অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
চারটি প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়েছে
বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খতিয়ে দেখার একটা সুযোগ চারটি প্রতিষ্ঠানের সামনে ছিল। প্রথম হল সংবাদ মাধ্যম বা মিডিয়া। অনেক প্রশ্ন তোলার এবং জবাব চাওয়ার মতো মশলা মজুদ ছিল। কিন্তু, মিডিয়ার একটা বড় অংশই প্রশ্ন তুলল না। আরও পরিতাপের বিষয় হল, উল্টে অনেক মিডিয়া সংস্থা সরকারের লিখিত বিবৃতিটুকুই প্রকাশ করল, যেন ওইটুকুই সত্য ‘সংবাদ’! ৭ অক্টোবর, ২০১৮ তারিখ প্রকাশিত আমার ব্যক্তিগত কলামে অর্থমন্ত্রী সমীপে ১০টি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম। সেগুলোর মধ্যে ছিল:
(এক) ১২৬টি টুইন-ইঞ্জিন মাল্টি-রোল ফাইটার এয়ারক্রাফট কেনার জন্য ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে সমঝোতাপত্র বা মউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কেন সেটা বাতিল করে মাত্র ৩৬টি যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিতে যাওয়া হল?
(দুই) যে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে সেটা অনু্যায়ী, প্রতিটি যুদ্ধবিমানের দাম দিতে হতো ৫২৬ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। এটা কি সত্যি, নতুন চুক্তি অনুসারে প্রতিটির জন্য ভারতকে দাম মেটাতে হবে ১৬৭০ কোটি টাকা (দাসোঁ যেটা প্রকাশ করেছে)।
(তিন) প্রথম যুদ্ধবিমানটি সরবরাহ করা হবে ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে (নতুন চুক্তিসম্পাদনের চার বছর বাদে) এবং শেষতমটি সরবরাহ করা হবে ২০২২ সালে। এটাই যখন বাস্তব, তখন ‘জরুরিভিত্তিতে ক্রয়’-এর জন্য এই লেনদেন হয়েছিল, এমনটা সরকার প্রমাণ করবে কীভাবে?
(চার) রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেডকে (হ্যাল) প্রযুক্তি হস্তান্তরের চুক্তি কেন খারিজ করা হয়েছিল?
(পাঁচ) ‘অফসেট পার্টনার’ হিসেবে সরকার কি কোনও নামের প্রস্তাব করেছিল? এবং, তা যদি না করে থাকে, তবে সরকার কেন হ্যাল-এর নাম প্রস্তাব করেনি?
এই পাঁচটি এবং প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসা অন্যসকল প্রশ্নেরও জবাব সরকার দেয়নি। হাতেগোনা কয়েকটিকে বাদ দিলে, সার্বিকভাবে মিডিয়া দেশকে হতাশ করেছে।
দ্বিতীয় হল সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ মোতাবেক দাখিল হওয়া একটা পিটিশনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের নিরসনের জন্য তদন্তের আর্জি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে তার অক্ষমতা প্রকাশ করে। উদাহরণ—দামের ব্যাপারটি অথবা টেকনিক্যাল কিছু দিক খতিয়ে দেখার আর্জি মঞ্জুর করেনি। ভারতীয় বায়ুসেনার প্রয়োজনে ১২৬টির বদলে ৩৬টি যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কি না অথবা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহের যে পদ্ধতি চালু রয়েছে তার থেকে সরে আসার ব্যাপারটিও সুপ্রিম কোর্ট খতিয়ে দেখতে চায়নি। সরকার সিল করা খামে একটি ‘নোট’ পেশ করেছিল, তার বিষয়বস্তু এবং সরকারের মৌখিক বক্তব্য—আদালত গ্রহণ করেছিল দু’টিই। সিএজি-র রিপোর্ট রয়েছে, এমন একটা বিশ্বাস থেকে আদালত বিভ্রান্ত হয়েছিল, অথচ সেদিন পর্যন্ত ওই রিপোর্ট সংসদ এবং আদালতের কোনওখানেই পেশ করা হয়নি। রায় ঘোষণার পর সরকার দাবি করেছিল যে, সরকারের অবস্থান সম্পর্কে সন্দেহের নিরসন করেছে আদালত। কিন্তু সত্যটা ছিল যে, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো আদালত যাচাই করেনি।
সংসদ ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে
