অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
রাত-বিরেতে কোভিড রোগীকে নিয়ে কেউ বিপাকে পড়েছেন। অ্যাম্বুলেন্স চাই। এক ফোনেই হাসপাতাল কিংবা ‘সেফ হোম’-এ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ‘কাজল দা’। ওয়ার্ডে পানীয় জলের সঙ্কট, রাস্তার হাল বেহাল—খবর যায় সেই দাদার কাছেই। মুমুর্ষ রোগীর রক্তের প্রয়োজন—মুশকিল আসান কাজল সিনহা। আসলে, সবাই জানেন, তাঁর কাজে রাজনীতির রং নেই। কাঁধ উঁচিয়ে চলন নেই। তিনি নবীনদের ‘কাজল দা’। প্রবীণদের কাছে শুধুই ‘কাজল’। খড়দহ স্টেশনকে ঘিরে যত রিকশ চলে তার সিংহভাগই তাঁরই বদান্যতায়। সংখ্যাটা সাতশো’রও বেশি। চালকরা সবাই যে তৃণমূল সমর্থক, এমনটা মোটেও নয়। আবার সেলাই মেশিন কিংবা হুইলচেয়ার প্রাপকদের সকলেই যে তাঁর দল করেন, তাও নয়। আসলে, রংহীন রাজনীতিতেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ।
আর ‘স্বচ্ছন্দ’ বলেই কাজলের পদযাত্রায় স্বচ্ছন্দে শামিল হন আম-খড়দহবাসী। শুক্রবার প্রচার করছিলেন ঠাকুর কলোনিতে। এলাকাটি বন্দিপুর পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। সামনে মাইক। পিছনে জনস্রোত। মাঝখানে কাজল সিনহা। তৃণমূলের ভূমিপুত্র প্রার্থী। মিছিল চলেছে মিছিলের ছন্দে। কর্মী-সমর্থকদের ভিড় থেকে আওয়াজ উঠছে—‘কাজের মানুষ, কাছের মানুষ কাজল’দা আপনাদের দুয়ারে।’
বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়েছিলেন গৌরাঙ্গচন্দ্র দে। একদা সিপিএমের দাপুটে কর্মী। শ্রমিক সংগঠন করতেন। বয়স মধ্য পঞ্চাশের কোঠায়। সেই গৌরাঙ্গবাবুর
হাতে ফুলের স্তবক। সবাইকে অবাক করে এগিয়ে এলেন কাজলের সামনে। বললেন—‘রাজনীতিতে মতাদর্শগত ফারাক যাই থাক, কাজের মানুষ হিসেবে আপনাকেই চাই। জিততে হবে কিন্তু।’ গৌরাঙ্গবাবুর হাত থেকে ফুলের স্তবক নিয়ে প্রণাম করলেন কাজল। আর সঙ্গে যোগ করলেন দু’টো কথা—‘সকাল সকাল ভোটটা দেবেন। আপনারাই তো আমাদের শক্তি।’
‘শক্তি’ শুধু গৌরাঙ্গবাবুই নন। খড়দহের মহিলা ভোটারদের একটা বড় অংশও নাকি ভূমিপুত্রের পাশে। এমনটাই দাবি তৃণমূলের। তাঁদের অংশগ্রহণে প্রচার-মিছিলের ভারও বাড়ছে বিভিন্ন এলাকায়। ঠাকুর কলোনিতেও নীল-সাদা বেলুন হাতে প্রমিলা বাহিনী ছিল চোখে পড়ার মতো। পিচের বড় রাস্তা ছাড়লেন কাজল। টোটো করে ঢুকলেন কলোনির ভিতর। আচমকা তাঁর মুখোমুখি মিতালি চক্রবর্তী। এ পাড়াতেই থাকেন তিনি। কাজলের গলায়
মালা পরিয়ে বললেন, ‘জয়ী হউন’। তৃণমূল প্রার্থীও জানিয়ে দিলেন, ‘আপনারা, মা-বোনেরাই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রেরণা। আশীর্বাদ করুন।’