ধনাগম যোগটি অনুকূল। দুপুর থেকে কর্মের বাধা মুক্তি ও উন্নতি। শরীর-স্বাস্থ্য সমস্যার যোগ। ... বিশদ
সম্প্রতি এক ইংরেজি পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেছেন, ‘‘যাঁরা ইতিহাস পড়েন, যাঁরা ইতিহাস পড়ান আর যাঁরা স্মৃতি গড়ে তোলেন— সিস্টেম তাঁদের নিয়ে তৈরি। তাঁদের মধ্যে এমন লোক আছেন, যাঁরা আমাদের জানা অতীতের সমস্ত দিক বিচার করে দেখেন। কিন্তু আরও এক ধরনের লোকও আছেন, যাঁদের ইতিহাস পাঠ একেবারেই অগভীর। তাঁরা নিজেদের এজেন্ডা অনুযায়ী ইতিহাসকে সাজিয়ে নেওয়ার জন্য অতীতের সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে বেছে বেছে দৃষ্টান্ত তুলে আনেন। এই ধরনের লোকেদের জন্য মোগল যুগের ইতিহাস শুরু হয় ১৬৬৯ সালে। ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস দিয়ে। তার আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই। তাঁরা কখনও বলবেন না, আকবর এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের উদ্দেশ্য একটা মুসলিমবিরোধী আবহাওয়া তৈরি করা। আর হিন্দুদের আবেগকে ব্যবহার করে ভোট আদায় করা। এ দেশে চার-পাঁচশো বছর আগে ছিল বাদশাহি বা রাজতন্ত্র। তার মানেই তো একনায়কতন্ত্র। এখন আমরা গণতন্ত্রের যুগে, আইনের শাসনের যুগে বাস করছি। শাসককে সংবিধান মেনে চলতেই হবে। এরা ক্ষমতায় এসেছে লোকে ভোট দিয়েছে বলেই। কিন্তু আজকের শাসকদের কাজকর্ম রাজতান্ত্রিক শাসনকেই মনে করাচ্ছে। সংবিধানকে পিষে ফেলতেই এরা মুসলিমবিরোধী আবহাওয়া তৈরি করছে।’’
এখানেই থামেননি রাজেন্দ্রপ্রসাদ তিওয়ারি। বলেছেন, ‘‘বিশ্বনাথের শিবলিঙ্গ হল স্বয়ম্ভূ। এই শিবলিঙ্গ স্মরণাতীত কাল থেকে এখানেই রয়েছে। সুতরাং বিশ্বনাথের গুরুত্ব চিরকালই ছিল। কিন্তু আকবরই প্রথম লোক যিনি ওই শিবলিঙ্গের গৃহ হিসেবে একটা বড়সড় মন্দির তৈরি করিয়ে দেন। ফলে সেই মন্দির ঐতিহাসিক আর সেই মন্দিরই ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করেন। শাহজাহানের বড় ছেলে দারাশিকো, যাঁকে আকবরের যোগ্য উত্তরাধিকারী মনে করা হতো, তিনি বারাণসীতে এসেছিলেন সংস্কৃত আর প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্র ইত্যাদি পড়তে। দারাকে যাঁরা পড়িয়েছিলেন সেই পরিবারের সদস্যরা এখনও বারাণসীতেই থাকেন। প্রয়াত কংগ্রেস নেতা কমলাপতি ত্রিপাঠীর এক পূর্বপুরুষ দারাশিকোর গুরু ছিলেন। গুরুদক্ষিণা হিসেবে দারা নিজের একটা কোঠি ত্রিপাঠী পরিবারকে দান করেন। সেটা বারাণসীর ঔরঙ্গাবাদ এলাকায়।’’
দারাশিকো রাজেন্দ্রপ্রসাদের পরিবারকেও যে পাট্টা দিয়েছিলেন সেটা কিন্তু এখনও তাঁর কাছে রয়েছে। এই পাট্টার মাধ্যমে দারাশিকো বিশ্বনাথ মন্দিরের দায়িত্ব তাঁদের পূর্বপুরুষদের হাতে তুলে দেন। পাট্টায় লেখা রয়েছে, রাজেন্দ্রপ্রসাদরা শৈব সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজন। তাই এই মন্দির এবং এর আচার অনুষ্ঠানের ধারা তাঁদের হাতে নিরাপদ। সিংহাসনে বসার পর দারার সঙ্গে যাঁদের সুসম্পর্ক ছিল বলে ঔরঙ্গজেবের মনে হয়েছিল, তাঁদের সকলের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনেন। ঔরঙ্গজেব মনে করতেন, দারার পছন্দের সবাই ওঁর প্রতিপক্ষ। বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করার কারণও এটাই।
