বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
হয়েছে। তাই স্লোগান দেওয়া হয়েছিল শাইনিং ইন্ডিয়া। ২০০৪ সালে বিজেপির সামনে কোনও বিপক্ষই
ছিল না। রাহুল গান্ধী রাজনীতির প্রাঙ্গণেই নেই। সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস কিংবা বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলের শক্তিশালী জোট কিছুই সেরকম প্রভাবশালী নয়। অতএব ধরে নেওয়া হয়েছিল হাসতে হাসতে জয়ী হবেন বাজপেয়ি। ২০০৪ সাল ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে এক আশ্চর্য রহস্য। কারণ বাজপেয়ির এনডিএ যে ওভাবে পরাস্ত হতে পারে সেটা অকল্পনীয় ছিল।
২০২৪ সাল এখনও আসেনি। কিন্তু গতিপ্রকৃতি থেকে স্পষ্ট যে, ২০২৪ সালের বিজেপি (এনডিএ বলে কিছু তো আর নেই) অনেক বেশি আগ্রাসী ভাবে ঠিক ওই শাইনিং ইন্ডিয়ার ধাঁচেই প্রচার করবে যে, ভারত এখন প্রায় জগৎসভায় শ্রেষ্ট আসন নিতে চলেছে। অর্থাৎ নামে অমৃতকাল, আসলে শাইনিং ইন্ডিয়া টু। তবে অনেক বেশি হাই ভোল্টেজ। বিরোধী পক্ষ ছত্রভঙ্গ, বারংবার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মহাজোটের উদ্যোগ নেই। এই মুহূর্তে কেউ ভাবছেও না যে, নরেন্দ্র মোদির বিজেপি পরাস্ত হতে পারে। অতএব ধরেই নেওয়া যায় ২০০৪ সালের নির্বাচনপূর্ব চিত্রনাট্য উপস্থিত হয়েছে। এবার আমাদের আর দেড় বছর অপেক্ষা করতে হবে যে, ২০০৪ সালের মতোই কোনও অঘটন হয় কি না।
এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে কি না সেটি নয়। আমরা বরং লক্ষ করতে চাইছি, বিজেপির কতটা পরিবর্তন হয়ে গেল এই ২০ বছরে। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ আপাতভাবে বিজেপিকে সবথেকে বেশি শক্তিশালী করেছেন এখন। তাঁদের দুজনের যুগলবন্দিতেই আজ বিজেপি সর্বশক্তিমান। কিন্তু সত্যিই কি তাই? রাজ্যে রাজ্যে সরকার গঠন অথবা কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি একচ্ছত্র শাসকে পরিণত করার মধ্যে দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিজেপিকে সর্বশক্তিমান আইডেন্টিটি দিয়েছেন মোদি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উল্টো। বিজেপির একক আইডেন্টিটি একপ্রকার ধ্বংসই হয়ে যাচ্ছে। বিজেপি এখন মোদির দলে পরিণত হয়েছে।
বিজেপি প্রথম থেকেই ছিল কালেকটিভ লিডারশিপের দল। একজন নেতা-নেত্রীর অধীনে থাকা দল হতে চায়নি বিজেপি। তাদের নিজেদের প্রচারও ছিল সেটাই। চরম উত্থানের সময়ও বিজেপি কখনও আদবানির দল, বাজপেয়ির দলে পরিণত হয়নি। একঝাঁক নেতা-নেত্রী ছিলেন বিজেপির উত্থান, উন্নয়ন এবং সাফল্যের কারণ।
সেই বিজেপিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন মোদি। এতদিন মুখে বলতেন না। কিন্তু এখন একথা মোদি নিজেই ঘোষণা করে দিচ্ছেন! হিমাচল প্রদেশে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মোদি সম্প্রতি বলেছেন, এখানে পদ্মফুলে একটি করে ভোট পড়ার অর্থ সোজা সেটা দিল্লিতে মোদির অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে। তাই পদ্মফুলে ভোট দেওয়া মানে আমাকেই ভোট দেওয়া। এই যে মোদি এখন বলতে শুরু করলেন, ভোটে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার অর্থ তাঁকেই ভোট দেওয়া, এটাই বিজেপির পক্ষে সবথেকে বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কারণ, মোদির এটাই সম্ভবত শেষতম লোকসভা ভোট হতে চলেছে। ২০২৯ সালে তিনি নিশ্চয়ই প্রার্থী অথবা প্রধানমন্ত্রী হবেন না। কিন্তু তিনি নিজেকে যে লার্জার দ্যান পার্টিতে পরিণত করেছেন গত ৮ বছরে, তারপর তাঁর মাপকাঠিতে অন্য নেতা পাওয়া বিজেপির পক্ষে যেমন চরম সঙ্কট, তেমনই দলের অভ্যন্তরে আবার সেই গণতান্ত্রিক কাঠামো ফিরিয়ে আনাও কঠিন। দল নয়, অতিরিক্ত ব্যক্তিপুজো এবং মোদিভক্তির জেরে এখন যা কিছু বন্দনাগীতি সবই মোদিকে কেন্দ্র করে।
