প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
—এখানে বক্তার নাম জ্যোতি বসু। রাজনৈতিক আত্মকথন ‘যতদূর মনে পড়ে’ গ্রন্থে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কথাগুলি বলেছেন ‘বাহাত্তরের রিগিং’ প্রসঙ্গে।
ওই বইতে ‘চতুর্থ পঞ্চায়েত নির্বাচন’ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য এইরকম—
‘কংগ্রেস প্রথম থেকেই চায়নি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হোক। প্রথমে ওরা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার অজুহাত তুলে বিরোধিতা করেছিল। নির্বাচন এবং ফল ঘোষণা স্থগিত রাখার উদ্দেশ্যে মামলা করেছিল তিনশোর বেশি। বিজেপির সঙ্গে আসন সমঝোতাও করেছিল কংগ্রেস। শুধুমাত্র গ্রাম পঞ্চায়েতেই প্রায় দশ হাজার আসন ছেড়ে দিয়েছিল বিজেপিকে। ভোটের পর তথাকথিত সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে ৭ জুন দু’দল একসঙ্গে বাংলা বন্ধের ডাক দেয়। কংগ্রেস, বিজেপি, ঝাড়খণ্ডি-সহ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি কিছু আসনে বামফ্রন্টের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে কার্যত সর্বত্র সিপিআই(এম) বিরোধী মহাজোট গড়ে তোলে। ... এদের সম্মিলিত হামলা-সন্ত্রাস মোকাবিলা করতে গিয়ে শুধুমাত্র আমাদের পার্টিরই ২৬ জন নেতা-কর্মী শহিদ হন। আহতও হন চার শতাধিক পার্টিকর্মী।’ (সংক্ষেপিত)
রাইটার্সে জ্যোতি বসুর উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর ‘ফিরে দেখা। দ্বিতীয় পর্ব। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ ১০ বছর’ বইতে কী লিখলেন? পড়ুন—
‘কংগ্রেসের বিকল্প পথের সন্ধান থেকেই বামফ্রন্টের জন্ম। শিল্পপতি, জমিদারদের কর্মসূচির পরিবর্তে দেশের শ্রমজীবী মানুষ অর্থাৎ কল-কারখানায় শ্রমিক, কর্মচারী, শিক্ষক, দিনমজুর, গ্রামের কৃষক-খেতমজুর, মৎস্যজীবী, তাঁতি, কামার, কুমোর—এঁরাই আমাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে। যেখানেই শ্রমিক কর্মচারী শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে বামফ্রন্ট সরকার তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। গ্রামাঞ্চলেও ভূমি সংস্কার, গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েতের লক্ষ্য ছিল কৃষক ও গরিবের স্বার্থ রক্ষা এবং তাঁদের জীবনের উন্নয়ন। ... উদারনীতির ফলে সমাজের শ্রেণিবৈষম্য বাড়ছে। জনসাধারণেরই একাংশ দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় নেমে আসছে।’ (সংক্ষেপিত)
এরই পাশে রাখছি বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের ‘টুকরো টুকরো কথা’ গ্রন্থ থেকে কিছু মন্তব্য। ‘কভু কালী, কভু বনমালী’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন—
‘ভারতের কমিউনিস্টরা আশিতেও সাবালক হননি। ... জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রাচীন দেশের কোনোকিছুরই সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি তাঁরা। তাঁরা গান্ধীকেও চিনতে পারেননি—সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের দালাল বিশেষণে বিদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের চোখে বুর্জোয়াদের কবি। সুভাষচন্দ্র অনেক পরে মহান দেশপ্রেমিক হয়েছেন। তবে নেহরুর মূল্যায়নে অপারগ ছিলেন কমিউনিস্টরা। বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা পরে ভুল স্বীকার করেছেন অবশ্য! তবে তা কি সত্যিসত্যিই আত্মসমালোচনা, নাকি ভোটের রাজনীতি এবং ক্ষমতা দখলের তাগিদ? স্বাধীনতার আগে মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক দাবি এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন কমিউনিস্টরা। আর এখন এমন হাবভাব যেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণের জন্য ওঁদেরই শংসাপত্রের প্রয়োজন কংগ্রেসের!’ (সংক্ষেপিত)
