পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি। ... বিশদ
এডওয়ার্ড সঈদ, গায়ত্রী স্পিভাকের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক এশীয় পণ্ডিতরা ইউরোপীয় শাসক ও চিন্তকদের আফ্রো-এশিয়াকে দেখার ‘ওয়ার্ল্ড ভিউ’ বুঝতে সাহায্য করেছেন। বলেছেন, আসলে প্রাচ্যের কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ, তা ইউরোপ-আমেরিকানদের কল্পনাপ্রসূত সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করে থাকে। এবারের বিশ্বকাপ সেই ভাষ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটা মোক্ষম সুযোগ করে দিয়েছে। সঈদ সেই পশ্চিমী হীনমন্যতার ছবি এঁকেছেন, যেখানে পশ্চিম মনে করে আফ্রো-এশিয়ানরা নীচ-হীন, নোংরা, অসভ্য, নিজেদের শাসনে অক্ষম, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। বিপরীতে পশ্চিমই দুনিয়ার শাসক ও নেতা হওয়ার যোগ্য। উপনিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্মে ইউরোপীয় নাগরিকদের কলোনিয়াল শাসক ‘মাইন্ডসেট’ তৈরির ‘সাপ্লাই চেন’ নির্মাণ তাদের জন্য প্রয়োজন ছিল। অনৈতিক শাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউরোপীয় সাধারণ নাগরিকের উপর ‘প্রাচ্যবাদ’ দর্শন চাপিয়ে দেওয়ার চর্চা ছিল। এসব বর্ণবাদী চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা যে পশ্চিম থেকে এখনও মোছেনি তার প্রমাণ ইউরোপে নতুন করে ডানপন্থার নবজোয়ার। এসব এখন ইউরোপকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
ইউরোপের সাজানো বাগান আফ্রো-এশিয়ানদের রক্ত, হত্যা, অমানবিকতা ও অন্যের দেশ ধ্বংসের উপর নির্মিত। স্কুলের পাঠ্যবই থেকে এসবের সাক্ষ্য মুছে ফেলা হয়েছে বলে ইউরোপীয় শিশুরা আজ বেশ কিছু মিথ্যার ইতিহাসের মধ্যেই বড় হচ্ছে। তবে ইউরোপের প্রতিটি বড় শহরের গৌরবজনক রাজপ্রাসাদ সেসবের প্রমাণ বয়ে বেড়াচ্ছে। তা মোছা কীভাবে সম্ভব? তবুও কলোনিয়াল শোষণ কাঠামোর প্রাচ্যবাদী চর্চা পশ্চিমের মিডিয়া হেজিমনি (আধিপত্য)-তে আজও রয়ে গিয়েছে। আর তাই কাতার বিশ্বকাপ কভারেজে পশ্চিমের মিডিয়া হেজেমনির কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। পশ্চিমের দেশগুলি মনে করে ফুটবল, অলিম্পিকস এসব শুধু তাদেরই খেলা। বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকারও শুধু তারই। বিশ্বকাপের স্থান ও সময় হতে হবে তার কমফোর্ট জোনকে বিবেচনায় রেখেই। কিন্তু স্পোর্টস শো করে আফ্রো-এশিয়ার বিস্তৃত বাজার থেকে যে বিপুল অর্থ তোলে, তা নিয়ে কোনও চর্চাই করে না। যথাসম্ভব গোপন রাখতে চোখ বুজে থাকে।
কাতার বড় ফুটবল প্লেয়িং নেশন নয়। তাদের অভিজ্ঞতা কম। বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে সেখানে বহু শ্রমিক মারা গিয়েছেন—এসব কাতার অস্বীকার করেনি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কাতারের শ্রমনিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। তারাও জানিয়েছে, কাতারে উচ্চতাপে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বছরে ৫০ থেকে ৬০-এর কাছাকাছি। কিন্তু ইউরোপের মিডিয়া প্রচার করা শুরু করে, দশ বছরে কাতারে শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ হাজার। আর বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে বলা শুরু হয় সংখ্যাটা অন্তত ১৫ হাজার। ফলে ইউরোপে শুরু হয় বিশ্বকাপ বর্জনের