গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
গোয়েন্দাদের রিপোর্ট, শুধু ২০১০ সালেই ৩২০০ কোটির বেশি মূল্যের জাল নোট ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। পাক গোয়েন্দা শাখা আইএসআই চাইছিল, ভারতের অর্থনীতি তছনছ করে দিতে। খোলা বর্ডারের সুযোগ নিয়ে নেপাল হয়ে উঠেছিল আইএসআইয়ের জাল নোট প্রবাহের কেন্দ্রস্থল। সিবিআই তদন্তে জানা যায়, এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বিহারের চম্পারন জেলার ছয় মহিলা এবং নেপালের চারজন। যাদের কাজ ছিল, দু’টি রুট দিয়ে নেপাল থেকে সরাসরি উত্তরপ্রদেশে এবং নেপাল থেকে বিহার হয়ে জাল নোট পাচার করা। যে যত পরিমাণ পাচার করতে পারবে, তার উপর ২ শতাংশ কমিশন। সেই সময় উত্তরপ্রদেশের সিদ্ধার্থনগর এবং মহারাজগঞ্জ রুট হয়ে উঠেছিল নোট পাচারের সেফ প্যাসেজ। রাজস্থান এবং পাঞ্জাব সীমান্তও হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানি এজেন্টদের করিডোর। আইএসআই ‘সন্ত্রাসের মুদ্রা’ পাচারের নেটওয়ার্ক তুলে দিয়েছিল দাউদ ইব্রাহিমের ক্রাইম সিন্ডিকেট ডি-কোম্পানির হাতে। দুবাই থেকে ডি-কোম্পানির জাল নোট পাচারের কাজ দেখাশোনা করত দুই শাকরেদ— আফতাব ভক্তি এবং বাবু গাইথান। আকাশপথ, জলপথ, রেলপথ, স্থলপথ— সব রুট ধরে ভারতের মাটিতে আছড়ে পড়েছিল জাল নোট। সেই সময় সিবিআই, র-সহ দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি একযোগে জানিয়েছিল, প্রতি ৪টি ১০০০ টাকার নোটের মধ্যে একটি জাল!
বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্তাদের জেরা করে সিবিআই জানতে পারে, ফেক নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকেও ঢুকেছে। খবরের সত্যতা যাচাইয়ের পর সিবিআই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভল্ট রেড করে। সবাইকে চমকে
দিয়ে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভল্টে বিপুল পরিমাণ জাল ৫০০ও ১০০০ টাকার নোট পাওয়া যায়। মাথায় হাত গোয়েন্দাদের! ঠিক একই কোয়ালিটির জাল টাকা তো আইএসআই বিভিন্ন রুটে ভারতের বাজারে ঢুকিয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বিপুল পরিমাণ ফেক ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভল্টে ঢুকল কী করে?
সিবিআই তদন্তের রিপোর্ট যায় সংসদীয় কমিটির হাতে। কমিটি অব পাবলিক আন্ডারটেকিং (সিওপিইউ) আবিষ্কার করে, দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বকে চূড়ান্ত অবহেলা করে ভারত সরকার ১৯৯৭-৯৮ সালে ১ লক্ষ কোটি টাকার ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট ছাপার কাজ আউটসোর্সিং
করেছে জার্মানি, আমেরিকা এবং ব্রিটেনের তিনটি কোম্পানির কাছে। যে তিনটি কোম্পানিকে এই টাকা ছাপার অধিকার দেওয়া হয়েছিল তারা হল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকান ব্যাঙ্কনোট কোম্পানি’, ব্রিটেনের ‘টমাস দে-লা-রু’ এবং জার্মানির ‘গিসেক ডেভরিয়েন্ট কনসোর্টিয়াম’।
আরবিআইয়ের গভর্নর তখন বিমল জালান। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভল্টে ফেক কারেন্সি উদ্ধার এবং সংসদীয় কমিটির রিপোর্টের তদন্তে আরবিআইয়ের অফিসারদের টিম পাঠানো হয় ব্রিটেনের টমাস দে-লা-রু’র হ্যাম্পশায়ারের ছাপাখানায়। তখন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি পেপার, নোট ছাপার কাগজের ৯৫ শতাংশ সাপ্লাই করত এই কোম্পানি। টমাস দে-লা-রু কোম্পানির লাভের এক তৃতীয়াংশ আসত ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নোট ছাপার কাগজ বেচে আর কিছুটা নোট ছেপে। প্রমাণ মেলে, একই কাগজ পাকিস্তান ফেক কারেন্সি ছাপাতেও ব্যবহার করছে। এই হাই সিকিউরিটি পেপার পাকিস্তানের হাতে গেল কী করে?