মোদি এবং অমিত শাহ সবথেকে বেশি ক্ষতি করেছেন সঙ্ঘ পরিবারের। একটি ধারণা রয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘই আসলে এখনও বিজেপির নিয়ন্ত্রক। মোদিকেও নিয়ন্ত্রণ করে তারা। তিনি যা কিছু করছেন, আরএসএসের অঙ্গুলিহেলনে করছেন। একথা সম্পূর্ণ ভুল। বরং বিপরীত। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্দেশকে নরেন্দ্র মোদি তোয়াক্কা করেন না। সঙ্ঘের এজেন্ডা মোদি রপায়ণ করছেন। এরকমই একটা কথা চালু আছে। একেবারেই ঠিক। কিন্তু ছয়ের দশক থেকে প্রচারকের কাজ করা মোদি নিজেই তো জানেন যে, কী কী এজেন্ডা পালন করতে হবে। ৩৭০ থেকে তিন তালাক। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি থেকে রামমন্দির। অবশেষে হিন্দুরাষ্ট্র। এসব জানা এজেন্ডা। একের পর এক সেগুলি রূপায়িত হচ্ছে। তাই খামোখা সঙ্ঘকে কেন কৃতিত্ব দেবেন তিনি? বরং তিনি চাইবেন এটাই প্রতিষ্ঠা পাক যে, এসব কিছু তিনি করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ এককভাবে সব তাঁর কৃতিত্ব। এটাই তো তাঁর ইতিহাস রচনার প্রধান লক্ষ্য। সেই কারণেই মোদি সঙ্ঘকে আসলে গুরুত্বহীন করে দিচ্ছেন। বরং এখন নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ব বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে তারা ভোটের আগে পরে মোদিকেই নানাভাবে সাহায্য করে চলেছে এবং মোদির কথায় সায় দিয়ে চলেছে।
সম্প্রতিকালে এমন কোনও উদাহরণ সামনে আসেনি যে, সঙ্ঘ বিজেপিকে পরিচালনা করছে। উল্টে ধীরে ধীরে সঙ্ঘের থেকে নির্বাচিত কোনও শক্তিশালী সংগঠক নেতাকে আর বিজেপির সিদ্ধান্তগ্রহণকারী টিমে দেখা যায় না। সাম্প্রতিক উদাহরণ হল, বিজেপি সংসদীয় বোর্ড থেকে যোগী আদিত্যনাথ, শিবরাজ সিং চৌহান এবং নীতিন গাদকারিকে বাদ দেওয়া। যোগী আদিত্যনাথকে বাদ দেওয়ার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেটি হল, মোদির পর যোগী প্রধানমন্ত্রী হতে ইচ্ছুক। কিন্তু সেটা মোদি এবং অমিত শাহ চাইছেন না। অতএব তাঁর ডানা ছাঁটা হল। কিন্তু শিবরাজ সিং চৌহান এবং নীতিন গাদকারি সরাসরি সঙ্ঘের প্রিয়পাত্র। তাঁদের সঙ্ঘঘনিষ্ঠতাই কি তাঁদের ছেঁটে ফেলার কারণ নয়?
মোদির পর ২০১৪ সালের পর থেকে বিজেপিতে আর একজনও শক্তিশালী নেতার আবির্ভাব ঘটছে না যিনি সরাসরি সঙ্ঘের মাধ্যমে এসেছেন। বরং একের পর এক সঙ্ঘের নেতারা এসেছেন এবং গুরুত্বহীন হয়ে চলে গিয়েছেন। সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠ জগৎপ্রকাশ নাড্ডা নিছক মোদি ও শাহের অনুগামী। তিনি নিজেকে কখনও একক শক্তিশালী ভাবেনই না। সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোদি। আর সুপার সভাপতি অমিত শাহ। মোদি কোনও লিডারশিপ তৈরি করছেন না। বরং কখন কে গুরুত্বহীন ও ছাঁটাই হয়ে যাবে, কেউ জানে না। এই ফর্মুলাই চলছে ৮ বছর ধরে। আবার রাজ্যে রাজ্যে আগে ছিল বিজেপির একাধিক প্রভাবশালী নেতা। এখন আর নেই। মোদিকে মুখ করেই সব ভোটের প্রচার হয়।
সঙ্ঘ সংরক্ষণ ব্যাপারটাই পছন্দ করে না। মোদি নতুন করে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ করলেন গরিব উচ্চবর্ণের জন্য। সঙ্ঘ বেসরকারিকরণ পছন্দ করে না। মোদি সরকার ঢালাও বেসরকারিকরণের মন্ত্র নিয়েছে। সঙ্ঘ চায় বিজেপিতে সঙ্ঘ থেকে প্রশিক্ষিত নেতারা যাবে এবং বিজেপির স্তম্ভ হবে। মোদি এবং অমিত শাহ অন্য যে কোনও দল থেকে দলে দলে নেতাদের ভাঙিয়ে এনে বড়সড় পদ দিয়েছেন বিজেপিতে। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির মুখ এখন অন্য দল থেকে আসারাই। সুতরাং সঙ্ঘচালিত নয়। বরং মোদির বিজেপি সঙ্ঘের নির্দেশে আর চলেই না। বিজেপিকে স্বাধীন সত্তা দিতে চাইছেন মোদি। কিন্তু আর সাত আট বছরের মধ্যে তাঁকে বয়সোচিত কারণে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সক্রিয়তা থেকে কিছুটা স্তিমিত হতেই হবে। তখন কিন্তু একটি দুর্বল বিজেপি আত্মপ্রকাশ করবে। একসঙ্গে অনেক নেতা সুপার লিডার হতে চাইবেন। তাঁরা শুধু অপেক্ষা করছেন সুযোগ আসার। ১৯৯১ সালের পর থেকে শক্তিশালী নেতার অভাবে বারংবার ভেঙেছে কংগ্রেস। সেই দুর্বলতা আজও কাটেনি। বিজেপিরও কি অদূর ভবিষ্যতের পরিণতি হতে চলেছে সেরকমই?
অর্থাৎ দল ভেঙে যাওয়া কিংবা ভোটব্যাঙ্ক ছিনতাই। আবার বিজেপির পরিত্রাতা হবে কি জোট রাজনীতিই? ব্যাক টু বাজপেয়ি?