পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি। ... বিশদ
এই যে মোদির নতজানু হওয়া, তার উৎস কিন্তু অনুতাপ বা অনুশোচনা ছিল না। তা ছিল সম্পূর্ণই রাজনৈতিক। তাই যেন পাকা অভিনেতার নাটুকে আবেগ অনেকটাই লেগেছিল তাঁর স্বরে। আসলে তখন ভোট এসে দুয়ারে ধাক্কা দিচ্ছিল। তাই তাঁকে ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীর মতো ‘অনুতাপ পীড়িত’ সেজে আসরে নামতে হয়েছিল। মূল আন্দোলনকারী চাষিরা ছিলেন পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশের। এর মধ্যে যে দুই রাজ্যে ভোট এসে গিয়েছিল, সে দু’টি হল উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাব। তাই তাঁকে তড়িঘড়ি কৃষিবিল গুটিয়ে নিয়ে মুখরক্ষার চেষ্টা করতে হয়েছিল। জানতেন, এই ছদ্ম-সজ্জাটুকু ধারণ না করলে ভোট বাক্সে ঢাক, ঢোল দুইই ফাঁসবে।
সেই ঘটনার বর্ষ অতিক্রান্ত। সেদিন মোদিকে বিশ্বাস করে কৃষকরা তাঁদের জয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন। এই এক বছরে কিন্তু তাঁদের ভুল ভেঙেছে। বুঝতে পারছেন, সবটাই ছিল একটা ড্রামা। ওই নাটকের মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে বিলটিকে হিমঘরে পাঠানো হলেও সুযোগ পেলেই ফের বিলটিকে ঝুলি থেকে বের করা হবে। কেননা বিজেপি সরকার বৃহত্তর শিল্পপতিদের কাছে এনিয়ে দায়বদ্ধ। বৃহত্তর শিল্পপতিদের তুষ্টি মানেই বিজেপির তহবিল রসেবশে থাকা। আর তহবিল রসেবশে না থাকলে বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের কাজে তা ব্যবহারও করা যাবে না। প্রয়োজনে অন্য দলের বিধায়ক ভেঙে সরকার গড়ার নিত্য খেলাও সম্ভব হবে না।
তবে কৃষকরা বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি সরকার বুনো ওল হলে, তাঁরাও কিন্তু বাঘা তেঁতুল। গত এক বছরে প্রধানমন্ত্রী যে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি, তা কৃষকরা কিন্তু ভোলেননি। তাঁদের ফসলের সহায়ক মূল্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছুই করেননি। মোদি অবশ্য সহায়ক মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি ‘সাজানো’ কমিটি করেছেন। তবে হাস্যকর ব্যাপার হল, সেই কমিটিতে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে কোনও প্রতিনিধি নেই। তাই কৃষক নেতারা এই কমিটিকে ইতিমধ্যেই অস্বীকার করেছেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী ২৬ নভেম্বর সহায়ক মূল্য ঘোষণার দাবিতে রাজভবনের দিকে যাত্রা করবেন। মোদির নীরবতাই যে তাঁদের পুনরায় আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এ নিয়ে সন্দেহের কোনও কারণ নেই।
শুধু তো কৃষিবিল নয়, শাসন ব্যবস্থার সার্বিক ক্ষেত্রে এই ডামাডোল চলছে। প্রতিদিন আমরা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে চলেছি। ক্রমে ক্রমে ভারতীয় অর্থনীতির দম সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, দেশে রিসেশন বা মন্দা অর্থনীতির অশুভ ছায়া ঘনিয়ে আসছে। আসলে মন্দা অর্থনীতি তো চলছেই। তাই মন্দা অর্থনীতি বললে ঠিক রিসেশন ব্যাপারটা বোঝানো যায় না। একে নাটকের ভাষায় বলা যেতে পারে ‘দেশের আর্থিক অবস্থার পতন ও মূর্চ্ছা।’
দেশের অর্থনীতি নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এতদিন যেন মোদির তালেই তাল দিয়ে আসছিল। ইদানীং তারা বুঝেছে, আর বুঝি তালে তাল ঠোকা সম্ভব নয়। তাই মাঝেমাঝেই দেশের অর্থনীতি নিয়ে তারা কিছুটা বেসুরো গাইতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে দেশে রিসেশন আসার নানা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা অবশ্যই বলা যায়, করোনা পর্বের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ সারা বিশ্বের অর্থনীতিতেই কমবেশি প্রভাব ফেলেছে। যে দেশের অর্থনীতির বনিয়াদ শক্ত এবং ক্ষমতায় থাকা দল সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, তাদের অর্থনীতির ভাঙন অল্প। কিন্তু যে দেশের শাসক দলের সিদ্ধান্তে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, তাদের ক্রমেই রিসেশনের দিকে ঢলে পড়তে হচ্ছে। আমরা তো চোখের সামনেই ভারত ছাড়া দেখতে পাচ্ছি ব্রিটেনকে। সেখানে অর্থনীতির ভাঙনের ঠেলায় প্রধানমন্ত্রীই বদল হয়ে গেল। নতুন প্রধানমন্ত্রীও কবুল করেছেন, দেশ রিসেশনের কবলে পড়েছে। তার মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে।
