কৃষির সঙ্কট কি নির্বাচনী ইস্যু ছিল না?
শান্তনু বসু
নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার লোকসভা নির্বাচন মোকাবিলায় নামার কিছু আগে সংবাদ মাধ্যমের একাংশের বক্তব্য ছিল, ‘‘খরকবলিত মারাঠাওয়াড়ার কৃষকরা মোদিকে আর একটি সুযোগ দিতে চান।’’ কিংবা একটি প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পরও লিখল, ‘‘নির্বাচনোত্তর সমীক্ষা: কৃষকদের সমস্যাগুলি এবার ভোটে প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠেনি।’’ আবার এই প্রতিবেদনের সঙ্গে যে ছবিটি দেওয়া হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে সারি সারি মহিলা বিশেষ করে মায়েরা, স্ত্রীয়েরা তাঁদের প্রিয়তমের ছবি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অথবা শতমাইলব্যাপী কৃষক লংমার্চে অংশ নিচ্ছেন। অর্থাৎ কৃষকেরা আত্মহত্যা করার পর সেই ফটোগুলি গণমাধ্যমে ভেসে উঠলেও গণমাধ্যমেরই একাংশ দাবি করছে যে কৃষির সংকট নির্বাচনের মূল ইস্যু ছিল না! ভারতের ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। এখানে জিডিপি বহুলাংশে নির্ধারিত হয় কৃষিউৎপাদনের ভিত্তিতে। আর সেই কৃষিব্যবস্থাই তীব্র সংকটে। এই বিপদের কথা ভারতে তো বটেই গোটা বিশ্বেও আলোচিত হচ্ছে। আর একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে যে সেটা নাকি ভারতে নির্বাচনের ইস্যু হয়নি! ব্যাপারটি বড় বিস্ময়কর নয় কি? স্বভাবতই গুরুত্ব হারাচ্ছে কৃষির এই তীব্র সংকটের কারণ নির্ধারণের বিষয়টি। এটাই পরিতাপের।
নামী গবেষণা সংস্থা লোকনীতি বলেছে, ‘‘The majority of farmers didn’t vote or issues that concern them most.’’ যেটা কৃষকের জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটাই যদি নির্বাচনের ইস্যু না-হয় তাহলে প্রশ্ন থাকে নির্বাচনী ইস্যু কাকে বলে। এবারের লোকসভা নির্বাচনটা কি তাহলে কোনও ইস্যু ছাড়াই হল? মহারাষ্ট্রের মারাঠাওয়াড়ার নান্দেদ, বিদ সহ আটটি জেলার ৭৬টি তালুকের ৫ হাজারের বেশি গ্রামে ভূগর্ভস্থ জলস্তর সাংঘাতিকভাবে নেমে গিয়েছে। বিদের যে কোথায় জল আছে এবং সেখানে কীভাবে ট্যাঙ্কার পাঠানো হবে সেটা নির্ধারণ করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গত অক্টোবর থেকেই ১৪ হাজার গ্রামের জলস্তর নামতে থাকে। গোটা মারাঠাওয়াড়ায় সাধারণভাবে দেশান্তরী শ্রমিকের সংখ্যা থাকে প্রায় আট লক্ষ। এঁরা মূলত বিদ, আহমেদনগর, নাসিক থেকে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশের চিনিকলগুলিতে কাজ করবার জন্য যান। এবার তাঁদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। কারণ খরা এতটাই তীব্র যে নিজেদের গ্রামে তাঁরা কোনও কাজ পাচ্ছেন না। অথচ, গত বছরই চিনিকল শ্রমিক পাওয়াটা ছিল নিদারুণ সমস্যার। এ বছরই বন্যার মতো ভুখা শ্রমিকের মিছিল চিনিকলগুলিতে।
বিদের গিওরাই তালুকের ৯০ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ গ্রাম ছেড়েছেন। জালনার ভোকরদান তালুক থেকে ট্রাকভর্তি শ্রমিকেরা কাজের খোঁজে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ঔরঙ্গবাদের খুলতাবাদ তালুকের বেশ কিছু কর্মহীন মানুষ মহারাষ্ট্র শিল্প উন্নয়ন নিগমে সাময়িক বা অস্থায়ী শ্রমিকের কাজ নিয়েছেন। কানাড়াগাঁও এবং মহম্মদপুর গ্রামের শ্রমিকেরা ওয়ালুজ শিল্প উন্নয়ন নিগমে কাজ নিয়েছেন। তাও অস্থায়ী। সুদূর মহারাষ্ট্রের মারাঠাওয়াড়াতে রোহিলাগড় গ্রামের ৪০ বছরের চাষি বিলাস টাকলে তাঁর ৪০০টি মিষ্টি মোসাম্বি লেবু গাছে জল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। জালনা জেলাতে এই কৃষকের ৩০ একরের উপর তুলো চাষের জমি