অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
এবার আসা যাক পরের প্রশ্নে। সোনার বাংলা গড়ার ক্ষমতা কি বিজেপির আছে? দেখা যাক তারা এর আগে কী করেছে। প্রতিটি রাজ্যেই নির্বাচনের আগে বিজেপি এরকম সংকল্পপত্র প্রকাশ করেছে। সেখানেও একই রকমের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কখনও অসমে বলেছিল মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে এনআরসি হবে, কিন্তু শেষে দেখা গেল লক্ষ লক্ষ গরিব হিন্দুর নাম বাদ গেছে নাগরিকের তালিকা থেকে। এখনও বলা হচ্ছে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু শরণার্থীদের। তারপরে তাদের পাঠানো হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্পে! কেন? অভিযোগ, বেছে বেছে সেখানে হিন্দু বাঙালিদের চাকরি খাওয়া হয়েছে। ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ সোনায় গড়া হবে স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। কিন্তু কোনও রাজ্যেই ক্ষমতায় আসার পর তারা যা বলেছিল বা যেভাবে বলেছিল তা পালন করেনি।
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি বলেছিল, ক্ষমতায় এলে সুইস ব্যাঙ্ক থেকে দেশের
সব কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ করে ঢুকিয়ে দেবে। পেট্রল ডিজেলের দাম, গ্যাসের দাম কমিয়ে দেবে। বছরে দুই কোটি চাকরি দেবে। সাত বছর পর দেখা যাচ্ছে তারা কিছুই করতে পারেনি। উল্টে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ দিন দিন আর্থিক কষ্টে কোণঠাসা, বেকারি বাড়ছে, কর্পোরেট মুনাফার পাহাড় গড়ছে, তাদের দেওয়া হল ইচ্ছেমত ছাঁটাই করার অধিকার। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, গণতন্ত্রের সূচক, মানবাধিকার রক্ষা, মানুষের কাছে সরকারের সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়া এবং সামাজিক সম্প্রীতি রাখার কোনও মানদণ্ডেই বিজেপি শাসিত এই দেশ কিংবা তাদের রাজ্যগুলি উন্নতি করেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি মোদি সরকারের সমালোচনায় মুখর। খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলি।
কী করে মানুষ ভরসা করবে বিজেপির প্রতিশ্রুতির উপর? এর উত্তর তো বিজেপি নেতৃত্বকেই দিতে হবে।
বিজেপি সব রাজ্যেই সংকল্পপত্রে লেখে, প্রতিবছর দশ লাখ চাকরি হবে। কর্মচারীদের সপ্তম পে কমিশন বসিয়ে মাইনে দ্বিগুণ করা হবে। ছাত্র, যুব, মেয়েদের জন্যও বহু প্রতিশ্রুতি থাকে। সোনার বাংলা গড়তেও সেই একই কথা লেখা হল, যা লেখা হয়েছিল
ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি জায়গায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভোটের পর সেসব কেউ মনে
রাখে না। অসম, উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর চাকরি বাড়ার পরিবর্তে সরকারি সংস্থা বিক্রি শুরু হয়, বন্ধ হয়ে যায় নিয়োগ। ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার জানাচ্ছে তারা সরকারি
পদ কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। যেটুকু থাকবে
সেটা বেসরকারি এজেন্সি মাধ্যমে সরকারের পদ
পূরণ করবে চুক্তি ভিত্তিতে! ত্রিপুরায় বলেছিল, প্রতিটা ব্লকে স্কুল কলেজ তৈরি করবে। ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষকদের বেতন বাড়াবে। কিন্তু দেখা গেল, দশ হাজার স্থায়ী শিক্ষকের চাকরিই তুলে দিয়েছে। বন্ধ করে দিয়েছে সাড়ে তিনশ-র বেশি স্কুল। দুই রাজ্যেই বলেছিল মেয়েদের স্কুটি দেবে। একটা সাইকেলও কি দেওয়া হল?