তৃতীয় হল সংসদ। দলগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে সরকারের কাজকর্মে তদারকের ভূমিকা পালনে সংসদ ব্যর্থ হল। প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং কাজের অংশীদারিত্ব নিয়ে ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ দাসোঁ ও হ্যাল-এর মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। ওই সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার ৯৫ ভাগ যখন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে, ঠিক তখনই চুক্তিটা বাতিল করা হল কী কারণে? পার্লামেন্ট একাই এই প্রশ্ন তুলে সত্যটা উদ্ঘাটন করতে পারত। নতুন চুক্তিতে দাম যদি ৯-২০ শতাংশ সস্তাই হবে তবে দাসোঁর ১২৬টি যুদ্ধবিমান কেনার অফার কেনা লুফে নেওয়া হল না? এছাড়া অফসেট পার্টনার হিসেবে হ্যাল-এর নামটা কেন পাকা করল না সরকার? সরকার পক্ষের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার জোরে পার্লামেন্টের তদারকের ভূমিকা বানচাল করে দেওয়া হল।
চতুর্থ হল সিএজি। শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয়টি দিয়েছে সিএজি। ৩৩ পাতার একটি রিপোর্টে সিএজি লেনদেন নিয়ে লুকোছাপা করেছে এবং কবর দিয়েছে ঘটনার সঙ্গে সত্যকেও। সিএজির পক্ষে বেনজির ঘটনা এই, সরকার নিরাপত্তার যে দোহাই দিয়েছে কর্তৃপক্ষ সেটাই মেনে নিয়েছে। বোফর্স কিংবা অন্য কোনও মামলায় কিন্তু এই সংযম ও শ্রদ্ধা দেখানো হয়নি। তার ফলে গড়পড়তা বুদ্ধিসুদ্ধিওয়ালা একজনের কাছে ওই রিপোর্টের ১২৬-১৪১ পাতার বক্তব্যের কোনও মানে নেই। বিশেষ করে ১৩১ পাতায় ছাপা ৩ নম্বর টেবল এবং ১৩৩ পাতায় ছাপা ৪ নম্বর টেবল স্রেফ আগডুম-বাগডুম গোছের একটা কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু, ৯ শতাংশ সস্তার নতুন চুক্তি (প্রতিটি এয়ারক্রাফটের জন্য) সম্পাদন হয়েছে বলে সরকার যে দাবি করেছিল সেটা সিএজি খারিজ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। অন্য যে-কোনও কর্তৃপক্ষের চেয়ে বেশি তথ্য সিএজির হাতে থাকে, তা সত্ত্বেও এমন একটা স্বাধীন সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ দেশকে হতাশই করল।
বিরক্তিকর উদ্ঘাটন
মনে আছে নতুন চুক্তি থেকে, ব্যতিক্রমীভাবে, দুর্নীতি-বিরোধী আবশ্যিক ধারাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন—অন্যায় প্রভাব খাটানো, কোনও এজেন্সি না রাখা এবং হিসেবের খাতা ও ‘ইন্টিগ্রিটি’ চুক্তিতে নজর করার সুযোগ। এই যে ছাড় দেওয়া হল সে কি কোনও গোপন উদ্দেশ্যে? আমরা জানি না, কিন্তু অনুপস্থিত ধারাগুলো সরকারকে হতাশ করে ফিরে এসেছে। ফরাসি সংবাদ সংস্থা ‘মিডিয়াপার্ট’ তাদের তিনদফার এক তদন্তের ভিত্তিতে জানিয়েছে, ফরাসি দুর্নীতিদমন সংস্থা এএফএ এই ডিলে দুর্নীতির হদিশ পেয়েছে। এএফএ প্রমাণ পেয়েছে যে, দাসোঁ এক পরিচিত মিডলম্যান বা দালালকে ১০ লক্ষ ইউরো দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। এই দালালির টাকা যাঁর হাতে যাওয়ার কথা সেই ব্যক্তি ইতিমধ্যেই ভারতে অভিযুক্ত। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাবেচার অন্য একটা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত জারি রয়েছে। এবং, এই ব্যাপারে ডিফসিস সলিউশনস নামে একটি ভারতীয় কোম্পানিকে বাস্তবে ৫ লক্ষ ৮ হাজার ৯২৫ ইউরো হস্তান্তর করা হয়েছে।
মিডিয়াপার্টের প্রতিবেদন এটাও দেখিয়েছে যে, ফরাসি এবং ভারতীয় তদন্তকারীরা তথ্য নিয়ে আপসের একটা ‘গ্রেট ডিল’ আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু বিষয়টাকে দু’দেশেই কবরে পাঠানো হয়েছে।
একটা অভিযোগ যতটা নির্দিষ্ট হতে পারে এটা ঠিক ততটাই নির্দিষ্ট। রাফাল ডিল নিয়ে সত্য উদ্ঘাটন হবেই। আর সেটা যতদিন না হচ্ছে ততদিন সরকারকে তাড়া করে ফিরবে রাফালের ভূত।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত