বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
ভারতকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানকে কেন কাছে টেনেছিল আমেরিকা? ওয়াশিংটনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস বলছে, ১৯৪৯ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আমেরিকা সফরে গিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানকে বার্তা দেন, স্নায়ুযুদ্ধে কোনও পক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষ থাকবে নয়াদিল্লি। আর এই বার্তাতেই মূলত ওয়াশিংটন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিপরীতে ভারত-রাশিয়ার বন্ধুত্বের পথ সহজ হয়।
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এই সুযোগ নষ্ট করেননি। বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে তিনি ওয়াশিংটন ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁর ওই সফরকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন। ৫০-এর দশকে সোভিয়েতের উপর নজর রাখতে আমেরিকাকে পেশোয়ার বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেয় পাকিস্তান। মস্কোর উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে ওয়াশিংটনকে নিজের ভূখণ্ড ব্যবহারেরও অনুমতি দেয়। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে তাঁর প্রথম চীন সফরে মধ্যস্থতা করে ইসলামাবাদ। এর বিনিময়ে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে লাখ লাখ ডলার সামরিক সহায়তা পায় পাকিস্তান।
ওয়াশিংটন পোস্টের নিবন্ধে বলা হয়, আশির দশকে হোয়াইট হাউসের হুঁশ ফেরে। দুই দেশের সম্পর্কে শীতলতা নেমে আসে। মার্কিন কংগ্রেস পাকিস্তানকে দেওয়া সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করে। ওয়াশিংটন বলে, পাকিস্তানকে দেওয়া সাহায্যের অর্থ ইসলামাবাদ তার পারমাণবিক কর্মসূচিতে ব্যবহার করছে না—এটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। তা করতে না পারা পর্যন্ত সাহায্য স্থগিতই থাকবে। তবে আমেরিকা এই পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস পায় তখনই, যখন মস্কোর বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছিল। আর ১৯৯২ সালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন দূত নিকোলাস প্ল্যাট সরাসরি বলেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। সেই প্রথম!
তবে নাইন-ইলেভেনের পর দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। মস্কোর বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেমন পাকিস্তানকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে আমেরিকা, তেমনই সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়েও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র হিসেবে ইসলামাবাদকে কাছে টানে ওয়াশিংটন। পাকিস্তানের নেতারা ওই সময় বলেন, আমেরিকার সঙ্গে যাওয়া ছাড়া ইসলামাবাদের কাছে অন্য কোনও বিকল্প ছিল না। কারণ, পাকিস্তানকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে না থাকলে পাকিস্তানে বোমা হামলা চালিয়ে ‘প্রস্তর যুগে ফেরত পাঠানো হবে’। আমেরিকার সঙ্গে থাকার পুরস্কার তাৎক্ষণিকভাবেই পেয়েছিল পাকিস্তান। ইসলামাবাদের উপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় আমেরিকা। ১০০ কোটি ডলার ঋণ মাফ করে দেয়। ২০০৪ সালের মধ্যে সামরিক জোট ন্যাটোর নতুন বন্ধু হিসেবে অস্ত্রও কেনার সুযোগ পায় ইসলামাবাদ।
কিন্তু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হলে পাকিস্তান নিয়ে সুর বদলাতে থাকে আমেরিকা। মার্কিন কর্তারা প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলতে থাকেন, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের জন্য যে সাহায্য দেওয়া হয়েছে, সেটা কি সত্যিই ওই কাজে ব্যবহার করেছে? পাকিস্তানের প্রতি বুশ ও ওবামা প্রশাসনের একরাশ বিরক্তি আছড়ে পড়ে। বলতে থাকে, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে পাকিস্তান পর্যাপ্ত সাহায্য করেনি। এর ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে আমেরিকা পাকিস্তানকে দেওয়া ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য স্থগিত করে। আর ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে বুশ-ওবামার প্রশাসনের সেই অবস্থানটা আরও কঠোর করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানকে যখন আমরা শত শত কোটি ডলার সাহায্য দিচ্ছি, তখন দেশটি জঙ্গিদের জন্য নিরাপদ ঘাঁটি গড়েছে। আমরা আবার সেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধেই লড়াই করছি।’ আমেরিকা-পাকিস্তানের সম্পর্কের ইতিহাসই বলছে, এটা সম্ভবত তাদের সম্পর্কের শেষ ধাপ নয়। প্রয়োজন হলে আবার নতুন মোড় নেবে এই সম্পর্ক। তবে কোন উদ্দেশ্যে বা কোন ঘটনাকে ঘিরে সম্পর্ক নতুন মাত্রা নেবে, সেই দিকে তাকিয়ে নয়াদিল্লিও।