এই হল বিজেপির বিকাশ এবং তা মোদি অমিত শাহের নেতৃত্ব। তাঁরা যদি বলেন বুলেট ট্রেন করবেন, তাহলে রেলকেই বিক্রি করতে শুরু করবেন। যদি বলেন আত্মনির্ভর ভারত গড়বেন, তাহলে অর্থনীতির মূল মেরুদণ্ড যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা সংস্থা সেগুলিকে বেচে দেবেন। রাম যাত্রার স্টাইলে মোদি বলেন দেশে রামরাজ্য হবে। কোনও দুর্নীতি থাকবে না। ‘‘না খাউনগা, না খানে দুঙ্গা’’। তারপর? ব্যাঙ্ক থেকে একটার পর একটা ঋণ নেওয়ার নামে টাকা লোপাট হবে। উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে বলা হল নারী উন্নয়ন, দুর্বলের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হবে। তারপর তো সেখানকার মানুষ দেখতেই পাচ্ছে কীভাবে প্রতিদিন ঘটে চলেছে হাতরাসকাণ্ড, ধর্ষণ, রাস্তায় আগুন দিয়ে ধর্ষিতাকে পুড়িয়ে দেওয়া, থানায় অভিযোগ জানালে মেরে দেওয়া হয় ধর্ষিতার বাবাকে! মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি সংকল্পপত্রে বলেছিল, করোনা টিকা দেওয়া হবে প্রত্যেককে বিনামূল্যে। ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘদিন তাদের সরকারেই ছিল না কোনও স্বাস্থ্যমন্ত্রী, এমনকী কোনও স্বাস্থ্যসচিব। ফলে অতিমারী যখন ভয়ঙ্কর তখন মধ্যপ্রদেশে করোনা নিয়ে লড়াইয়ে ছিল না কোনও প্রশাসনের নেতৃত্ব। বেঘোরে প্রাণ গেছে বহু রাজ্যবাসীর। মধ্যপ্রদেশে ভোটের আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সেই রাজ্যের কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন বলেছিলেন। আজ সেই রাজ্যের কৃষকরা আন্দোলনে পথে নেমেছেন। আরএসএস অনুমোদিত কৃষক সংগঠন দাবি জানাচ্ছে, বিজেপি কেন পালন করছে না তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি? কী করে করবে?! কৃষি উন্নয়নের জন্য বলেছিল চল্লিশ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করবে। ভোটের পর দেখা গেল মধ্যপ্রদেশ জুড়ে কৃষি উন্নয়নের সরকারি অর্থে গড়া হচ্ছে কৃষি বাণিজ্যের পরিকাঠামো। আদানির মতো কর্পোরেট বড় বড় কোল্ড স্টোরে সস্তায় চাষিদের ফসল কিনে বিশ বছরের জন্য রেখে দিতে পারবে। কিন্তু চাষির কোনও লাভ হবে না। কর্পোরেট চড়া দামে বাজারে তা বেচার সুবিধা পাবে।
এই হল বিজেপি। যাদের বিকাশ মানে কর্পোরেটের লাভ। গরিবের লোকসান। আর ক্ষমতায় আসার জন্য মানুষের কাছে থাকে তাদের দায়হীন প্রতিশ্রুতি।
শেষ কথা বলি। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলার থেকে পিছিয়ে। অবাক হবেন পাঠক, সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির তথ্য জানলে! তাদের তথ্য অনুযায়ী গুজরাত, কর্ণাটক, হরিয়ানার মতো শিল্পোন্নত রাজ্যের থেকে বাংলায় বেকারি কম। বাংলার আর্থিক বৃদ্ধি সব বিজেপি শাসিত রাজ্যের থেকে বেশি। একথা জানাচ্ছে কেন্দ্রের শিল্প ও অর্থনীতির তথ্য। আরও বিস্তারিত তথ্যের জন্য কেন্দ্রের পরিসংখ্যান ও প্রকল্প রূপায়ণ মন্ত্রক, শিল্প মন্ত্রক, অর্থ মন্ত্রক, এবং সামাজিক কল্যাণ মন্ত্রকের ওয়েবসাইট এবং প্রকাশিত রিপোর্টগুলি থেকেই তা জেনে নেওয়া ভালো। কৃষি, গ্রামোন্নয়ন, অসংগঠিত এরকম ছয়টি গুরত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দেশের সেরা রাজ্য হিসেবে এই মোদি সরকারের কাছ থেকেই পুরস্কার পেয়েছে বাংলা। কিন্তু বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি ক্রমশ পিছোচ্ছে। তাহলে বাংলায় এসে আর কী করবে বিজেপি? ডবল ইঞ্জিনে যদি রাজ্য এতই দৌড়ায় তাহলে প্রশ্ন, ত্রিপুরা, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশে বাংলার থেকে ডবল বেকার কেন? বাংলার থেকে সেখানে বেশি দরিদ্র কেন? সেখানকার আর্থিক প্রগতি বাংলার চাইতে কম কেন? বিজেপি শাসিত রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যা এত বেশি কেন? তাই বাংলাকে যারা আরও এগিয়ে নিয়ে সোনার বাংলা গড়বে বলছে, তাদের কি আদৌ সেই বিশ্বাসযোগ্যতা আছে?
স্পষ্টতই বিজেপির গত সাত বছরে কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যের সরকারে থাকার যা পারফরম্যান্স তাতে প্রমাণিত হয় যে সোনার বাংলা গড়ে তোলা তো দূর অস্ত, যেটুকু আছে সেটুকুও রাখা যাবে বলেও তাদের নীতি বা দক্ষতা প্রমাণ দেয় না। মোদি যত কথা বলেছেন তারমধ্যে রামমন্দির, তিন তালাক, কাশ্মীর ইস্যুতে ৩৭০ ধারার মতো বিতর্কিত বিষয় ছাড়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের উন্নয়নে কোনও কিছু করে দেখাতে পারেননি। গ্যাসের দাম বাড়ছে। যে সরকার নিজেই তার সমস্ত সংস্থা বিক্রি করে দিতে উঠে পরে লেগেছে সেই সরকার ভবিষ্যতে চাকরিবাকরি বা পরিষেবা দেবে কী দিয়ে? মানুষকেই তার নিজের যোগ্যতায় রোজগার করার পথ খুঁজে নিতে হবে, নিজের আয় থেকে সব কিছু কিনে নিতে হবে। সরকার কিছু দেবে না, উল্টে সরকারের সব সম্পদ বেচে দেবে। এটাই হল মোদি সরকার বা বিজেপির সরকার চালানোর আসল দর্শন! এমন নীতির কথাই অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী রোজ বলছেন। ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, কর্ণাটক ইত্যাদি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর সেখানেও তারা বেসরকারিকরণ করেছে। তাই এই রাজ্যে ক্ষমতায় এলে তারা সোনার বাংলা গড়বে, না বাংলা বেচে দেবে প্রশ্ন সেটাই।