বিশ্বব্যাঙ্ক বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সব দেশই অর্থনৈতিক দিক থেকে হৃতবল হয়েছে। এই সম্পর্কে তারা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কোন দেশের অর্থনৈতিক বনিয়াদ কতটা দুর্বল হয়েছে, তার উল্লেখ সেখানে আছে। জাপান দুর্বল হয়েছে ২.৬ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়েছে ৪.৫ শতাংশ, চীন হয়েছে ৫.৭ শতাংশ, জার্মানি হয়েছে ৬.৮ শতাংশ, গ্রেট ব্রিটেন হয়েছে ৭.৮ শতাংশ, ভারত হয়েছে ৭.৮ শতাংশ এবং রাশিয়ার দুর্বলতা হল ১২.৬ শতাংশ। এই যে অর্থনৈতিক অপুষ্টির শতকরা হার, তার হাল ঠিকমতো ধরতে না পারলে আগামী দিনে তা বাড়বে। আমরা নিরুপায়। এই বিপন্ন সময়ে আমাদের সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
মোদি-অনুগত নন, এমন বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন যে, এই মুহূর্তে দেশের যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তাকে আধা রিসেশন বলাই যায়। এছাড়াও তাঁরা আশঙ্কা করছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে এই অর্থনীতি চরম গাড্ডায় পড়ে যাবে। সরকার এখন অর্থনীতির যেসব রামধনু দেখানোর চেষ্টা করছে, তা আসলে সবই বাকোয়াস।
কয়েকদিন আগে দেশের বিভিন্ন কোম্পানির ৬৬ শতাংশ সিইও স্বীকার করেছেন যে, আসন্ন ২০২৩ সাল অর্থনৈতিক দিক থেকে ভয়ঙ্কর এক সময় হতে চলেছে। এই সময়ে দেশ রিসেশনের কবলে পড়তে পারে। পরিস্থিতি উন্নত হওয়ার কোনও আশা তো নেইই, বরং কতটা ক্ষতি আটকানো যায়, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বহু মানুষের চাকরি যাবে, বেতন কমে যাবে, মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে, সরকার হু হু করে কর বাড়াবে, জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে, উৎপাদনও কমে যাবে। দেশের সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে লড়াই করে প্রতিদিনের রুটি রোজগার জোগাড় করেন, তাঁদের কর্মক্ষেত্রেও টান পড়বে। দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। একেই নোটবন্দির জ্বালা এখনও জুড়ায়নি, তার উপরে জিএসটির বিষে জর্জরিত ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা। রিসেশনের ছোঁয়ায় তা আরও প্রাণান্তকর হয়ে ওঠার আশঙ্কা। মনে রাখা দরকার, অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৫০ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে অধিকাংশই আবার প্রান্তিক চাষি। তাদের যদি সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না দেয়, তাহলে তাদের পক্ষে জীবনধারণ করা কঠিন হয়ে উঠবে।
এই বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে সরকার কতটা লড়াই করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কেননা বাহুবলী দিয়ে, ধর্ম দিয়ে, সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে বা সিএএ দিয়ে এই দুর্বিপাককে রোখা যাবে না। এমনকী জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে বা গো-পূজনেও এই সর্বনাশকে রোখা সম্ভব হবে না।
এর আগে আমাদের দেশে দু’বার রিসেশনের আভাস দেখা গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে এবং ২০০৮ সালে। মনে রাখা দরকার, দু’বারই ভারত যে মানুষটির হাত ধরে তা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল, তাঁর নাম মনমোহন সিং। একবার তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী, অন্যবার প্রধানমন্ত্রী। এখন মোদির পরীক্ষা। অবশ্য এর মোকাবিলার জন্য শিক্ষা, মেধা, বিচক্ষণতার প্রয়োজন। গত সাড়ে আট বছরের রাজত্বকালে এই সরকার তার কণামাত্রও দেখাতে পারেনি। দেশের মানুষের আতঙ্কটা সেখানেই।