অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
সেই হত্যার সমর্থন করতেও দেখা যাচ্ছে। তারা তো বাঙালি। হ্যাঁ। ঠিক যেমন লর্ড ক্লাইভের বাংলা দখলেরও সহায়ক ছিল অনেক বাঙালি। অথচ মাত্র ১৩ বছরের মধ্যে সাধারণ বাঙালি না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল এক নৃশংস মন্বন্তরে। বাঙালি কি শুধু শীতলকুচিতে মারা যায়? কে বলেছে? হাজার হাজার বাঙালি দুর্ভিক্ষে মারা যায়, দাঙ্গায় মারা যায়, দেশভাগে মারা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামে মারা যায়। অতীতে পুলিসের গুলিতেও মারা গিয়েছে বহুবার। ১৭৭০ সালের চরম দুর্ভিক্ষে যখন বাঙালি মারা যায়, তখনও দিল্লির মোগল সাম্রাজ্য অথবা কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছুই এসে যায়নি। তারা বহাল তবিয়তে বাংলা থেকে মুনাফা করেছে। সুখী জীবন যাপন করেছে। বরং সেই ভয়াল দুর্ভিক্ষের পরের বছরেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লক্ষ লক্ষ টাকা লন্ডনে তাদের হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়েছে আদায় করা ট্যাক্স আর রাজস্ব হিসেবে। অন্য ভারতের কিছু যায় আসেনি।
১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষে কোন প্রদেশের ৩৫ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল? বাংলার। সেই মৃত্যু নিয়ে গোটা ভারতের কার কী এসে গিয়েছিল? কিছুই নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে সবথেকে বেশি কারা প্রাণ দিয়েছিল? বাঙালি। বিনিময়ে বাঙালি জাতি ভারতের রাজস্ব আর সম্পদ থেকে গত ৭৫ বছরে বিশেষ কিছু উপকার পেয়েছে নাকি? পায়নি। কেউ বাংলাকে পাত্তাও দেয়নি। দেশভাগের মতো এত বড় অভিশাপে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুর কী এসে গেল? কিছুই নয়। দেশভাগের পর লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু আগমন আর একের পর এক দাঙ্গার ক্ষত কোন জাতিকে সবথেকে বেশি বহন করতে হয়েছে? বাঙালি। ১৯৬৫ পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৭১ বাংলাদেশ যুদ্ধ, পালিয়ে আসা রিফিউজিরা কোন রাজ্যে আছড়ে পড়ল? কাদের খাবার আর বাসস্থান জোগাতে হল? পশ্চিমবঙ্গ। কারা দায় নিয়েছে উদ্বাস্তুদের? কেউ নয়। নিলেও জঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই বাঙালির প্রাণের মূল্য নেই একথা তো ধ্রুব সত্য। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে বারবার। বহিরাগত নেতানেত্রীদের কণ্ঠে একবারও কেন সামান্য সহানুভূতির বাক্য শোনা গেল না শীতলকুচির জন্য?
আজও বাঙালির প্রাণ আর সম্মান বহিরাগতদের কাছে তুচ্ছ আর সস্তা। ঠিক যে কারণে, যখন তখন বাংলায় এসে বলা যায়, এনআরসি নিয়ে এসে কাগজ না থাকলে সবাইকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেব। বাঙালিকে মুখ বুজে এই হুমকি শুনতে হয়। রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, শ্রীরামকৃষ্ণদেব, ঋষি বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, স্বামীজি, নেতাজি, শ্রীঅরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন দাশের বাংলার মানুষকে কারা থ্রেট দিচ্ছে দেশ থেকে তাড়াবো? বাংলার বাইরের রাজনীতিকরা। যাদের বিপ্লবে, সংস্কৃতিতে, ইতিহাসে, ভারত গঠনে সামান্যতম অবদান নেই। বাঙালির আছে। অসমে কেন লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালির নাম বাদ গেল এনআরসিতে?
বাঙালির প্রাণ যদি তুচ্ছই না হবে, তাহলে কেন করোনার মরণকামড়ের মধ্যেই ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত একমাস ধরে ভোটগ্রহণ নামক একটি আট দফার দীর্ঘমেয়াদি সময়সীমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে? কেন বাকি সব রাজ্যে ৬ এপ্রিলের মধ্যে ভোটপর্ব শেষ হয়ে গেল? সেইসব রাজ্যবাসী তো কোভিড সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেল অনেকটাই। কারণ, তাঁরা উন্নত ভারতবাসী। পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর, তুচ্ছ বাঙালি তো নয়! সম্পূর্ণ দেশের মধ্যে শুধুমাত্র একটি জাতি আর একটি রাজ্যকেই কোভিডের বিষের মধ্যে ভোটযুদ্ধে নিমজ্জিত করে রাখা হচ্ছে। গোটা এপ্রিল মাসে ভারতজুড়ে হাহাকার। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই ঘরবন্দি হয়ে গিয়েছে। একমাত্র কলকাতাকে রাস্তায় এনে বাধ্য করা হচ্ছে কোভিড বিষের দংশন সহ্য করে প্রাণ হারাতে, অসুস্থ হতে, সংক্রামিত হতে। ভিড়ে ঠাসা মিছিল, রোড শো আর সমাবেশের ছবি শেয়ার করে সর্বভারতীয় স্তরের মহামান্যরা দেখাচ্ছেন তাঁদের জনপ্রিয়তা! তারপর সন্ধ্যায় আবার দিল্লিতে ফিরে গিয়ে দেশবাসীকে তাঁরাই অমৃতবাণী শোনাচ্ছেন, দূরত্ব বজায় রাখুন....মাস্ক ব্যবহার করুন....প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরবেন না। সেই দেশবাসীর তালিকায় বাঙালি নেই। কারণ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বুলেট হোক আর করোনার সংক্রমণ, বাঙালির প্রাণ তো মূল্যহীন। কী যায় আসে! আমাদের হাতজোড় করে বলতে হবে, ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান!’