অভিযোগ অস্বীকার করলেও টমাস দে-লা-রু কোম্পানিকে তৎকালীন ইউপিএ সরকার ব্ল্যাক লিস্টেড করতে বাধ্য হয়। ২০১০-এর ১২ আগস্ট টমাস দে-লা-রু কোম্পানির সিইও জেমস পি হ্যাসি রহস্যজনকভাবে পদত্যাগ করেন। কোম্পানির শেয়ার তলানিতে এসে ঠেকে এবং অন্যতম প্রধান কাস্টমার আরবিআইকে হারিয়ে কোম্পানি প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছয়। এই সময়ে টমাস দে-লা-রু’র প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসি কোম্পানি ওবার্থুর টেকনোলজিস সমস্ত দেনা সমেত গোটা কোম্পানিকে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেও দে-লা-রু বিভিন্ন উপায়ে নিজেদের মালিকানা কোনওরকমে টিকিয়ে রাখে। ২০১৫ সালে ভারত সরকার জানতে পারে, জার্মানির লুইসেনথাল পাকিস্তানকে ব্যাঙ্ক নোটের কাগজ সরবরাহ করে। এই সত্য আবিষ্কারের পরে ২০১৫ সাল থেকে ভারত সরকারকে ব্যাঙ্ক নোটের কাগজ সরবরাহকারী হিসেবে জার্মানির লুইসেনথাল পেপার মিলের নাম বাদ যায়।
কারেন্সি ব্যবসায় বিশ্বের মাত্র ডজন খানেক কোম্পানির মৌরুসিপাট্টা। এদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ব্যবসা করছে। ভারতে কালো তালিকায় থাকা ‘দে-লা-রু’ প্রায় দু’শো বছরের পুরনো। দে-লা-রু একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্রাউন এজেন্ট ছিল। ক্রাউন এজেন্ট কারা? যারা স্ট্যাম্প, কোর্ট পেপার থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক নোট পর্যন্ত ছাপত। টেকনিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অর্থনৈতিক সার্ভিস সরবরাহ করত। বিভিন্ন কলোনির প্রাইভেট ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ, অস্ত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর মাইনে দেওয়ারও ব্যবস্থা করত। এক কথায় ক্রাউন এজেন্ট গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং তার সমস্ত কলোনির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করত। আজও তারা ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের নোট ছাপে। কেনিয়া, মাল্টা এবং শ্রীলঙ্কার মতো ১৪০টি দেশের সঙ্গে এরা যুক্ত।
১৮৮৪ সাল পর্যন্ত কোনও ব্রিটিশ কলোনিকে নোট ছাপার অধিকার দেওয়া হয়নি। কলোনিগুলি তাদের স্থানীয় নোট সরকার নির্দিষ্ট এজেন্টদের কাছ থেকে সংগ্রহ করত। আর এজেন্টরা এই নোট পেত সাম্রাজ্যের ক্রাউন এজেন্ট দে-লা-রু’র ছাপাখানা থেকে। ১৯২৮ সালে নাসিকে নোট ছাপার প্রথম কারখানা গড়ে ভারত সরকার। ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সমস্ত টাকা ছাপার মেশিন এবং টেকনোলজি সরবরাহকারী ছিল দে-লা-রু কোম্পানিই। ১৯৬৫ সাল থেকে যার মালিক ইতালির গিওরি পরিবার।
১৯৯৯-র ২৪ ডিসেম্বর যে ভারতীয় বিমান হাইজ্যাক হয়েছিল, সেই বিমানেই ছিলেন রবার্টো গিওরি। বিশ্বের কারেন্সি প্রিন্টিং ব্যবসার কিং। সেই রবার্টোর মুক্তির জন্য সুইজারল্যান্ড সহ বিশ্বের বিভিন্ন লবি ভারত সরকারকে চাপ দিতে থাকে। ঘটনার সাতদিন পরে ভারত সরকার অপহরণকারীদের দাবি মেনে নেয়। মাসুদ আজহার সহ তিন সন্ত্রাসবাদীকে মুক্তি দিতে হয়। রবার্টোর মুক্তিপণ হিসেবে সেদিন
কত কোটি টাকা ভারত সরকার দিয়েছিল, তা
আজও রহস্য...।