রাজেন্দ্রপ্রসাদের কথায়, তাঁদের পরিবারের ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি ছিল না। তাঁরা যখন বুঝতে পারেন, মন্দিরটা ভেঙে ফেলা হবে, তখন তাঁর পূর্বপুরুষরা শিবলিঙ্গটা তুলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখেন। এখনকার বিশ্বনাথ মন্দিরে যে শিবলিঙ্গ রয়েছে সেটা তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত করা সেই শিবলিঙ্গই। তাঁরা ঠিক যেখানে বসিয়েছিলেন সেখানেই রয়েছে। শিবলিঙ্গটা রাজেন্দ্রপ্রসাদের বাড়িতে লুকিয়ে রাখা ছিল। কেউ জানত না। ফলে মুখে মুখে রটেছিল, ধ্বংস হওয়া মন্দিরের মহন্ত শিবলিঙ্গ নিয়ে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছেন। বারাণসীর লোককথার অঙ্গ হয়ে গিয়েছে সেই গল্প। কিন্তু আসলে তেমন কিছুই ঘটেনি। ১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর রাজেন্দ্রপ্রসাদের পরিবার জানায় শিবলিঙ্গ কোথায় রয়েছে।
রাজেন্দ্রপ্রসাদ জানাচ্ছেন, ‘‘ঔরঙ্গজেব জঙ্গমবাদী মঠকে চার-পাঁচ বিঘা জমি দিয়েছিলেন আর রাজকোষ থেকে কিছু টাকাও দিয়েছিলেন। যাতে লিঙ্গায়তরা শিবপুজো এবং সংস্কৃত পুঁথির পাঠ চালিয়ে যেতে পারে। ঔরঙ্গজেবের দেওয়া সেই পাট্টা এখনও জঙ্গমবাদী মঠে আছে। ২০১৮ কিংবা ’১৯ সাল নাগাদ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ওই মঠে গিয়েছিলেন। মঠের লোকেরা আমাকে বলেছে, উনি ওই পাট্টাটা ওখান থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইছিলেন। কিন্তু ওই পাট্টা তো ঐতিহাসিক নথি। আদিত্যনাথ চান বলেই ইতিহাস থেকে কিংবা আমাদের স্মৃতি থেকে ওটা মুছে ফেলা যায় না। এই ঘটনাটাই প্রমাণ করে আসলে যা যা করা হচ্ছে সবই একটা নির্দিষ্ট বয়ান তৈরি করার স্বার্থে করা হচ্ছে। ইতিহাস ঔরঙ্গজেবকে একজন একনায়ক, অত্যাচারী রাজা হিসেবে দেখিয়েছে। সেটা করা খুব সহজও বটে। এটা তো ঠিকই যে উনি নিজের ভাইদের খুন করেছিলেন আর বাবাকে কারাগারে ঢুকিয়েছিলেন। বিশ্বনাথ মন্দির তাঁর আমলেই ধ্বংস করা হয়েছিল। ঔরঙ্গজেবের সেই প্রচলিত ভাবমূর্তির সঙ্গে মন্দির ধ্বংসের ঘটনাকে জুড়ে তাঁকে আক্রমণ করার মধ্যে দিয়ে বিজেপি-আরএসএস ভারতের মুসলিমদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনতে চায়। হিন্দুত্ব এজেন্ডা সফল করার জন্য ঔরঙ্গজেবকে দানব বানানো ওদের ড্রিম প্রোজেক্ট।’’
আরএসএস-বিজেপি ও হিন্দুধর্মকে সমার্থক হিসেবে দেখাতে স্বভাবতই নাগপুরের আগ্রহ থাকবে। কিন্তু, মনে রাখা প্রয়োজন, নাগপুর যার বেসাতি করে, তার নাম হিন্দুত্ব— বিংশ শতকের প্রথমার্ধে মূলত মুসলিম-বিরোধিতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক অবস্থান। এটাও বলা প্রয়োজন, আরএসএস-বিজেপির চালিকাশক্তিটি হিন্দুধর্ম নয়, হিন্দুত্ব। সেই রাজনৈতিক দর্শন চরিত্রগত ভাবে বিভেদকামী, ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সঙ্গে তার বিরোধ গোড়াতেই। অতএব, যে কোনও উদারবাদী রাজনীতিই সেই সঙ্কীর্ণতার সঙ্গে নিজেদের স্পষ্ট তফাত বজায় রাখতে চাইবে। আরএসএস ও বিজেপি যে দেশের সব হিন্দুর প্রতিনিধিত্ব করে না, হিন্দুধর্মের বহুবিধ রূপের মধ্যে মাত্র একটি— তা-ও সবিশেষ ভাবে রাজনৈতিক, কৃত্রিম ও বিদ্বিষ্ট রূপের— বিজ্ঞাপন করে, তা নিয়ে সংশয় নেই। মন্দির রাজনীতি সেই রাজনৈতিক কার্যক্রম। তার সঙ্গে ভারতাত্মার কোনও সম্পর্ক নেই, সামগ্রিকভাবে হিন্দুধর্মেরও নয়।