‘সন্ত্রাসের ব্লু প্রিন্ট তৈরি’ শিরোনামে প্রদীপ ভট্টাচার্য লিখেছেন (২৮ মার্চ, ২০০৪)—
‘ভোটে জিততে সন্ত্রাসের ছক তৈরি করে ফেলেছে সিপিএম। জেলায় জেলায় বিশেষ রিগিং বাহিনীও তৈরি। এজন্য প্রশাসন ও পুলিসের একাংশকে কাজে লাগাবেন বুদ্ধবাবু। রিগিং বাহিনীর গোপন ট্রেনিংও আছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে কেশপুর, গড়বেতা-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সিপিএম সন্ত্রাস করে ভোটে জেতে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও মেদিনীপুর—এই তিন জেলায় বিধানসভা ভোটের দিন পুলিসের সামনেই সিপিএম প্রকৃত ভোটারদের বুথে ঢুকতে না দিয়ে ছাপ্পা ভোট মেরে গিয়েছে। তাই মেদিনীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সিপিএম প্রার্থীদের জয়ের ব্যবধান ছিল এক লাখেরও বেশি! ভোটার তালিকায় নাম তোলা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কংগ্রেসিদের চরিত্রহনন করেছে সিপিএম। তা থেকে বাদ পড়েননি মহিলারাও। কোনও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ... সব মিলিয়ে এটাই বুদ্ধদেববাবুর মরূদ্যান!’ (সংক্ষেপিত)
‘বুদ্ধবাবু, হ্যাঁ, আমরাও বলছি’ (২৫ জানুয়ারি, ২০০৪) শীর্ষক অধ্যায়ে প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য—
‘স্বাভাবিক হোক বা অস্বাভাবিক—সব মৃত্যুরই একটা কারণ থাকে—চিকিৎসকের ভাষায় কার্ডিয়াক ফেলিওর। কিন্তু কারণ শুধু এইটুকুই নয়। তাই বন্ধ চা বাগান শ্রমিক পরিবারের অনেকেরই মৃত্যু সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী যে কারণ দেখিয়েছেন, তা সর্বার্থে সত্য নয়। ... দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক ব্যর্থতা, প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব এই শিল্পকে ধ্বংস করেছে। সঙ্গে রয়েছে দলীয় মদতে বাগান মালিক ও শ্রমিকদের উপর আর্থিক জুলুম। ওই শ্রমিকদের মধ্যে সিপিএমের প্রভাব ছিল খুবই সামান্য। শ্রমিক সংগঠনগুলি মূলত ছিল কংগ্রেসের আদর্শে বিশ্বাসী। বাকি কিছু অংশে প্রভাব ছিল ফরওয়ার্ড ব্লক ও আরএসপির। শ্রমিকদের মধ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে প্রশাসনিক ক্ষমতাকে হাতিয়ার করেছিল সিপিএম। দলসর্বস্ব রাজনীতির কুফল মেলে তখন থেকেই। সিপিএম নেতৃত্ব সেদিন জেনেশুনেই এই শিল্প-ধ্বংসের অভিযান চালায় শুধুমাত্র কংগ্রেস এবং শরিকদের অস্তিত্ব নষ্ট করতে। ... শুধুমাত্র গরিবির সঙ্গে যুদ্ধ করে একবছরে জলপাইগুড়ি জেলায় ১২০০ শ্রমিক মারা গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্লেষণে সেটা অসুখ হলেও তার কারণ কিন্তু অনাহার। আত্মহত্যারও কারণ পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে না-পারা। বাগানগুলি বন্ধ করে সিপিএমের তাবড় নেতা/ফড়েরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন জমিগুলি প্রোমোটরদের হাতে তুলে দিতে। কংগ্রেসকে স্তব্ধ করার চেষ্টা হলেও হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন কমলবাবু (গুহ)। বুদ্ধবাবু, আমরাও বলছি, যে-কথা আপনি বলেছেন, তা সত্যি নয়। হতভাগ্য শ্রমিকদের খোলা চোখে দেখার চেষ্টা করুন।’ (সংক্ষেপিত)
এখনও কলকাতায় এবং জেলায় জেলায় খাড়া রয়েছে অগুনতি শহিদ বেদি। শহিদের তালিকার নীচে কোনোটিতে বিষোদ্গার নজরে পড়ে ‘সিপিএমের জল্লাদ’ এবং কোনোটিতে ‘কংগ্রেসি খুনিদের’ সম্পর্কে। এছাড়া হাওড়ার কান্দুয়া গ্রাম এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে পাঞ্জা থেকে হাত কেটে নেওয়া—এক বেনজির নৃশংসতার চিহ্ন। ‘হাত’ চিহ্নে ভোট দেওয়ার শাস্তি দিয়েছিল জ্যোতি বসুর পার্টির হার্মাদরা। বর্ধমানে পা দিয়ে গাওয়া ঘিয়ে প্রস্তুত সীতাভোগ, মিহিদানার সুবাস নাকে আসার আগেই কারও কারও মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ডের ছবি!
