অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
‘কী বিশেষত্ব?’
‘জীবনে এই প্রথম একটা বাটি দেখলাম যেটাকে সোনার পাথরবাটি বললে খুব ভুল বলা হয় না।’
জয়সলমিরের মানুষ বাংলা সম্পর্কে প্রথম যে শব্দবন্ধটি শেখে, সেটি একটি নাম—সত্যজিৎ রায়। ‘সোনার পাথরে’ তৈরি বাটি-ঘটি বিক্রির খুব সাধারণ দোকানে গিয়েও দেখেছি, সত্যজিৎ রায়ের ছবি টাঙানো। জয়সলমির মনে করে, দেশের দরবারে... বিশ্বের আঙিনায় তাদের শহরকে যদি কেউ সবার আগে তুলে ধরে থাকেন, তিনি সত্যজিৎবাবু। তাঁর সোনার কেল্লা। কিন্তু আজ রাজস্থান, বা অন্য রাজ্যগুলি একটি নতুন শব্দবন্ধ শিখেছে... ‘সুনার বাংলা’। সৌজন্যে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলার ভোট মরশুমে মোদিজি অহরহ ভিজিট দিচ্ছেন, আর রবি ঠাকুরের সোনার বাংলাকে ‘সুনার’... ‘সুনার’ বলে রসিকতা করছেন। রসিকতা বলব না? তাহলে কী বলা যায় একে? অন্য কোনওভাবে ব্যাখ্যা করা গেলে পরামর্শ প্রার্থনীয়।
নরেন্দ্র মোদি হপ্তায় দু’বার এলে তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড অমিত শাহ আসছেন পাঁচবার। নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগে তিনি বঙ্গ বিজেপির বৈঠকে সাফ বলেছিলেন, একটা মাছিও গলতে দেব না। কিন্তু বাকি কাজ আপনাদের করতে হবে। চার দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পর বোঝা যাচ্ছে এই মন্তব্যের মর্ম। সত্যিই মাছি গলার জো নেই। গলতে গেলে যে গুলি চলবে! আর সে গুলি পায়ে লাগবে না... বিদ্ধ হবে গলায়, বুকে। আর ‘বাকি কাজ’ নেতারা করছেন। ধর্মীয় মেরুকরণ, উস্কানি, রাজনৈতিক সৌজন্য-সুস্থতা ঝেড়ে ফেলে কুৎসিত প্রচার। এটাই একুশের ভোটযুদ্ধের সারসত্য। জনসভায় ভিড় হোক না হোক, তাঁরা আসবেন। দিল্লি থেকে নির্দেশও আসবে। কোটি কোটি টাকা খরচ হবে। আর বিনিময়ে? চলবে বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির তুলোধোনা... নিরন্তর। এও এক বিষম রসিকতাই বটে!
আমিদুল মিঞা, সামিউল হক, মণিরুজ্জামান মিঞা, নুর আলম হোসেন... এঁদের সঙ্গে যা হল, তাকে কী বলা যায়? রাজনীতি? ক্ষমতা হাসিলের লক্ষ্যে ইগোর বহিঃপ্রকাশ? নাকি এও চরম এক রসিকতা? বঙ্গ বিজেপির সর্বময় কর্তা না হলে বলেন কীভাবে... ‘বাড়াবাড়ি করলে জায়গায় জায়গায় শীতলকুচি হবে।’ সায়ন্তন বসু, রাহুল সিনহা... সবার এক রা। ‘শীতলকুচি হবে... আবার’। নির্বাচন কমিশন ওইদিন, মানে ১০ তারিখ একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কাগজে। অমর জওয়ান জ্যোতির ছবি, কমন ম্যানের কার্টুন, আর একটা বার্তা... তাঁরা দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, আর আপনারা দেশের জন্য ভোট দিতে পারবেন না? ভোটদান শুধু অধিকার নয়, কর্তব্যও। ঠিক কথা। কর্তব্যই তো করতে গিয়েছিলেন মণিরুজ্জামানরা। যদিও কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি, ভোট দিতে নয়... ওরা গিয়েছিল আক্রমণ করতে। বাহিনীকে ঘিরে ধরতে। ওদের কাছে ছিল