ছিল। তাঁর ৫৫০টি মোসাম্বি লেবুর গাছ এবং ১১৫০টি বেদানার গাছ ছিল। কিন্তু ২০১৮-র খরার পর থেকে এইসব ফলের গাছ পরিচর্যা করার আর কোনও উপায় তাঁর ছিল না। আরও এক মরিয়া চাষি প্রহ্লাদ পাতিল তার মুমূর্ষু অবস্থা বোঝাতে গিয়ে এক অত্যন্ত করুণ গল্পের অবতারণা করেছেন। এক বাঁদর তার একটি বাচ্চাকে নিয়ে নদী পেরচ্ছিল। বাচ্চাটিকে মাথায় নিয়ে নদীতে সাঁতার দিচ্ছিল। সবাই অবাক। ওঠার সময় বাঁদরটি সেই বাচ্চাটিকে পাড়ে তুলে আনার পরিবর্তে জলেই ফেলে দিল! লোকজনের অনুমান, বাঁদরটি হয়তো ভেবেছিল যদি বাচ্চাটি বেঁচে থাকে তাহলে হয়তো তার আরও একটি বাচ্চা হতে পারে। টাকলে নামে এক কৃষকের অবস্থা বোঝাতে গিয়ে পাতিল বলছেন, ২০০৪ সালে টাকলে অনেকগুলি জলের ট্যাঙ্কার কিনেছিলেন। সেগুলিতে করে ২০ কিলোমিটার দূর থেকে জল নিয়ে এসে তাঁর জমিতে জলসেচ করতেন। অর্থাৎ যদি তিনি জলসেচটুকু করতে পারেন তবে হয়তো তিনি বেঁচে যাবেন।
মরাঠাওয়াড়া রোহিলাগড়ের তুলোচাষ এবছর দারুণভাবে মার খায়। টাকলে বলছেন, যদি টাকাই না-থাকে তাহলে তোমার জলও থাকবে না। জালনা জেলার রোহিলাগড়ের আম্বাদ তালুক গোটা ভারতে মোসাম্বি লেবু চাষের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু এখন সেগুলি শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গিয়েছে, যা আর কিছুদিনের মধ্যেই জ্বালানির জন্য কেটে ফেলা হবে। কিছু কৃষক অত্যন্ত চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করে জলসেচ করে যাচ্ছেন কিছু গাছে। এই আশায় যে যদি আগামী বছর সেখানে কিছু ফল ধরে। রোজ চাষিরা নিজেদের আলোচনায় এটাই বলতে থাকেন যে তাঁরা কীভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছেন!
রোহিলাগড়ের প্রথম বেদানা চাষি আড়াই লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে আড়াই হাজার গাছ রুয়েছিলেন। তাঁকে রোজ ৯ হাজার টাকার জলসেচ দিতে হতো। কিন্তু জলসেচের পরেও ফলন হবে এমন কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। তিনি বলেছেন, মাসের শেষ হলে জলও শুকিয়ে যায়, টাকাও শেষ হয়ে যায়। মধ্য মহারাষ্ট্রের মারাঠাওয়াড়া অঞ্চলের আটটি জেলা ২০১২-১৩ সাল থেকে উপর্যুপরি খরায় জ্বলে যাচ্ছে। গান্ধীনগর আইআইটির গবেষকেরা দেখিয়েছেন, গোটা দেশের ৪১ শতাংশ অঞ্চল খরায় জ্বলছে।
নান্দেদ শহর থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরের সায়েল গ্রামের সমস্ত নলকূপ গত পাঁচবছর ধরে শুকিয়ে গিয়েছে। শুকিয়ে গিয়েছে কুয়োও। প্রায় ৪০০ ফুট খুঁড়ে নলকূপ বসানোর কাজ চলছে। এখান থেকে তিন কিমি দূরে কিছুটা জলের খোঁজ আছে। সব বয়সি মহিলাকে সেখানে যেতে হয় জলের জন্য। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এক কিশোরী জল আনতে গিয়ে কড়া রোদে অজ্ঞান হয়ে যায়। তার জ্ঞান আর ফেরেনি। ট্যাঙ্কার দিয়ে জল দেওয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেগুলি খাওয়ার অযোগ্য। রান্নার জন্য বেশি দামে জল কিনতে হচ্ছে। তীব্র গরমে সমস্ত জলাধার শুকিয়ে গিয়েছে। কৃষকরা প্রশ্ন করছেন, এর পর কী? দু’-তিনদিন অন্তর স্নান। গোখাদ্যের নিদারুণ অভাব। মাসাধিক কাল যাবৎ গবাদি পশুদেরও স্নান নেই। জল টেনে আনার কারণে মহিলাদের শিরদাঁড়ায় প্রচণ্ড ব্যথা। মারাঠাওয়াড়ার জলচিত্র এককথায় নিষ্ঠুর। কিন্তু, সব ছাপিয়ে আরও একটি ঘটনা। তীব্র খরাতেও বিদ থেকে পারভানি যাওয়ার পথে অন্তত ২০০ বছরের পুরনো কয়েকশো বটগাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, শুধু রাস্তা চওড়া করার জন্য! কিন্তু কৃষির সংকট বা খরা কোনোটিই মারাঠাওয়াড়ার নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করেনি!
