বিদ্যালাভের পক্ষে দিনটি উত্তম। ব্যবসার উন্নতি, পেশায় সুনাম। উপার্জন বাড়বে। ... বিশদ
নির্বাচন হল রাজনৈতিক দলের কাছে অ্যাসিড টেস্ট। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকে। জয়ের আশায় কেউ জোটসঙ্গী পাল্টায়, কেউ পাল্টায় দল। নির্বাচনের ফল বেরলে ‘দলবদলু’রা বুঝতে পারেন, তাঁদের স্ট্যান্ড বা গেমপ্ল্যান ঠিক ছিল, নাকি ভুল! মানুষের মনোভাব বুঝে নেতারা এবং রাজনৈতিক দলগুলি তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করে থাকে। রাজনীতির এটাই প্রথা।
বাংলার রাজনীতিতে একুশের বিধানসভা নির্বাচন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কারণ এই নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে যে ভাঙাগড়া হয়েছে তা আগে কখনও হয়নি। জোট গড়াতেও ছিল চমক। নীতি ও আদর্শের ধ্বজা উড়িয়ে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড সৃষ্টিকারী বামেরা আইএসএফের সঙ্গে জোট করেছিল। স্রেফ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। ২০১৬ সালে জোট করেছিল কংগ্রেসের সঙ্গে। ক্ষমতায় ফেরার তীব্র বাসনায় সিপিএম নেতৃত্ব ভুলে গিয়েছিল এই কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই ’৭২-এর সন্ত্রাসের ফাটা রেকর্ড বাজিয়ে বাংলা দখল করেছিল তারা। এভাবেই একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বামেরা ‘বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি’ প্রবাদটার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
শূন্যে পৌঁছনোর বড় কারণটি হল, সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ লেগে থাকা আইএসএফের সঙ্গে জোট শিক্ষিত বামপন্থীরা মেনে নেননি। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা। উল্টো মেরুর সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদত দেওয়াটা সমাধানের পথ হতে পারে না। কিন্তু সেই ভুলটাই সিপিএম করেছিল। তাই একদা বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ বাংলায় সিপিএম হয়ে গিয়েছে অপ্রাসঙ্গিক। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, বাম নেতৃত্ব নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ফের আইএসএফের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষিতে প্রমাণ হল, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া নয়, ভুল করাটাই বামেদের ট্র্যাডিশন।
আইএসএফ বিধায়ক গ্রেপ্তার হতেই ‘গণতন্ত্র রক্ষা’র দোহাই দিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে সিপিএম। ধৃত বিধায়কের সঙ্গে দেখা করার জন্য সটান লালবাজারে হাজির হয়েছিলেন সুজন চক্রবর্তী। যদিও পুলিস ধৃত বিধায়কের পরিবারের সদস্যদের ছাড়া কাউকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। তাই বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকির সঙ্গে মোলাকাত হয়নি সুজনবাবুর। তবে, তাঁর আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। আর সেই ছবি সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় খুব গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে। তাতেই বোঝা গিয়েছে, সিপিএমের ‘গণতন্ত্র রক্ষা’র আসল তাগিদটা কোথায়।
সিপিএম যে খেলাটা একুশের বিধানসভা নির্বাচনে খেলেছিল, পঞ্চায়েত ভোটের আগে সেই ছকেই এগতে চাইছে। সিপিএম নেতৃত্ব অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে আইএসএফ বিধায়কের গ্রেপ্তারিকে গোটা মুসলিম সমাজের উপর আঘাত বলে দেখাতে চাইছে। সেই জন্য নৌশাদ সিদ্দিকির ধর্মীয় পরিচয়টাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। বিজেপি যে কৌশলে ধর্ম আর রাজনীতিকে মিশিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে, এখানেও সিপিএম ঠিক সেই চেষ্টাই করছে। এর উদ্দেশ্য? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কে চিড় ধরানো। তাতে বামেদের কতটা লাভ হবে বলা মুশকিল, কিন্তু বিজেপির লাভ ষোলোআনা।
ফুরফুরা শরিফ শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছেই নয়, বহু হিন্দুর কাছেও অত্যন্ত পবিত্র স্থান। প্রচুর মানুষ সেখানে গিয়ে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ফুরফুরা শরিফের পীরজাদারাও বিশেষ সম্মান ও শ্রদ্ধা পান। কিন্তু কোনও ধর্মগুরু ধর্মের আঙিনা ছেড়ে রাজনীতির ময়দানে অবতীর্ণ হলে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়টাই বড় হয়ে যায়। ভাঙড় কাণ্ডে সেটাই ঘটেছে। নৌশাদ সিদ্দিকি পীরজাদা এবং সম্মাননীয়। কিন্তু তিনি সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই। তাই তাঁর গ্রেপ্তারি কিছুতেই মুসলিম সমাজের উপর আঘাত হতে পারে না।
শুধু সিপিএম নয়, বিজেপিও একইভাবে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা নৌশাদ সিদ্দিকিসহ ১৯ জনের গ্রেপ্তারির ঘটনাকে হাতিয়ার করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুসলিমদের উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিজেপি নেতৃত্ব বলছে, যাদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছেন, এবার তারাই দেখুক, কাকে বসিয়েছে!
