই ঋণ তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে। সোনার দাম, টাকার দাম, পেট্রল-গ্যাসের দাম নিয়ে তুলনা করুন, ব্যর্থতার প্রমাণ পেয়ে যাবেন। অর্থনীতি যে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে, তা অনেকদিন আগেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন স্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছিলেন। তারপর মোদি সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বহর দেখে একে একে সরে পড়েছেন অরবিন্দ পানাগরিয়া, অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম, উর্জিত প্যাটেলের মতো বড় বড় অর্থনীতিবিদরা।
এবারের নির্বাচনে তাঁর স্লোগান, ‘মোদির গ্যারান্টি’। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর একটা গ্যারান্টিও কাজে লাগেনি। দেউলিয়া শাসকের আবার গ্যারান্টি! বিজেপি যাঁকে ‘বিশ্বগুরু’ সাজিয়ে ভোটপ্রচারে নেমেছে, আন্তর্জাতিক স্তরে তিনি ভারতকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছেন, তা অনেকেরই জানা নেই। গণতন্ত্র, খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বাক স্বাধীনতা, শান্তি, সুখী দেশের নিরিখে আমরা তালিকার শেষের দেশগুলোর সঙ্গে লড়াই করছি। মোদির শাসনে আমরা প্রায় সবক্ষেত্রে লাস্ট বয়।
একটা খামখেয়ালি শাসন ব্যবস্থার মূল্য দিতে হচ্ছে দেশের প্রতিটি মানুষকে। বিরাট স্ট্যাচু অব ইউনিটি গড়ে যিনি একসময় হাততালি কুড়িয়েছেন, তিনিই ভারতের আত্মিক ঐক্যকে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে শেষ করতে চলেছেন। যিনি নিজেকে দেশের ‘চৌকিদার’ বলে বুক বাজান, তাঁর দলকে ঘিরে আজ ইলেক্টোরাল বন্ডের কলঙ্ক জমেছে। আমরা এখনও জানি না, পিএম কেয়ার্স ফান্ড নিয়ে এমন কোনও হতবাক হওয়ার মতো কিছু ভবিষ্যতে ঘটবে কি না! একমাত্র সুপ্রিম কোর্টই আমাদের সেই রাস্তা দেখাতে পারে। সুতরাং এই মুহূর্তে মোদি গ্যারান্টির শেয়ার দর যে ভোটারদের কাছে হু হু করে পড়ে যাচ্ছে, এনিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
পাশাপাশি ভোটারদের এই বাংলার দিকে তাকাতে বলি। কীভাবে রাজ্য সরকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অসময়ে তাঁদের বল ভরসা জোগাচ্ছে, সেটা দেখে শেখার মতো। শুধু লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের শক্তিকে রোখার মতো কোনও শক্তিই আজ বিজেপির অস্ত্র ভাণ্ডারে নেই। তাই এবার বিজেপিকে লড়তে হবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্যসাথী, কৃষকবন্ধু, খাদ্যসাথী, কন্যাশ্রী, ঐক্যশ্রী, রূপশ্রী, জয় জোহার নামক নানা মৃত্যুঞ্জয় অস্ত্রের সঙ্গে। মোদির বায়বীয় গল্প, নাকি মমতার বাস্তবতা? বাংলার মানুষকে ভাতে মারার কৌশল, নাকি তাঁদের মুখে ভাত পৌঁছে দিতে এক নারীর অসম লড়াই। এটাই এবার নিরূপণ করবে ভোটের ভাগ্য! অবশ্য বিজেপিরও আছে নিজস্ব এক বড় মাপের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার! সেখানে হাজার টাকা নয়, জমা হয় বেওসায়িদের হাজার হাজার কোটি টাকা। তার জোরেই বিজেপি নিজেকে সর্বশক্তিমান মনে করছে। সেই টাকার জোরেই যেন দেশের বিরোধী নেতাদের কিনে নেওয়ার ‘মান্ডি’ খুলে বসেছে। কিছুতেই গুরুত্ব দিচ্ছে না গণতন্ত্রে মানুষের শক্তিকে। ভোট কি তবে নতুন দিশা দেখাতে পারবে? বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তাঁদের কথার মূল সুরই হল, ‘দশ বছরের দশমীতে বেজে উঠুক মোদি বিসর্জনের ঢাক!’