নান্দেদ লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী প্রতাপ রাও পাতিল ছিকালিকার জিতেছেন। অথচ, অনেকেরই ধারণা ছিল, এখানে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চ্যবন জিতে যাবেন। ২০১৭ সালেই নান্দেদ ওয়াঘালা পুর নির্বাচনে অশোক চ্যবন জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। হিঙ্গোলিতেও শিবসেনা-বিজেপি জোট জয়লাভ করে। একমাত্র ঔরঙ্গাবাদেই প্রকাশ আম্বেদকরের সংগঠনের প্রার্থী সেনা বিজেপিকে হারায়। কিন্তু ব্যবধান ছিল মাত্র ছ’হাজারের। ২০১৮-র আগস্টে এই ঔরঙ্গাবাদেই মারাঠা এবং দলিতদের মধ্যেই তীব্র দাঙ্গা বেধে গিয়েছিল। ওসমানাবাদ এবং পারভানিতেও বিরোধীরা জিততে পারেনি। বিদ এবং জালনাতেও বিজেপি প্রার্থীরা তাঁদের জয়কে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে, জলের অভাবে কৃষিজমি ফুটিফাটা হয়ে গেলেও এইসব অঞ্চলে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি ভোট শক্তিশালী হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে প্রো-ইনকাম্বেন্সি ভোট! অস্বীকার করার উপায় নেই যে কেন্দ্রীয় সরকার পিএম কিষাণ সম্মান, পিএম আশা, ফসল বিমা যোজনা, কৃষিঋণ মকুব, কৃষকের অ্যাকাউন্টে সরাসরি নগদ অর্থপ্রদান সহ অনেকগুলি কৃষকমুখী কর্মসূচি নিয়েছিল। এবারের ভোটে তারই প্রতিফলন দেখা গেল কি? কিন্তু খরাক্লিষ্ট কৃষকদের অভিজ্ঞতা অন্যকথা বলছে।
মারাঠাওয়াড়ার হাতনুরের কৃষক রামচন্দ্র কলের কথাই ধরা যাক। কেন্দ্রের ডিজিটাল ইন্ডিয়া স্লোগান তাঁর কাছে নিরর্থক। কৃষক পান্ধারিনাথ বির্ভের কথায়, ৭৫ শতাংশ কৃষক অনলাইন ফর্মফিলাপ করতে গিয়ে চরম নাজেহাল হচ্ছেন। ঋণমকুবের দরখাস্ত পূরণ করবার জন্য নিকটবর্তী সেবাকেন্দ্রে, যেটা অন্তত সাত কিমি দূরে, তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে দিনে চারবার ছোটাছুটি করতে হয়। কারণ আধার কার্ডের সঙ্গে তাঁদের আঙুলের ছাপের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিদিন অন্তত ৪০০ দরখাস্তকারী সেবাকেন্দ্রে ভিড় করায় হয় কম্পিউটার হ্যাং হয়ে গিয়েছিল অথবা সার্ভার কাজ করছিল না। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিমতো প্রতি মাসে দু’হাজার টাকাও তাঁরা পাননি।
এতদ্সত্ত্বেও খরাপীড়িত মারাঠাওয়াড়া থেকে বিজেপি জয়কে অক্ষুণ্ণ রেখে দিয়েছে! পলসওয়ারি গ্রামে (খুলদাবাদ তহসিল) প্রায় ৪০০ কৃষকের ব্যাঙ্কে ২০০০ করে টাকা ঢুকলেও কৃষি দপ্তর থেকে পাঠানো অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে না-মেলায় তাঁরা টাকাই তুলতে পারেনি। এরকম উদাহরণ অগুনতি। মূল কথা হচ্ছে, এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মোদিজির দলের বিজয়রথ অব্যাহত। কিন্তু যে প্রশ্নটা অনিবার্যভাবে ওঠে, তা হল, নির্বাচনে ঠিক কোনটা মূল ইস্যু ছিল? কথাগুলি এই মরশুমেরও তীব্র খরা আর-একবার প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
লেখক মালদহের চাঁচল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
25th July, 2019