অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
রাজ্যে তিনভাগের একভাগ আসনে নির্বাচন হয়েছে। এখন থেকেই নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডা এমন হুঙ্কার ছাড়ছেন যাতে মনে হচ্ছে, বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতা দখল করেই ফেলেছে। একটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে, প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাদ দিয়ে বিজেপির অন্য মিছিল মিটিংগুলিতে যা ভিড় হচ্ছে, তাতে ভোটে লড়াই করে জেতা কঠিন। সেই জন্যই বিজেপি নেতারা নার্ভের লড়াইয়ে জিততে চাইছেন। তাঁরা প্রতিটি সভায় একটা কথাই বলছেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হেরে গিয়েছেন।’ এটা যে দলের কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা, সেটা নতুন করে বলার দরকার নেই।
লক্ষণীয়, বিজেপি নেতৃত্ব সব সময় তাদের কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। তার জন্য কখনও এনআরসি, কখনও সিএএ, কখনও ৩৫৬ ধারা জারির হুজুগ তুলে বাজার গরম করেছে। একটা সময় জরুরি অবস্থা জারি করে ভোটের দাবিতে বঙ্গের বিজেপি নেতারা ঘন ঘন দিল্লি ছুটেছিলেন। এমনকী, মহামহিমও কথায় কথায় দিল্লি গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। যাঁদের সংবিধান এবং আইন শৃঙ্খলা সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান আছে তাঁরা সকলেই জানতেন, এরাজ্যে কিছুতেই ৩৫৬ ধারা জারি হবে না। তবুও বিজেপি নেতারা বলতেন। কারণ কর্মীদের চাঙ্গা করার এছাড়া অন্য কোনও রাস্তা তখন ছিল না। যে দলে সংগঠন পলকা, সেখানে ‘হাওয়া’ই ভরসা।
বিজেপি নেতারা এরাজ্যে প্রথম থেকে সেই ‘হাওয়া’ তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচন ঘোষণার মুখে অমিত শাহ দুম করে দাবি করে বসলেন, এবার বঙ্গে ২০০-র বেশি আসন বিজেপি দখল করবে। অমিতজি যখন এই দাবি করছেন তখন প্রার্থী নিয়ে বিজেপির হাঁড়ির হাল অবস্থা। এক সঙ্গে সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার হিম্মত নেই। অথচ ২০০ আসন দখলের দাবি। একেই বোধহয় বলে, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা।
বিজেপি নেতাদের কথাবার্তা শুনে প্রায় বছর তেরো আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। এমএ পার্ট-১ পরীক্ষায় সেবার দু’জন ছাত্র ফার্স্ট ক্লাসের চেয়েও অনেক বেশি নম্বর পেল। দু’জনই ভালো বন্ধু। যে কিছুটা বেশি নম্বর পেয়েছিল সে একটু সহজ সরল, মারপ্যাঁচ বোঝে না। সে তার বন্ধুকে নানাভাবে সাহায্যও করত। পার্ট-টুর পরীক্ষা শুরু হল। প্রথম পরীক্ষাটা দু’জনেরই ভালো হল। দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন বেশ কঠিন। কেউই কমন পেল না। পরীক্ষা শেষে বেশি নম্বর পাওয়া বন্ধুটি বলল, ‘প্রশ্ন কমন পাইনি। পরীক্ষা ভালো হয়নি।’
দ্বিতীয় ছাত্রটির পরীক্ষা ভালো না হওয়া সত্ত্বেও বলল, ‘স্যার যা পড়িয়েছিলেন তার বাইরেও কিছু পড়েছিলাম। তাতে কমন পেয়েছি।’ ভালো ছাত্রটি মুষড়ে পড়ল। ভাবল, তার আর ইউনিভার্সিটি টপার হওয়া হল না। তৃতীয়পত্রের প্রশ্নও কঠিন হল। প্রথম বন্ধুটি বলল, ‘পরীক্ষা ভালো হয়নি। ভাবছি, এবার ড্রপ দেব।’ উত্তরে দ্বিতীয় বন্ধু জানাল, তার পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছে। প্রথম বন্ধু মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। সে আর চতুর্থপত্রের পরীক্ষাই দিল না।
রেজাল্ট বের হওয়ার পর দেখা গেল, পার্ট-১ পরীক্ষায় এগিয়ে থাকা ছাত্রটি তিনটি পেপারেই তার বন্ধুর চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। কিন্তু, চতুর্থ পেপারে পরীক্ষা না দেওয়ায় রেজাল্ট অসম্পূর্ণ। ফলে তার বন্ধুই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে গেল।
লোকজনের অভাবে একের পর এক সভা বাতিলের পরেও বিজেপি নেতাদের বঙ্গ জয়ের দাবি দেখে বারবার দ্বিতীয় বন্ধুটির কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। বিজেপি নেতৃত্ব নার্ভের খেলায় জিততে চাইছে। বছরভর পড়াশোনা করা ছাত্রের মতোই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মানুষকে সার্ভিস দিয়ে গিয়েছে। মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। আর বিজেপি? কখনও নোট বাতিল, কখনও জিএসটি, কখনও আধারকার্ডের সঙ্গে মোবাইল নম্বর সংযুক্তিকরণ, কখনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে প্যানকার্ড যুক্ত করার মতো একের পর এক ঝামেলায় মানুষকে নাকাল করেছে। বিজেপির অবস্থা অনেকটা ‘ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই কিল মারার গোঁসাই’য়ের মতো। একটা করে নতুন নিয়ম চালু করে মানুষকে কেবল হয়রান করেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টে করের বোঝা চাপিয়েছে। তাই বিজেপি নেতাদের মুখে আর ‘আচ্ছে দিনের’ কথা শোনা যায় না। এখন নতুন স্লোগান, ‘সুনার বঙ্গাল’।
কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পরিচালনা, সিবিআই, ইডিকে প্রয়োজন মতো ব্যবহারের সুবিধে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, অসমেও তারা কংগ্রেস ও তাদের জোটসঙ্গীর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। তৃতীয় দফায় ৪০টি আসনে নির্বাচন হওয়ার আগেই নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ দাবি করেছেন, দ্বিতীয় দফার ভোটেই তাঁরা অসমে সরকার গড়ার সংখ্যা অর্জন করে ফেলেছেন। অথচ বাস্তবটা হল, এনআরসি ইস্যুতে অসমে বিজেপি প্রবল চাপে রয়েছে। বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের ‘মহিমা’ও অসমের মানুষ টের পাচ্ছেন। সেই ধাক্কা উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলাতেও বিজেপি খাবে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে।
বঙ্গে নির্বাচন মানেই রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও খুনোখুনি। এটা রাজ্যের ট্র্যাডিশন। কিন্তু আগে প্রার্থীরা আক্রান্ত হতেন না। তাঁদের সকলেই সমীহ করত। এবার হাজার হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকায় ও আট দফায় ভোট হওয়ায় অনেকেই ভেবেছিলেন, কোনও অশান্তি হবে না। কেউ ট্যাঁ ফোঁ করতে পারবে না। কিন্তু ঘটছে ঠিক তার উল্টোটা।
এবার প্রথম থেকেই প্রার্থীর উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। এর জন্য রাজনৈতিক নেতাদের উস্কানিমূলক কথাবার্তাকেই অনেকে দায়ী করছেন। নেতাদের উত্তেজক ভাষণ শুনে কর্মীদের রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। প্রার্থী, নেতা, পুলিস, কেন্দ্রীয় বাহিনী যাকে পাচ্ছে তাকেই পিটিয়ে দিচ্ছে। অনেকে কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, কমিশন পদক্ষেপ না নেওয়ায় মস্তানরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
ভোটের দফা যত গড়াচ্ছে রাজনৈতিক মারামারি, প্রার্থীদের উপর হামলা ততই বাড়ছে। নেতাদের ‘জয়লাভে’র দাবিকে সত্যি ধরে নিয়ে অনেকেই ‘বদলা’ নেওয়ার মহড়া শুরু করে দিয়েছে। নন্দীগ্রাম কার্যত বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। রাজ্যের জন্য এ-এক ‘অশনি সঙ্কেত’। রাজনৈতিক দলগুলির এখনই সতর্ক হওয়া দরকার। তা না হলে ২ মে’র পর রাজ্যে ‘রক্তগঙ্গা’ বওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।
আট দফায় ভোট। হাজার হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী। উদ্দেশ্য একটাই, শান্তিতে ভোটদানের ব্যবস্থা করা। তার জন্য কমিশন একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথমেই রাজ্য পুলিসের প্রধানকে সরিয়ে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে রাজ্যের সমস্ত পুরসভার প্রশাসক বোর্ডের ক্ষমতা। একের পর এক জেলার ডিএম, এসপিকে সরিয়ে দিয়েছে। প্রতি দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু, যে উদ্দেশ্যে এত আয়োজন, সেটাই পূরণ হচ্ছে না। মস্তানদের ভয়ে মানুষ ভোট দিতে যেতে পারছে না।
দক্ষিণ উলুবেড়িয়ার বিজেপি প্রার্থী পাপিয়া অধিকারীর ও আরামবাগের তৃণমূল প্রার্থী সুজাতা মণ্ডলের উপর হামলার ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছে, দুষ্কৃতীরা কতটা বেপরোয়া! তাদের বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই। ভয় না পাওয়ার কারণ সর্বস্তরে ঘটনাকে ‘লঘু’ করে দেখানোর চেষ্টা। নেতারাও তাঁদের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর কাজকে সমর্থন করছেন। তাতে মস্তানদের সাহস বাড়ছে। তাতে পরের নির্বাচনগুলি আরও রক্তাক্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। ‘দলদাস’ শব্দটি শুধু পুলিসের ক্ষেত্রেই খাটে না, নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনীর গায়েও লেগে যায়। এ থেকে মুক্তির একটাই রাস্তা, ‘নিরপেক্ষতা’।