এ হল তাদের সম্পর্ক-পরম্পরার শো-রুম। গোডাউনের চেহারা অনুমেয়। এরপরও কি মনে হয় না অন্তত বাংলার বুকে সিপিএম-কংগ্রেসের জোট একটা জবরদস্তি কারবার? তবু চিরকালের সাপ ও নেউল নির্বাচনী মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হল। ‘সিপিএমের বি টিম’ হিসেবে ‘সুনামের সঙ্গেই’ দায়িত্ব পালন করেছিল সোমেন মিত্রদের প্রদেশ কংগ্রেস। এজন্যই আপসহীন সংগ্রামী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস গড়তে বাধ্য হন। সেই দলই যখন সিপিএম নামক জগদ্দল শক্তিকে রাইটার্স থেকে হটাতে বদ্ধপরিকর, তখন তাঁকে সমর্থন করেন রাজ্যের প্রায় সকলেই। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সিপিএম বিরোধিতা এমন উচ্চতা স্পর্শ করে যে, তার বিরোধিতার অর্থই ‘গণশত্রু’ চিহ্নিত হয়ে যাওয়া। ফলে তখন প্রদেশ কংগ্রেসের পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ানোর কোনও সুযোগই ছিল না, সেটা করলে নির্ঘাত আত্মঘাতী পদক্ষেপই হতো। ওই নির্বাচনে অগ্নিকন্যার নেতৃত্বে আসলে জিতেছিল বাংলার মানবাধিকার ও গণতন্ত্র। মমতার বদান্যতায় ৪২টি আসনে জিতে সেবার ওই সরকারেও যোগ দিয়েছিল কংগ্রেস। তবে তাদের পক্ষে বেশিদিন থাকা সম্ভব হয়নি। তৃণমূলের ছাতার নীচে থেকে কংগ্রেসের অতিদ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার পিছনে যে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নিরন্তর নষ্টামি সক্রিয় ছিল, তার প্রমাণ পেতে দেরি হয়নি। কংগ্রেস-সিপিএমের মাখামাখি পোক্ত হতে দেখা গেল ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে। প্রদেশ কংগ্রেসে মমতা বিরোধিতার প্রতীক অধীর চৌধুরী। তাঁরই একবগ্গা সিদ্ধান্তে ওই ভোটে সিপিএম-কংগ্রেসের জোট হয়।
সেটা নানা পর্যায়ে টিকে থাকলেও দিকে দিকে কংগ্রেসের নিচুতলায় গর্জনই শোনা গিয়েছে নেতৃত্বের অবিমৃশ্যকারিতার বিরুদ্ধে। সেই জনমত উপর্যুপরি উপেক্ষারই দাম মেটাচ্ছে কংগ্রেস। ২৯৪ আসনের বিধানসভায় তারা এখন ‘মহাশূন্য’! সঙ্গে জিগরি দোস্ত সিপিএমেরও হাল অনুরূপ। মাঝখান থেকে দই মেরেছে নেপোয় (বিজেপি এবং আইএসএফ)! অথচ কংগ্রেসই একমাত্র দল, তামাম ভারতের প্রতিটি গ্রামে যার কিছু কর্মী এবং তেরঙ্গা পতাকা ধরার লোক আছে। নিশ্চিতভাবে তাঁদেরই স্বাভিমান খর্ব হচ্ছিল বাংলায়, অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে। সম্ভবত এজন্যই প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বে আনা হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ বদল। অধীরের কুর্সিতে এখন শুভঙ্কর সরকার—যিনি মমতা-বিরোধী এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতি করেননি কখনও। অধীরের সিপিএম-পিরিতির কারণে বাংলার যেসব কংগ্রেস কর্মীর দম বন্ধ হয়ে আসছিল, শুভঙ্করকে পাশে পেয়ে তাঁরা হয়তো উজ্জীবিত। জেলায় জেলায় তাঁরাই আওয়াজ তুলেছেন, ‘সিপিএমের সঙ্গে আর চলব না।’ গা থেকে হার্মাদি দুর্গন্ধ দ্রুত মুছেই কংগ্রেসকে বাঁচাতে মরিয়া তাঁরা। আসন্ন উপনির্বাচনে তাঁরা একক শক্তিতেই লড়াই দিতে চান, সিপিএমের লেজুড় থাকতে চান না কোনোমতেই। অত্যাচার অনাচারে রেকর্ড গড়ে বাংলার ক্ষমতার অলিন্দ থেকে বিতাড়িত মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের অক্সিজেন জোগাবারও দায়িত্ব কেন নেবেন তাঁরা! যারা নিজেদেরকে ভারতের স্বাধীনতার ‘ভগীরথ’ বলে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে এসেছে, এই উপনির্বাচনই হয়তো সেই শতবর্ষ প্রাচীন কংগ্রেসকে পুনর্জন্মলাভের আশ্চর্য সন্ধান দিতে পারে। আর এই উদ্যোগ ব্যর্থ হলে, একবগ্গা মমতা-বিরোধিতার রাজনীতিই কংগ্রেসকে বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার রাস্তাটা পরিষ্কার করে দেবে—একই করুণ দশা হতে পারে সিপিএমেরও।