ব্যাপক আন্দোলন। খোদ আইএলও বলছে, সৌদি আবরের আগে কাতার ‘কাফালা’ পদ্ধতি বন্ধ করেছে। শ্রমিকদের চাকরি পরিবর্তন ও দেশ ছাড়ার স্বাধীনতা দিয়েছে। শ্রমিকদের কর্ম নিরাপত্তা উন্নত করতে বেশ কিছু কাজ করেছে। ন্যূনতম মজুরি, আবাসন ট্রান্সপোর্টেশান দিয়েছে। অথচ, পশ্চিমের মিডিয়া বলছে, কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু আধুনিক শ্রমদাসত্বের এই কাফালা ব্যবস্থাও যে কলোনিয়াল লিগ্যাসি, সেটা পশ্চিমের মিডিয়া কখনও বলে না।
ঘৃণা ছড়ানো প্রোপাগান্ডায় পশ্চিমের ‘মিডিয়া হেজেমনি’ ও হীনমন্যতা প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। কাতারের পরিকাঠামোগুলি নির্মাণে যে পশ্চিমের কোম্পানিও যুক্ত, শ্রমিক নিরাপত্তার দায় যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সার্টিফায়েড পশ্চিম কোম্পানিরও— সেটা তারা বেমালুম চেপে গিয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি বাবদ এরই মধ্যে কাতার ৩০ হাজার কোটি ডলার খরচ করে ফেলেছে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন খরচ আরও বাড়বে। অথচ, ২০১৪ সালে ব্রাজিল, ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপ আয়োজন করতে খরচ করেছিল দেড় হাজার কোটি ডলার। কাতার যা খরচ করেছে, তা মূলত ব্যয় হয়েছে পরিকাঠামো নির্মাণে। যার বড় অংশই খরচ হয়েছে মেট্রো নেটওয়ার্ক তৈরিতে। যা বিশ্বকাপ শেষেও কাতারকে সমৃদ্ধ করবে। অথচ, বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের ইতিহাসে ঘাঁটলে দেখা যায়, এই ধরনের বড় আয়োজন মানেই ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’।
সুইজারল্যান্ডের লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৯৬৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের মতো ৩৬টি বড় আয়োজনের মধ্যে ৩১টি আয়োজন লাভের মুখ দেখেনি। গবেষণায় যে ১৪টি বিশ্বকাপের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার মধ্যে শুধু একটির আয়োজনই ছিল লাভজনক। ২০১৮ সালে রাশিয়ার ফুটবল বিশ্বকাপ। ওই বিশ্বকাপ থেকে রাশিয়া ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার মুনাফা করেছিল। এই মুনাফা আসে মূলত বিশ্বকাপের প্রচারস্বত্ব বিক্রি করে। তবে বিনিয়োগের বিপরীতে সেটা আবার খুব বেশি লাভজনক হয়নি। আসলে রাশিয়া ওই আয়োজন থেকে মুনাফা করেছিল মাত্র ৪.৬ শতাংশ। আর কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক কমিটির প্রধান নাসের আল খাতের জানিয়ে দিয়েছেন, এবারের বিশ্বকাপ থেকে আয় ৬০০ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। এটাই ফিফার হিসেব।
কাতার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লারবি সাদিকি সংবাদসংস্থা আল-জাজিরায় লিখেছেন, যখন মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসনাধীন ইতালিতে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে, আর্জেন্তিনার নৃশংস সামরিক শাসকের অধীনে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে, তখন পশ্চিমী মিডিয়ায় কোনও সমালোচনার ঝড় দেখা যায়নি। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনের সময় বিদেশিদের নজর থেকে দেশের দারিদ্র্য আড়াল করতে ব্রাজিলে বহু স্থানীয় গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। অথচ, কাতারের মতো তাদের কোনও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। ১৯৯৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে বিশ্বকাপের ফাইনাল আয়োজিত হয়েছিল। আমেরিকার ওই অঙ্গরাজ্যে মাত্র দুই বছর আগেই সবচেয়ে বড় বর্ণবাদী দাঙ্গা হয়েছিল। তা নিয়ে কেউ তো মুখ খোলেনি। কেউ তো বলেননি, ১৯৫৪ সালে দুর্বিষহ আবহাওয়ার মধ্যেই সুইজারল্যান্ডে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পশ্চিমের চোখে তারা বৈধ আয়োজক। আর কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনে সুযোগ পাওয়াকে পশ্চিমীরা বহিরাগত অভিজাতদের অবৈধ অনুপ্রবেশ হিসেবে দেখেছে।
কাতার বিশ্বকাপের আগে ব্রিটিশ মিডিয়ায় যত আলোচনা হয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশ আলোচনাই ছিল নেতিবাচক। পশ্চিমের দুনিয়ায় গৎবাঁধা ধারণা হিসেবে কাতারিদের ‘ধর্মান্ধ মুসলিম’ মনে করা হয়। তার জের ধরেই সম্প্রতি কাতারের জাতীয় ফুটবল দলকে ব্যঙ্গ করে প্যারিসে ইসলামবিদ্বেষী কার্টুন আঁকা হয়েছে। তাদের সেই ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করার এবং বহু সংস্কৃতির সঙ্গে সখ্য প্রদর্শনের আরেকটি সুযোগ কাতারের সামনে এনেছে এই বিশ্বকাপ। ইউরোপীয় মিডিয়া হেজেমনির মাথাব্যথা আসলে, একটি অ-ইউরোপীয় দেশের পরিকাঠামোর চোখধাঁধানো উন্নয়ন ঘটে যাওয়া। বিশাল বড় গ্লোবাল শো-র যোগ্যতা পশ্চিমের বাইরে চলে যাওয়া। সমস্যা ব্র্যান্ডিংয়ের। উন্নয়ন ও নির্মাণের নতুন সংজ্ঞাটিকে পশ্চিমের বাইরে নিয়ে আসাটাই আসলে প্রধান সমস্যা। ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজনে, পরিকাঠামো ডিজাইনে এবং এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাতার সযত্নে নিজেদের আরব ও ইসলামি সংস্কৃতি তুলে ধরেছে। বিশ্বখ্যাত স্থপতি জাহা হাদিদের অসম্ভব নকশার বাস্তবায়নের কৃতিত্ব দেখিয়েছে কাতার। পশ্চিমী মিডিয়া তাতে খুশি হবে কেন?
ইউরোপের সাবেক কলোনির একটা মুসলিম দেশ কাতার। ১৯১৬ থেকে ১৯৭১ সালে পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন। ব্রিটিশ পেট্রলিয়াম (বিপি) যে আদি কোম্পানি থেকে উদ্ভূত, সেই অ্যাংলো-পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি (এপিওসি) ১৯৩০–এর দশকের শেষের দিকে কাতারে তেল উৎপাদন শুরু করে। ১৯৪০–এর দশকে কাতারে শুরু হয় ফুটবল খেলা। উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রথম ঘাসের ফুটবল মাঠ ছিল দোহা স্টেডিয়াম। দেশটি স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর আগে সেখানে ১৯৬০ সালে লিগ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। মজার বিষয়, উত্তর-ঔপনিবেশিকতার গবেষণায় ফুটবল সম্পর্কে তেমন কিছুই বলা হয়নি। কাতার দ্রুত নিজের প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহারটা শিখে গিয়েছে। এই শিখে নেওয়াটা যদি এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাপক গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, তাতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি ইউরোপীয় অর্থনীতির। ইউরোপীয় পেশাদার লিগে খেলা সালাহ মানেদের মতো আরব দুনিয়ার ফুটবলারদের সাফল্যকে ইউরোপ তার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। নয়তো আঘাত নামবে বাজার অর্থনীতিতে। এটাই ইউরোপের সবচেয়ে ভয়ের কারণ।
প্রাচ্যতত্ত্ব বা ওরিয়েন্টালিজমের ভূত কিছুতেই ইউরোপের ঘাড় থেকে নামছে না!