ভারতের মাটিতে রবার্টোর কারবার ২০১০ সাল পর্যন্ত বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু নেপাল-ভারত সীমান্তে সিবিআই রেড সব তালগোল পাকিয়ে দিয়েছিল। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কেউটে! ভারত সরকার জানতে পেরেছিল, বিদেশি কোম্পানিগুলির হাত ধরে নোট ছাপানোর কাগজ, কালি সব পৌঁছে গিয়েছে পাক গোয়েন্দাসংস্থা আইএসআইয়ের কাছে। সেটা ছিল গভীর চক্রান্ত। যার খেসারত আজও গুনতে হচ্ছে ভারতকে। আরবিআই জানিয়েছে, ২০২১-২২ সালে দেশে মোট জাল নোট মিলেছে ২,৩০,৯৭১টি। যা তার আগের বছরে ছিল ২,০৮,৬২৫টি। এর মধ্যে ২০০০ টাকার জাল নোট ধরা পড়েছে ১৩,৬০৪টি। সব থেকে বেশি জাল হচ্ছে ১০০ টাকার নোট। তবে ২০২০-২১ সালের ১,১০,৭৩৬টির চেয়ে তা কমে হয়েছে ৯২,২৩৭টি। আর ৫০০ টাকার নতুন নোটের ক্ষেত্রে তা ২০২০-২১ সালের ৩৯,৪৫৩টির থেকে গত বছরে এক ধাক্কায় পৌঁছে গিয়েছে ৭৯,৬৬৯টিতে।
প্রশ্ন হল, এই ব্ল্যাক লিস্টেড দে-লা-রু’র সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক কী? নোটবন্দির সময় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ‘আপ’ অভিযোগ তুলেছিল, দে-লা-রু কোম্পানিকে আবার নতুন ২০০০ ও ৫০০ টাকা ছাপানোর বরাত দেওয়া হয়েছে। শোরগোল শুরু করেছিল কংগ্রেসও। যদিও অর্থমন্ত্রক জানিয়ে দেয়, দে-লা-রু ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্যাঙ্ক নোটের জন্য কাগজ সরবরাহ করেছে। ২০১৩ সালে নেওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কোম্পানিটিকে ২০১৫-র ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাঙ্ক নোটের সুরক্ষা সংক্রান্ত সামগ্রী সরবরাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এরপর দে-লা-রু’র সঙ্গে আর কোনও চুক্তি হয়নি। এই কোম্পানি ভারতে একটি ফ্যাক্টরি খোলার অনুমতি চেয়েছিল। সেই আবেদনও এখনও টেবিলে পড়ে রয়েছে। দে-লা-রু অবশ্য মনে করে, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ ভিত্তিহীন।
২০১৩-১৫ সাল পর্যন্ত দে-লা-রু’র বার্ষিক রিপোর্টে ভারতের সঙ্গে কোনও লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে দে-লা-রু ক্যাস প্রসেসিং সলিউশানস ইন্ডিয়া প্রাইভেটের ভারতের কাজকর্মের উল্লেখ রয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে, দে-লা-রুয়ের শীর্ষকর্তা মার্টিন সাদারল্যান্ড বলেছিলেন, দিল্লিতে তাঁরা অফিস খুলেছেন। তাঁদের কোম্পানি ভারতের শিল্প নীতি ও প্রচার বিভাগ (ডিআইপিপি)-এর সঙ্গে যুক্ত। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-য় তাদেরও ভূমিকা রয়েছে। এর প্রমাণ, ২০১৬-র ১১ এপ্রিলের পর দে-লা-রুয়ের শেয়ারের মূল্য ৩৩.৩৩ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। সেই বছর ভারত-ব্রিটেন টেক সামিটে প্ল্যাটিনাম পার্টনারও ছিল এই কোম্পানি। দে-লা-রু ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইট খুললেই ভারতের মাটিতে তাদের অস্তিত্ব টের পাবেন। যে কোম্পানির বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ রয়েছে, সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নোট ছাপানোর কাগজ তুলে দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে চুরমার
করে দিতে চেয়েছিল, সেই দে-লা-রু ভারতের মাটিতে বহাল তবিয়তে ব্যবসা করে কী করে? এই প্রশ্ন তোলা কি অন্যায়?