পাকিস্তান থেকে আমেরিকার মুখ ফিরিয়ে নেওয়া শুরু হয় ডেমোক্র্যাটদের আমলেই। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিল ক্লিনটন। ক্লিনটনই ভারত-মার্কিন বন্ধুত্বের বীজ বপন করেন। তারপর আসেন রিপাবলিকানদের জুনিয়র বুশ। তাঁর আমলে ওই বীজ থেকে চারাগাছ জন্ম নেয়। তারপর বারাক ওবামা। এই ওবামার আমলেই আমেরিকা ভারতকে রাষ্ট্রসঙ্ঘে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করে। সেইসময় ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু ওবামা সফল হননি। গত দশকে ওবামার আমলে ভারত-মার্কিন বেসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির রূপকার ছিলেন বাইডেন। জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালেই মার্কিন কংগ্রেসে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমেরিকার বিশেষ কৌশলগত মিত্রের স্বীকৃতি পায় ভারত। এবারও ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী ইস্তেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে স্থায়ী এবং আইনসঙ্গত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠন করা হবে। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতি হওয়ার এখনই কোনও সম্ভাবনা নেই। মনে করছেন মার্কিন বিশেষজ্ঞরা।
একনাগাড়ে ৩৬ বছর জো বাইডেন মার্কিন সিনেটর ছিলেন। বারাক ওবামার সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ৩৬ বছরের সিনেটর পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং আট বছর ওবামার রানিংমেট ছিলেন। বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক সেনেট কমিটিতেও তিনি কাজ করেছেন। প্রশাসন চালানোর ব্যাপারে বাইডেনের রয়েছে ৪৪ বছরের অভিজ্ঞতা। অতীতে তিনি প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশের কুয়েত আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তিনি জুনিয়র বুশের ইরাকে সামরিক অভিযান এবং ইরাক দখলকে সমর্থন করেছিলেন শুরু থেকেই। লিবিয়ায় ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপেও সমর্থন ছিল তাঁর।
বাইডেন ২০০৭ সালে পাকিস্তানকে সম্ভাব্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবেও তালিকাভুক্ত করেছেন। ২০০৮ সালে এই বাইডেনই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিতর্কে জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে যদি কোনও হামলা হয়, তবে তা হবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে।’ ডনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওবামা-বাইডেন জমানায় পাকিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলা ৬৩১ ভাগ বেড়েছিল। বাইডেন তাঁর ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অনেকবার পাকিস্তান সফর করেছেন। পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার হিলাল-ই-পাকিস্তান পদকে ভূষিত হয়েছেন। এই বাইডেন ২০১১ সালে পাকিস্তান সফরের সময় বলেছিলেন, ‘আমার ও প্রেসিডেন্ট ওবামার দৃষ্টিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আমেরিকার স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা বিশ্বাস করেন যে আমেরিকার নীতি পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চায়, তাঁরা জেনে রাখবেন, তা ভয়াবহ মাত্রায় ভুল। আমরা চাই একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক পাকিস্তান, যে নিজে শান্তিতে থাকবে, ভারতসহ প্রতিবেশীদের শান্তিতে রাখবে। আমরা আপনাদের স্বার্থেই নয়, বরং আমাদের নিজেদের স্বার্থেও তা কামনা করি।’
মার্কিন কংগ্রেস আজ মনে করে, পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জঙ্গিরাই আফগানিস্তান এবং জম্মু-কাশ্মীরে নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত। পাকিস্তান হল সেই দেশ, যারা সরকারি কোষাগার থেকে পেনশন দিয়ে জঙ্গিদের পোষে। গত ৭০ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে দেশ থেকে হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব মুছে ফেলছে ওরা। ওরা ওসামা বিন লাদেনকে শহিদ বলে। এই হলো ওদের কৃতিত্ব।
আমেরিকার প্রবল চাপেই গত মাসে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স– ‘এফএটিএফ’এর পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানকে “ধূসর তালিকায়” রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাকিস্তান জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সংযোগের অবসান ঘটাতে দ্বিধাগ্রস্ত। জঙ্গি সংগঠনগুলিকে পাকিস্তান সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছে এবং অর্থ দিয়েছে। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগান ও অর্থ পাচারের একটি সক্রিয় নেটওয়ার্ক গভীরভাবে শিকড় ছড়িয়েছে। এর ফলেই পাকিস্তান ধূসর তালিকাভূক্ত হয়েছে এবং যতক্ষণ না পাকিস্তান তাদের ভাবমূর্তি উন্নত করতে পারে ততদিন ওই তালিকাই বজায় থাকবে। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, ধূসর তালিকার কারণে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলির সাহায্য পাওয়া থেকে তাদের বঞ্চিত থাকতে হবে।
ইসলামাবাদও জানে, পাকিস্তান প্রশ্নে মার্কিন নীতিতে এখনই কোনও পরিবর্তন আসবে না। দোটানায় ইমরান খানও। বুঝতে পারছেন না, চীন না আমেরিকা— কোনদিকে যাবেন? পাক প্রধানমন্ত্রী ভালো করেই জানেন, বারাক ওবামা প্রশাসনের নীতি ছিল ‘ছায়া যুদ্ধের’ মাধ্যমে আমেরিকার আধিপত্যকে সুসংহত রাখা। সেক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে বড় তুরুপের তাস। টার্গেট হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের মাটি। এবারও যদি বাইডেন প্রশাসন সেই নীতি নিয়ে চলে, তাহলে নতুন ‘ছায়া যু্দ্ধ’ শুরু হতে বেশি সময় লাগবে না। ক্ষেত্রও অনেকখানি প্রস্তুত।