বিজেপি নেতৃত্ব কেন একথা বলছে? আসলে এটা গেরুয়া শিবিরের চরম হতাশার বহিঃপ্রকাশ। ভাঙড়ে তৃণমূল ও আইএসএফের অশান্তির রেশ কলকাতায় আছড়ে পড়লে সবচেয়ে খুশি কারা হতো? অবশ্যই বিজেপি। কলকাতার বুকে আইএসএফের অশান্তির ভিডিও ভাইরাল করা হতো। সেই ছবি এমনভাবে তুলে ধরা হতো যাতে হিন্দুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আর আতঙ্কিত করতে পারলেই সহজ হয় মেরুকরণের কাজ। সেই ছবি দেখিয়ে বোঝানো হতো, কেন এরাজ্যে বিজেপিকে আনা দরকার।
ভাঙড় ইস্যুতে পুলিস কড়া পদক্ষেপ না নিলেই অশান্তি বাড়ত। তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের টিম ময়দানে নেমে পড়ত। তারা প্রচার করত, অশান্তি হল, ভাঙচুর হল, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিস পকেটে হাত ঢুকিয়ে বসে রইল। কিছুই করল না। ‘দুধেল গাই’ বলেই পুলিস অ্যাকশন নিল না। হিন্দু হলে মেরে ফাটিয়ে দিত। কিন্তু পুলিস আইন রক্ষায় কড়া পদক্ষেপ করায় সেই সুযোগটা বিজেপির হাতছাড়া হয়ে গেল।
বছর ঘুরলেই লোকসভা ভোট। বিজেপির দিল্লির কর্তারা হিসেব কষতে গিয়ে বুঝতে পারছেন, ২০২৪ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া খুব সহজ হবে না। কারণ পরপর দু’বার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বসেও আম জনতার স্বার্থে বলার মতো কোনও কাজই করেনি। উল্টে পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। লক্ষ লক্ষ সরকারি পদ অবলুপ্ত করেছে। চাকরির সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়ায় বেড়েছে বেকারত্ব। গেরুয়াকরণের লক্ষ্যে অবিচল বিজেপির দিক থেকে আগেই মুখ ফিরিয়েছে সংখ্যালঘুরা। তার উপর রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা বিজেপির কাছে গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে মোটেই স্বস্তিতে নেই দিল্লি বিজেপি।
ভারতীয় জনতা পার্টির গোপন রিপোর্ট বলছে, দেশের ৬০টি সংখ্যালঘু আসনে তাদের জেতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে ১৩টি। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দলের কর্মীদের শিক্ষিত মুসলিমদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন, রামমন্দির নির্মাণ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। গটগট করে গিয়ে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসবেন। এখন সেই মোদিজিই মুসলিমদের কাছে যেতে বলছেন। তবে এটা উদারতা নয়, স্বপ্ন সফল করার নয়া ছল।
‘৭০ শতাংশ’কে এককাট্টা করার আশায় গুজরাত, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে কোনও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি বিজেপি। সফল হয়েছে সেই গেমপ্ল্যান। দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা হবে জেনেও বিলকিস বানোর খুনিদের জেল থেকে বেরনোর পথ মসৃণ করে দিয়েছে। তার জেরে গুজরাতে রেকর্ড সংখ্যক আসন জিতে ক্ষমতায় ফিরেছে বিজেপি। সেই বিজেপি কি না বাংলায় নৌশাদ সিদ্দিকির মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে! বেড়াল গাছে উঠতে চাইলে বুঝতে হবে, সে ঠেলায় পড়েছে।