বাংলায় আছে ১০৭১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম দফার নির্বাচন একদিনে করাতে গেলে দরকার ২,৪৬১ কোম্পানি বাহিনী। রাজ্যের নির্বাচনে প্রতিটি বুথে পাহারার জন্য এই সংখ্যক বাহিনী পাওয়া যাবে না বলে তিনদফার ভোট একদিনে করা নাকি সম্ভব নয়। করোনা আবহে নির্বাচন কমিশনের এই যুক্তি শুনে সেই অমোঘ কথাটাই মনে আসছে—বাইরে যতই প্রলয় হোক, আমি দরজায় খিল এঁটে ঘরের মধ্যে বসে থাকব। করোনা মহামারীকালে বঙ্গে নজিরবিহীন আটদফা ভোটের জন্য প্রায় দেড় মাস ধরে রাজ্যে জোরকদমে নির্বাচনের প্রচার চলছে। মোদি, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, স্মৃতি ইরানিদের হাত ধরে বহু বাইরের রাজ্যের লোক বঙ্গে ভোটপ্রচারে আসছেন। জনসভা রোড-শোয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার লোক মাস্ক ছাড়াই পথে নেমে পড়ছেন! ভোটের এই গনগনে উত্তাপের মধ্যে চোরা স্রোতের মতো বল বিস্তার করছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। দেশ তো বটেই, এরাজ্যেও করোনা প্রতিদিন তার নিজের রেকর্ড ভেঙে এগিয়ে চলছে। বিশেষজ্ঞ থেকে চিকিৎসক সকলেই একমত, এই ২০২১, করোনার খেলায় গত বছরকে দশ গোল দেবে। একদিকে যখন এই মারণরোগের চোখ রাঙানি, অন্যদিকে তখন হাসপাতালে কোভিড শয্যা, টিকার জোগানসহ করোনা চিকিৎসার যাবতীয় পরিকাঠামো আবার ঢেলে সাজার পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। এই আবহে রাজ্যে শেষ তিনদফার ভোট একদিনে করার প্রস্তাব দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভালো প্রস্তাব। তাঁর যুক্তি পরিষ্কার, করোনা ফিরে এসেছে আরও শক্তি নিয়ে। আর কে না জানে, এক জায়গায় জনসমাগমের চেয়ে বড় ‘সুপার স্প্রেডার’ আর কিছু হয় না। তাই সংক্রমণে রাশ টানতে একদিনে ভোট করার দাওয়াই দিয়েছেন নেত্রী। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই প্রস্তাবকে নির্বাচন কমিশন মান্যতা না দিলেও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে দূরদর্শিতার ছাপ স্পষ্ট। গোড়াতেই আটদফায় ভোটপর্বে আপত্তি তুলেছিলেন তিনি। তাঁর বক্তব্যে সে সময় মান্যতা দিলে আজ হয়তো বাংলায় উদ্বেগজনক এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন? এখনও কেন্দ্রীয় বাহিনীর অপ্রতুলতার যুক্তি দিয়ে সেই প্রস্তাব মানতে নারাজ। শোনা যাচ্ছে, প্রচারে রাশ টেনে সংক্রমণকে বাগে আনার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু মাস্ক, স্যানিটাইজার, গ্লাভসের ব্যবস্থা, বুথের ২০০ মিটারের মধ্যে জমায়েত আটকাতে ১৪৪ ধারার নিদান জারি থাকা সত্ত্বেও প্রথম চারদফার ভোটের ছবিটা কী ছিল তা সকলেরই জানা। তাই শুধু এভাবে উদ্দেশ্যপূরণের লক্ষ্যে বেশিদূর এগনো যাবে কি না সন্দেহ। এত বেশিদিন ধরে নির্বাচন পর্ব না চালিয়ে কম সময়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া সাঙ্গ করার কথা ভাবাই হল না! মিটিং মিছিল জনসমাবেশ চলতে থাকলে মূল সমস্যাকে উৎপাটিত করা যাবে কি? সংগত কারণেই কম দফায় ভোট করার প্রস্তাব রেখেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। এখনও তিনি চাইছেন, শেষ তিনদফার ভোট অন্তত একদিনে হোক। বক্তব্যের যৌক্তিকতাকে অস্বীকার করা যায় না।
বাংলা অনেকক্ষেত্রেই পথ দেখায়। সমস্ত আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে করোনাকালেই এরাজ্যে দুর্গা পুজো হয়েছে কোভিডবিধি মেনে। কিন্তু ভোটের বাংলার ছবিটা অনেক অপ্রিয় প্রশ্নকে সামনে এনে দিল। শুধুমাত্র কাগজে-কলমে কোভিড সুরক্ষাবিধি পালনের নির্দেশ জারি করেই যে সংক্রমণ রোখা যায় না তা এর ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফই প্রমাণ করে দিচ্ছে। জনসমাবেশে রাশ টানার কথা আজ যেভাবে ভাবা হচ্ছে তা আগে ভাবা হল না কেন? কেন, নির্বাচনের আদর্শ আচরণবিধি চালু থাকা সত্ত্বেও কোভিডবিধি মেনে প্রচারপর্ব চলল না? ভোটপ্রক্রিয়া চলাকালীন এ-সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশ কঠোরভাবে বলবৎ করার দায়ও তো কমিশনেরই। এমনটা নয়, এবারই বাংলায় প্রথম ভোট হচ্ছে। সব বুথে বাহিনী না থাকলেও কি তখন ভোট লুট হয়েছে? তাছাড়া কমিশন কী করতে পারে, তার ক্ষমতা কতদূর সেই অভিজ্ঞতাও বাংলার মানুষের আছে। এখনও রাজ্যবাসীর মন জুড়ে আছেন যে ব্যক্তিটি তাঁর নাম টি এন সেশন, নিরপেক্ষভাবে কীভাবে নির্বাচন পরিচালনার কাজ করা যায় সে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন। কিন্তু শুরুতেই এবার নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল। বাকি তিনদফার ভোট একদফায় করার প্রস্তাব বাতিল করতে পর্যাপ্ত বাহিনীর ‘অজুহাত’কেই কি শেষ পর্যন্ত ঢাল করা হল? প্রশ্ন উঠছে।
করোনার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় প্রাসঙ্গিক আর যে-প্রশ্নটি সামনে এল তা হল মানুষের জীবনরক্ষা আগে না ভোটের প্রচার—কোনটা বেশি জরুরি? নির্বাচন নামক গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসবটি তো মানুষেরই জন্য। কখনওই তা মানুষের প্রাণের বিনিময়ে নয়। তাই তিনদফার ভোট একদফায় করার যুক্তিপূর্ণ আর্জি জানিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো অন্তত বুঝিয়ে দিয়েছেন সংক্রমণের প্রকোপ রোখাটাই তাঁর কাছে অনেক জরুরি কাজ, বড় চ্যালেঞ্জ।