যারা বাঙালির উন্নতির জন্য, সোনার বাংলার জন্য এত আকুল, তারা গত ৭ বছরে কী করেছে বাংলার জন্য? একটিও কেন্দ্রীয় শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে? ক’টা নতুন দূরপাল্লার ট্রেন চালু হয়েছে? রেল কেন একটিও বৃহৎ ম্যানুফাকচারিং ইউনিট করল না? চিরকাল কীটপতঙ্গের মতো যাতায়াত করতে হয় ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে। সেই চরম অপমানের জার্নির কোনও পরিবর্তন হয়েছে? গত ৭ বছরে ইস্টার্ন রেল, সাউথ ইস্টার্ন রেল, মেট্রো রেলে কত বাঙালি ছেলেমেয়ে চাকরি পেল? আদানি, আম্বানিদের অনুরোধ করে একটিও বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি কি বাংলায় নিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার? বার্ন, ব্রেথওয়েট, জেশপ কোন কারখানা আবার নতুন উদ্যোগে চালু করা হয়েছে? রাজ্য সরকার চাকরি দেয়নি? বেশ। আপনারা ক’টা চাকরি দিয়েছেন? ক’টা নতুন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল? বাংলার নামবদলের প্রস্তাব বছরের পর বছর কেন হেলায় ফেলে রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ফাইলে? অন্য রাজ্য হলে এই অবহেলা করা যেত? বহু ভাষা পেয়ে গেল, অথচ বাংলা আজও কেন ক্লাসিক ভাষার মর্যাদা পেল না ভারত সরকারের কাছে?
২৯ এপ্রিল শেষ দফার ভোট হয়ে যাওয়ার পর ফলাফল যাই হোক, কারা আবার যে যার নিজেদের জগতে ফিরে গিয়ে অন্য কোনও অ্যাজেন্ডায় মনোনিবেশ করবে? ওই বাইরে থেকে আসা নেতানেত্রীর দল। তাঁদের ডেইলি প্যাসেঞ্জারি সমাপ্ত হবে। সভা সমাবেশে তাঁদের ভাঙা ভাঙা বাংলা বলা শেষ হবে। ভোটের তাগিদে বাংলার মনীষীদের নাম মুখস্থ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা শেষ হবে। যে বাহিনী গুলি চালিয়ে বাঙালিকে হত্যা করেছে, তারাও অন্য কোনও রাজ্যে, অন্য কোনও ডিউটিতে চলে যাবে। বাংলায় কী কী হয়েছে দু মাস ধরে, এরা সকলেই কিছুদিনের মধ্যেই ভুলে যাবে। কারণ, এখানে তাদের স্বজন কেউ তো হতাহত হয়নি। তাদের রাজ্য, তাদের শহর, তাদের স্বজাতির জীবনযাপনে কোনও সমস্যাই হয়নি। তাদের স্বজাতির কেউ গুলিতে হতাহত হয়নি। কেউ ভোটের ডিউটি অথবা মিছিলে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়নি। করোনা, কুবাক্য আর বুলেটের স্মৃতির হাহাকার বাংলার বাতাসে রয়েই যাবে। কাদের প্রতিনিয়ত বলা হল, এই যে শোনো! তোমরা ব্যর্থ একটা রাজ্য! তোমাদের সংস্কৃতি গোল্লায় গেছে। তোমাদের সমাজ উচ্ছন্নে গেছে। তোমাদের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা, হ্যাঁ, শুধু আমরা এসে তোমাদের সোনার বাংলা গড়ে মানুষের মতো মানুষ করে দেব? ১০ কোটির বাঙালিকে দিনের পর দিন এরকম কথা বলা হচ্ছে বিনা দ্বিধায়। আমরা চুপচাপ এই হুঁশিয়ারি, অপমান, তাচ্ছিল্য শুনে গেলাম। এই প্রথম একটি ভোট হচ্ছে বাঙালি জাতির আত্মসম্মানের ভোট। বাঙালি সত্ত্বার জয়পরাজয়ের ভোট! বাঙালির আবেগের ভোট।
স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে এবার এসেছে বাঙালির চেতনা ও স্বাধীনতা রক্ষার ভোট!