যেমন বলছেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। বলছেন, ‘‘ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে বারাণসীতে একটা মন্দির ভাঙা হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা নিশ্চয়ই একমত হবেন, ঔরঙ্গজেব সশরীরে এসে মন্দিরটা ধ্বংস করে গিয়েছিলেন এরকম সম্ভাবনা কম। তবুও ওই ধ্বংসের দায়িত্ব তাঁর ঘাড়েই চেপেছে। একইভাবে বিশ্বনাথ করিডোর তৈরি করতেও প্রচুর প্রাচীন মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। এই ধ্বংসের দায়িত্বও মোদির ঘাড়ে চাপা উচিত। প্রায় ২৮৬টা শিবলিঙ্গ উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটা তো নর্দমায় ফেলা হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ১৪৬টা শিবলিঙ্গ উদ্ধার করা গিয়েছে। আমি ঔরঙ্গজেবের বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করা দেখিনি। কিন্তু আমি মোদির দলবলকে হিন্দুদের আবেগের তোয়াক্কা না করে ঐতিহাসিক মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গকে অসম্মান করতে দেখেছি। মোদি কোনও হিন্দুই নয়। হিন্দুত্ববাদ স্রেফ ওঁর আর ওঁর পার্টির ব্যবসা। সোজাসুজি বলছি, মোদি ঔরঙ্গজেবের চেয়ে বেশি মন্দির ধ্বংস করেছেন। ১৪৬টা শিবলিঙ্গ এখন বারাণসীর লঙ্কা থানায় আছে। থানাতেই রোজ পুজো হয়। ...আমি উন্নয়নের বিরোধী নই। উন্নয়নের নামে যে ভাঙচুর চালানো হয়েছে তার বিরোধী। বিশ্বনাথ করিডোর বারাণসীর প্রাচীন পরিচয়টাই নষ্ট করে দিয়েছে এবং যাকে এই শহরের আধ্যাত্মিক-ধার্মিক পরিকাঠামো বলা যায় সেটাও ধ্বংস করে দিয়েছে।’’
রাজেন্দ্রপ্রসাদ মনে করেন, ‘‘...ইতিহাস থেকে আপনি শুধু শিক্ষা নিতে পারেন। সেটা ভালো শিক্ষা, মন্দ শিক্ষা— যা-ই হোক। যারা ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার করতে চায় তারা নতুন ইতিহাস লিখতে পারে না। তারা শুধু আগুনে ঘি ঢালে। সমাজে বিষ ছড়ায়। আপনি যদি ঔরঙ্গজেবের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন তাহলে তাঁর থেকে উন্নত কিছু করতে পারবেন না। একটা ৩০০-৪০০ বছরের পুরনো ইস্যুকে খুঁচিয়ে তুলে লাভ কী? তাহলে সমাজের কী হবে ভাবুন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে কোনও দেশ উন্নতি করতে পারে না।’’ কিন্তু রাজেন্দ্রপ্রসাদদের পরামর্শ শুনলে তো হিন্দুত্ববাদীদের বছরের পর বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না!
ফলে মোদি বিরোধী কথা বলার খেসারত দিতে হয়েছে বিশ্বনাথ মন্দিরের মহন্তকেই। প্রচণ্ড চাপ তো ছিলই। প্রশাসন তাঁর বাড়ির চারদিকে গর্ত খুঁড়ে দিয়েছিল। রাজেন্দ্রপ্রসাদকে বাড়ি বেচে দিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে বলেছিল। অথচ, সেই বাড়ি কিন্তু করিডোরের মধ্যে পড়েনি, তবুও। শেষ পর্যন্ত বাড়িটাই ভেঙে দেয়। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের মহন্ত বলেন, ‘‘মিডিয়া তো বিজেপির পকেটে। মিডিয়াটা ওদেরই। এই মিডিয়া কখনও বিজেপিকে কোনও প্রশ্নের মুখে ফেলে? মোদি সরকার মিথ্যে কথা বললেও মিডিয়া সেটাকেই সত্যি বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।’’
হিন্দুত্বের ইতিহাস, ইতিহাসে হিন্দুত্ব। দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমে ক্রমে যা বিকশিত আর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এর মূল লক্ষ্যটাই ছিল— শেষ পর্যন্ত একটি ‘রাজনীতি’ তৈরি করা। নরেন্দ্র মোদির ভারতে এসে ওই প্রকল্প একটি সামগ্রিক সাফল্য খুঁজে পেয়েছে। গোটা দেশে ছড়ানো আরএসএস-পোষিত বিদ্যালয়গুলি একদিকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনা করেছে নিজেদের এজেন্ডায়, অন্যদিকে খুব সন্তর্পণে প্রতিষ্ঠা করেছে এই বিশ্বাস যে, ইতিহাসের মাত্র ‘একটিই’ ভাষ্য হতে পারে, জাতীয়তাবাদের— বাকি সব ঝুট হ্যায়! এবং, অবশ্যই, আরএসএস ভাষ্যই সেই ‘এক এবং অদ্বিতীয়’ ভাষ্য, বাকি সব নির্মূল করতে হবে।
প্রয়োজনে বিশ্বনাথ মন্দিরের মহন্ত রাজেন্দ্রপ্রসাদদেরও। চিরন্তন উদার হিন্দুধর্মের ধার্মিকদেরও রেহাই নেই!