আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় দিনটি শুভ। স্বামী/ পত্নী/ সন্তানের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ। ... বিশদ
থাকলে তাঁদের সমাধি থেকেই উঠে আসবেন তিরুবল্লুবর, এলাঙ্গো আদিগল, আভাইয়ার এবং সঙ্গম কবিরা। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বাজনদারদের ব্যাখ্যায় সেঙ্গোল হয়ে উঠেছে এক অস্থায়ী শক্তির প্রতীক। একজন পুরোহিত কিংবা একজন বিদায়ী শাসকের হাত থেকে নতুন শাসককে সেঙ্গোলের কাল্পনিক হস্তান্তরকে ক্ষমতা হস্তান্তর হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
কীভাবে ইতিহাস এবং একটি নীতিশাস্ত্রীয় প্রণালী নির্লজ্জভাবে বিকৃত করা যায় তারই প্রদর্শনী হল ২৮ মে। একদল লোক ভেরি বাজাল, দরবারি লোকজন শাসকের প্রতি গদগদ হল এবং সংসদের দুটি কক্ষের জন্য একটি নতুন ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান রূপান্তরিত হল প্রকারান্তরে রাজ্যাভিষেকে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীকে (রাজাজি) একটি রাজকীয় অনুষ্ঠানের সাক্ষী
হওয়ার জন্য তলব করা হয়েছিল, সেটি একটি গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের পক্ষে অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। যে অনুষ্ঠানটির আয়োজন ধর্মনিরেপক্ষ হওয়াই কাম্য ছিল, সেখানে শৈব অধিনাম বা মঠগুলির
নিভৃতচারী প্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তার মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় ধর্মীয় ভাবাবেগ যোগ করা হল, এই ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক।
টেলিভিশনের পর্দায় এই অনুষ্ঠান দেখার সময় দর্শকরা নিশ্চয়, গত ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি মুর্মুর সাদামাঠাভাবে শপথ গ্রহণের সঙ্গে এদিনের রাজকীয় আয়োজনের বৈপরীত্য খেয়াল করেছেন। এবং জনগণ, বিশেষ করে কর্ণাটকবাসী এই ভেবে বিস্মিত হবেন যে, ‘কে কাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন?’
সেঙ্গোলের সংজ্ঞা দিয়েছেন কবি
প্রখ্যাত তামিল কবি ও দার্শনিক তিরুবল্লুবর ৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর যে অমর পদগুলি লিখেছিলেন সেগুলি বিখ্যাত তিরুক্কুরাল গ্রন্থে পাওয়া যায়। ‘সম্পদ’ নামক অংশে সন্নিবেশিত হয়েছে সেঙ্গোনমাই (ন্যায় রাজদণ্ড) এবং কোডুঙ্গোনমাই (নিষ্ঠুর রাজদণ্ড) শিরোনামের দুটি অধ্যায়। তার দুই চরণের ৫৪৬ সংখ্যক শ্লোকে রয়েছে—
‘বেলান্দ্রি বেন্দ্রি তরুবতু মন্নবন
কোল আদুউম কোদতু এনিন’
কোল হল রাজদণ্ড। শ্লোকটির অর্থ হল—‘এটি তেমন কোনও বর্শা নয় যে শাসকের জন্য জয় এনে দেবে, এটি হল সেই কোল বা রাজদণ্ড’। তবে কবির লেখা শেষ তিনটি শব্দ চিহ্নিত করা যায়: এ হল
সেই কোল বা রাজণ্ড যেটি কোনওভাবেই নত হবে না। এই রাজদণ্ড অবশ্যই ঋজুশির থাকবে। এটা কোনওভাবেই নত করা উচিত নয়। একই চিন্তাভাবনা প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণেও অনুসৃত হয়—‘... সংবিধান ও আইন অনুসারে সব ধরনের
মানুষকে ন্যায়বিচার দেব—এইসময় আমার মধ্যে কোনও প্রকার ভয় অথবা পক্ষপাতিত্ব, স্নেহ কিংবা অসদুদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকবে না।’ কোল হল ন্যায়দণ্ডের প্রতীক—তার বেশিও নয়, কমও নয়। যদি নত না-হয়, তবেই এটি সেঙ্গোল আর নত হলেই নিষ্ঠুর দণ্ড।
সেঙ্গোল হল ন্যায়ের শাসনের প্রতীক, কোনওভাবেই ক্ষমতার প্রতীক নয়। যে শাসক রাজদণ্ড ধারণ করেন তিনি ন্যায়সঙ্গত শাসন করারই প্রতিশ্রুতি দেন। তিরুবল্লুবর সেঙ্গোলকে শাসকের চারটি গুণের মধ্যে একটি বলেছেন: ‘একজন ভালো রাজার চারটি গুণ হল—দান, করুণা, ন্যায়পরায়ণ শাসন এবং দুর্বলের (দরিদ্রদের) সুরক্ষা’ (কুরাল ৩৯০)। সেঙ্গোনমাইয়ের বিপরীত একটি অধ্যায়ের শিরোনাম কোডুঙ্গোনমাই, এটিকে একটি নিষ্ঠুর বা অন্যায় শাসন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