খড়দহের প্রার্থী হিসেবে ‘আশীর্বাদ’ ও ‘স্নেহ-ভালোবাসা’ একটু বোধহয় বেশিই পাচ্ছেন কাজল সিনহা। পাওয়ারই কথা। বলছেন, তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। কারণ, দীর্ঘ ৫০ বছর পর এই প্রথম ভূমিপুত্র প্রার্থী পেলেন খড়দহবাসী। সেই ৮৭’সাল থেকেই অর্থমন্ত্রীর কেন্দ্র বলে খড়দহের খ্যাতি। কিন্তু মনের ভিতর একটু ‘খেদ’ পুষে রাখতেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাম জমানায় ভোট এলে প্রচারে দেখতেন তাঁদের প্রার্থী অসীম দাশগুপ্তকে। তার পর রাজ্যের অর্থমন্ত্রীকে দেখা যেত শুধুই টিভিতে। সেই পরম্পরা বজায় ছিল তৃণমূল জমানাতেও। ২০১১ সালে পরিবর্তনের ঝড়ে পতন হয়েছিল এই বাম দুর্গের। অসীমবাবুকে হারিয়ে অর্থমন্ত্রী হন তৃণমূল প্রার্থী অমিত মিত্র। দু’জনের কেউই খড়দহের ভূমিপুত্র ছিলেন না।
এবার একুশে ব্যতিক্রম। কাজল খড়দহের ছেলে। এখানকার স্কুলেই পড়াশোনা, বড় হয়ে ওঠা। রাজনীতিতে হাতেখড়িও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। সেটাও মূলত খড়দহকেন্দ্রিক। ২০০০ সাল থেকে খড়দহের বইমেলার সঙ্গে যুক্ত কাজল। খড়দহ সাংস্কৃতিক মঞ্চের নানা কর্মকাণ্ড চলে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায়। কোভিড...লকডাউন সঙ্কটের মোকাবিলায় ‘সেফ হোম’ কিংবা ‘কমিউনিটি কিচেন’ও তৈরি করেছিলেন। ফলত, ভোট-ময়দানে তাঁর অন্য দুই প্রতিপক্ষের তুলনায় কিছুটা বাড়তি অ্যাডভান্টেজ পাচ্ছেন জোড়াফুল প্রার্থী। পাশে দাঁড়িয়েছেন খড়দহের চিকিৎসক, সঙ্গীতশিল্পী, সাহিত্যিক সহ বিদ্বজনদের একটা বড় অংশ।
দুই প্রতিপক্ষ বলতে একজন পদ্মফুলের প্রার্থী শীলভদ্র দত্ত। তিনি পানিহাটি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার। তৃণমূলের প্রতীকে বারাকপুর থেকে দু’বার জিতেছিলেন। ভোটের মুখেই তিনি দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। ‘পুরস্কার’ স্বরূপ তাঁকে প্রার্থী করে গেরুয়া শিবির। এমনটাই ধারণা রাজনৈতিক মহলের। অন্যজন, সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী দেবজ্যোতি ঘোষ। সিপিএমের তরুণ-তুর্কি নেতা। এসএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক। তিনিও খড়দহের বাসিন্দা নন। দেবজ্যোতির বাড়ি বেলঘরিয়ায়। খড়দহে এবার জবরদস্ত ত্রিমুখী লড়াই। গত লোকসভা ভোটে এই বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে তৃণমূলই। আর এই ‘এগিয়ে’ থাকাই বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে কাজলকে। প্রচারের ফাঁকে কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন, আমার ৯২ বছরের বাবার চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছেন, তাতে আমি কৃতজ্ঞ। বিশাল মার্জিনে জিতে খড়দহ কেন্দ্রটি নেত্রীর হাতে তুলে দেব।’
ভোটের আগে থেকে কাজল সিনহাকে নিয়ে একটা গুঞ্জন চলছিল খড়দহের চায়ের দোকানে কিংবা পাড়ার মোড়ে— তিনি নাকি বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। এটা কি সত্যি ছিল? নাকি জল্পনা? কাজলের জবাব, ‘কোনওটাই নয়। স্রেফ অপপ্রচার। তৃণমূল আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। ভোটের পরও দিদির অনুগত সৈনিক হয়েই থাকতে চাই।’