গোস্বামীপ্রভুর কোনো শিষ্য বৃন্দাবনে থাকলে বা কোনো শিষ্যের শ্রীধামে আগমন হ’লে তিনি দিব্যদৃষ্টিতে তা বুঝতে পেরেই গুরুভাইয়ের নিকট উপস্থিত হতেন এবং তাঁর মঙ্গলাদি সকল বিষয়ে খোঁজ নিতেন। “মেরা গুরুভাই” বলতে বলতে তাঁর মুখে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত। একবার তাঁর গুরুভাই শ্রীনাথ দাস ময়মনসিংহ থেকে আগ্রা হয়ে বৃন্দাবনে আসেন তাঁর মাকে নিয়ে। দেখা গেল হঠাৎ রাত্রে ময়ূরমুকুটজী এসেছেন রাধাকুণ্ড থেকে কুড়ি মাইল দূরে গোপালবাগে শ্রীনাথ দাসের কাছে। গুরুভাইএর সুবিধে অসুবিধের কথা তিনি সব জেনে নিলেন এবং দাস মহাশয়ের মাকে কতভাবে যত্ন করলেন। তাঁর সুমধুর ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বৃন্দাবন থেকে ফেরার দিন স্টেশনে তাঁরা এলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ময়ূরমুকুটজী সেখানে উপস্থিত হয়ে বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে ও নেচে নেচে তাঁদের আনন্দ দিতে লাগলেন। ট্রেন এলে কত সাবধানে গুরুভায়ের মাকে ট্রেনে বসিয়ে দিলেন তিনি। বৃন্দাবনে তাঁদের আসার কথা বা সেখান থেকে চলে যাবার দিনক্ষণ কিছুই ময়ূরমুকুটজীকে জানানো হয় নি; অথচ তিনি সবই জানতে পেরে গুরুভায়ের কাছে এসে তাঁদের আনন্দদান করলেন। এতে বোঝা যায় তিনি ছিলেন সর্বজ্ঞ মহাপুরুষ, আর তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল গুরুভাইদের প্রতি। গুরুভাই শ্যামাকান্ত পণ্ডিতমহাশয় কয়েকজনকে নিয়ে সেদিন ঘোর অন্ধকারে রাধাকুণ্ডে গিয়ে অবস্থান করছিলেন। সেদিন ঐ অন্ধকারে কুসুমসরোবর থেকে ঘনান্ধকারে হিংস্রজন্তুসমাকুল গভীর বনের মধ্য দিয়ে ময়ূরমুকুটজী রাধাকুণ্ডে এসে তাঁদের কাছে উপস্থিত হন। যে কয়দিন পণ্ডিতমহাশয় রাধাকুণ্ডে ছিলেন প্রতিদিনই তিনি তাঁদের কাছে আসতেন ও কুশলাদি জেনে নিশ্চিন্ত হতেন।
বর্ষাণে হোলী খেলা অভূতপূর্ব বিষয়। বর্ষাণ ও নন্দগ্রামের হোলী খেলা সুপ্রসিদ্ধ; এই খেলায় স্বয়ং রাধারানী উপস্থিত থাকেন জেনে ময়ূরমুকুটজী কৈলাস থেকে এসে ব্রজমায়ীদের সঙ্গে নাচে, গানে, বাঁশির ধ্বনিতে উন্মত্ত হ’য়ে যেতেন। মায়েদের পায়ে নূপুর, হাতে পিচকারী আর মুখে শ্রীকৃষ্ণের গুণগাথা। নূপুরের তালে তালে তাদের নৃত্যের সঙ্গে ময়ূরমুকুটজী বাঁশী বাজিয়ে নৃত্য করতেন; মায়েরা কখনও ফাগ ছিটিয়ে, পিচকারীর রং দিয়ে তাঁকে লাল করে দিতেন। এইভাবে সবাই আত্মহারা হয়ে এক প্রেমময় মধুময় রাজ্যের নৃত্য গীতে মাতোয়ারা হয়ে পড়তেন।
হোলীর সময় শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ-যাত্রাভিনয়ে ময়ূরমুকুটজী হতেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি তখন ব্রজভাবে বিভোর হয়ে বাঁশি বাজাতে থাকতেন, আর নেচে নেচে ব্রজবাসীদের মুগ্ধ করে দিতেন। পরিবেশটি এরূপ মধুরতায় রূপান্তরিত হ’ত যে সবাই মনে করতেন সত্য সত্যই শ্রীকৃষ্ণলীলার পুনরাবির্ভাব হয়েছে। অভিনয়ে দর্শকগণ রসানন্দে ডুবে যেতেন রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রেমলীলার আস্বাদন পেয়ে।
স্বামী অলোকানন্দের সম্পাদিত ‘শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ পরিজন’ থেকে