সেঙ্গোলের প্রশস্তিমূলক সঙ্গীত
কিংবদন্তি চোল রাজা করিকালানকে তাঁর ‘অরণোদু পুনর্ন্দা তিরনারী সেঙ্গোল’-এর জন্য প্রশংসা করেন এক সঙ্গম কবি, যার অর্থ হল তাঁর জ্ঞানী শাসনের সঙ্গে নীতির বিবাহ হয়েছিল। অন্য এক সঙ্গম কবি শাসককে ‘ইরেরকু নিজন্দ্র কোলিন’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই কথার অর্থ হল—শাসক নিশ্চিত করেছেন যে, যেসব কৃষক খাদ্য উৎপাদন করেছেন তাঁদের কোনওরকম দুর্দশার সম্মুখীন হতে হবে না। মহাকাব্য শীলপ্পাটিকারমের রচয়িতা জৈন সন্ন্যাসী এলাঙ্গো আদিগল। কান্নাগীর প্রতি অবিচারের জন্য শোক প্রকাশ করেছিলেন তিনি এবং যে-রাজার কারণে সেঙ্গোল নত হয়েছিল সেই রাজার পতনেরও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি।
জনগণের কবি আভাইয়ার সহজ ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা এইরকম:
‘যখন বাঁধ উঁচু হবে, তখন তাতে বেশি জল সঞ্চিত হবে,/ যখন জলধারণ বেড়ে যাবে, তখন বেশি ধান ফলবে,/ যখন ধান বেশি উঠবে, পরিবারগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে,/ যখন পরিবারগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে,/তখন উঁচুতে উঠবে রাজদণ্ড,/ এবং, যখন রাজদণ্ড ঋজুশির হয়ে উঠবে, তখন উঠে দাঁড়াবেন শাসকও।
যে রাজদণ্ড বেঁকে বা নত হয়ে গিয়েছে, সেটি অন্যায় বা নিষ্ঠুর শাসনের চিহ্ন। কোনও একটি অংশের পক্ষে কিংবা অন্য একটি অংশের বিপক্ষে পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না। কোনও সম্প্রদায়, ধর্ম বা ভাষার বিরুদ্ধে বদমতলব চরিতার্থ করার কোনও জায়গা নেই।
সমসাময়িক কিছু দৃষ্টান্ত হল—ঘৃণার ভাষণ, নজরদারি, লাভ জিহাদ বা বুলডোজার বিচার—এগুলির কোনও স্থান হতে পারে না। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনেরও (সিএএ) কোনও জায়গা থাকতে পারে না। কারণ এই আইন প্রতিবেশী
দেশের মুসলমান, নেপালের খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ এবং শ্রীলঙ্কার তামিলদের প্রতি বৈষম্যমূলক। যে ‘কৃষি আইন’ দেশের কৃষকদের, ব্যবসায়ী ও একচেটিয়া কারবারিদের করুণার পাত্র করে রাখে, তার কোনও জায়গা হতে পারে না। মহারাষ্ট্র থেকে একটি
প্রকল্প ছিনিয়ে গুজরাতে নিয়ে যাওয়ার যে মানসিকতা, কোনও জায়গা হতে পারে না তারও। একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের রাজনৈতিক দল কোনও নির্বাচনে মুসলিম বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে
সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রার্থী বাছাই করতে পারে না, যেমনটা দেখা গেল সদ্য সমাপ্ত কর্ণাটক রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে। কিংবা, বিচারপ্রার্থী পদকজয়ী ক্রীড়াবিদদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলনকে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের পুলিস বলপূর্বক ভেঙে দিতে পারে না।
সেঙ্গোলকে অপবিত্র করবেন না
রাজদণ্ডকে ক্ষমতার সঙ্গে সমান করে দেখার অর্থ, সেঙ্গোলের ধারণাকে অপবিত্র করা। এই প্রসঙ্গে লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং রাজাজিকে টেনে আনা মানে শুধুমাত্র ইতিহাসকে বিকৃত করা নয়, বরং একজন বাস্তববাদী ভাইসরয় ও একজন জ্ঞানী পণ্ডিত-রাজনীতিককে ছোট করা এবং তাঁদের সাধারণজ্ঞানকেও কটাক্ষ করা।
স্পিকারের উপবেশনের স্থানে পোডিয়ামের ঔজ্জ্বল্য সেঙ্গোল বাড়িয়ে তুলুক। এটি হয়ে উঠুক সংসদের কার্যক্রমের নীরব সাক্ষী। সেঙ্গোল সোজা হয়ে দাঁড়াবে—যদি সংসদ মুক্ত বিতর্কের জায়গা হয়; যদি সংসদ বাকস্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য পূর্ণরূপে উন্মুক্ত থাকে; সংসদে যদি দ্বিমত ও ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে; এবং যদি অবিচার বা অসাংবিধানিক আইনের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা থাকে। আসুন, আমরা আশা করি, সেঙ্গোল এবং তার অর্থ—সেঙ্গোনমাই (সুশাসন)—জয়ী হবে।