অস্ত্র... বোমা, বন্দুক। একজন নাকি পিস্তল বের করতে যাচ্ছিল, গুলি তখনই চালাতে হয়। কিন্তু এখানেও যে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসছে! যে ‘ভোটার’ পিস্তল বের করছিল, তাকে লক্ষ্য করেই কি গুলি ছোড়া হয়েছে? হয়ে থাকলে তার সেই অস্ত্রটি কোথায়? স্থানীয় থানায় কি কেন্দ্রীয় বাহিনী তা জমা দিয়ে কোনও কেস রেজিস্টার করেছে? আর জনতা ঘিরে ধরলে, বা হামলা চালালে তো প্রথম কাজ লাঠিচার্জ। তারপর কাঁদানে গ্যাস এবং শেষে গুলি... তাও কোমরের নীচে। গলায় বা বুকে নয়। তাহলে এমন কোন সন্ত্রাসবাদী সেদিন শীতলকুচির ১২৬ নম্বর বুথে হাজির হয়েছিল যে, বাহিনীকে ‘এনকাউন্টার’ করতে হল? প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ওদের ভোটের লাইনে দেখা গিয়েছিল। ওই বুথেরই ভোটার ছিল তারা... সাধারণ নাগরিক। সন্ত্রাসবাদী নয়। এটা পাকিস্তান বা চীন সীমান্তের যুদ্ধক্ষেত্র নয়। আরও একটা মোক্ষম প্রশ্ন এই হত্যালীলার নেপথ্যে ঘুরছে... গুলি চালানোর অর্ডার কে দিয়েছিল?
নেপথ্য কারণের ময়নাতদন্ত সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ কোনও ফুটেজ দেখেনি, কোনও রাজনৈতিক নেতা (পড়ুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) সেখানে পৌঁছতে পারেননি। আড়ালে রয়েছে সবটা। কেন? পুলিস সুপার তাঁর বক্তব্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রতি সমর্থন দেখিয়েছেন। কিন্তু লাঠিচার্জ না করে আগেই বন্দুক কেন? এর উত্তর দেননি তিনি। পুলিস কর্তা এখন নির্বাচন কমিশনের অধীন। কেন্দ্রীয় বাহিনীও তাই। কিন্তু এই চার দফা ভোট পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন যে যে নির্দেশনামা জারি করেছিল, তার কোথাও কিন্তু গোলমাল দেখলেই বুকে গুলি করার মতো স্ট্যান্ডিং অর্ডার ছিল না। তাহলে নেপথ্যে কে? প্রশ্নটা আমার, আপনার, সকলের। সাধারণ মানুষের। ভোটারের। পঞ্চম দফা ভোটের আগে বাংলার প্রত্যেক ভোটার জানতে চায়, কেন হল শীতলকুচি? কোন সাহসে রাজনৈতিক নেতারা বলতে পারছেন, ‘আরও হবে শীতলকুচি’? কেন নির্বাচন কমিশন এই নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না? তাঁরা কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রতিনিধি বলে? নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাম্প্রদায়িক বক্তৃতার জন্য নোটিস ধরিয়েই তাদের কর্তব্য শেষ হয়ে গিয়েছে? দেশের মানুষ, বাংলার মানুষ তাদের কর্তব্য জানে। ভোট দিতে চায়। কিন্তু বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে তাঁদের প্রতি কী বার্তা দিতে চাইছেন কমিশনের কর্তারা? কেন্দ্রীয় বাহিনী তো সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনের জন্য! হাজারে হাজারে তাঁরা এসেছেন... বিভিন্ন রাজ্য থেকে... সীমান্ত থেকে। তাঁদের পাহারায় তাহলে কেন আম বাঙালি নিশ্চিত হতে পারছে না? কেন বৃদ্ধ বাবা তার জোয়ান ছেলেকে বলছে, ‘ভোট দিতে যাবি? ফিরে আসবি তো?’
এটাই চাইছে না তো গেরুয়া শিবির? ‘নিশ্চিত ভোটার’ যাঁরা, তাঁরাই পৌঁছবেন বুথে। বাকিদের আসার প্রয়োজন নেই। যদি এই যুক্তি সত্যি হয়, গণতন্ত্রকে সর্বসমক্ষে ধর্ষণ করা হচ্ছে। আর আমরা তা দাঁড়িয়ে দেখছি। দেশজুড়ে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে... দোষ দিচ্ছি রাজ্যগুলিকে। নিত্যপণ্যের দামে শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দু জল হয়ে যাচ্ছে... তারপরও বলছি, রাজ্যগুলির কিছু করা উচিত। রান্নার গ্যাস, পেট্রল-ডিজেল, আবার লকডাউনের বিষাক্ত হাতছানি, অনাহার... তারপরও কেন্দ্রের মোদি সরকারের এতটুকু খুঁত আমাদের নজরে আসছে না। গোরুর রচনার মতো একমুখী এক উপসংহার আমাদের মনে যেন গেঁথে গিয়েছে... কেন্দ্রের দোষ নেই, রাজ্যে পরিবর্তন আনতে হবে।
অদ্ভুত এক সম্মোহনের জালে আমরা আজ আবিষ্ট। ‘ডবল ইঞ্জিনে’র মোহে ছুটে চলেছি। এখনও নাকি বাংলার বাতাসে বিজেপি-বিজেপি হাওয়া! আমরা কেন সেই হাওয়ায় বারুদের গন্ধ পাচ্ছি না? করোনায় আক্রান্ত হলে স্বাদ-গন্ধ চলে যায়। গোটা বাংলার নিশ্চয়ই করোনা হয়নি? অমিত শাহ শীতলকুচির ১২৬ নম্বর বুথেই আবার আনন্দ বর্মনকে এনে ফেলেছেন। দাবি করেছেন, আনন্দের মৃত্যু হয়েছিল ওই বুথে ভোট দিতে গিয়েই... সকালে।
তার থেকেই নাকি পরিস্থিতির উত্তাপ। ফলাফল? বাহিনীর গুলি। তিনি বললেন, গোটা দেশ শুনল। যাঁরা জানে না, বিশ্বাসও করল। কিন্তু আমরা তো জানি! ওই ঘটনা অন্য বুথের। পাঠানটুলি এলাকার। তারপরও আমরা চুপ করে থাকব?
আমরা বাঙালি... সাধারণ বাঙালি। ক্ষমতা, প্রতাপ, দাপট... এসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেখাতে পারি না। সেই বুকের পাটা আমাদের নেই। আমরা শুধু পারি কর্তব্য করতে... ভোট দিতে। তার জন্যই এত রাজসূয় আয়োজন। কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ। মহামারীর আবহে আট দফার ধ্যাষ্টামো। সংক্রমণের আশঙ্কা গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়িয়ে দেওয়া। আর সবশেষে একটি বাক্য... ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ একটা বিষয় খুব ভালো জানেন... শিখতে। যার যা ভালো, সেটা তুলে নাও। বাকিটা ফেলে দিলেও চলবে। বা বলা ভালো ফেলে দিতে হবে। ততটুকুই নেব, যতটা দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি হবে। মানুষ বিপুলভাবে ভোট দিতে গেলে যদি স্বার্থসিদ্ধি না হয়, তাহলে তাঁদের ভোট না দিলেও চলবে। তাঁরা দায় চাপাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। বলবেন, উনি উস্কানি দিয়েছেন বলেই তো এমনটা হচ্ছে! ঠিক যেমন তাঁরা বলেন, মেয়েরা ছোট পোশাক পরে বলেই ধর্ষণের শিকার হয়! একটা নোংরা মানসিকতা... যা সমাজের অন্দরটা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। আমরাও অনেকে তাঁদের এই মানসিকতার জুতোয় পা গলিয়ে মেয়েদের ছোট পোশাককেই দোষারোপ করি। বাড়ির ছেলেকে শিক্ষা দিই না! ভোটের দিন গুলি চললেও তাই দোষী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বা নিরীহ গ্রামবাসীরা। যারা গুলি চালাল, বা চালানোর অর্ডার দিল... তারা নয়।
তবু আমরা ভোট দেব। পঞ্চম দফাতেও। আতঙ্ক দূরে সরিয়ে যাব বাড়ির কাছের বুথটায়। ইভিএমের বোতামে চাপ দেব, আর ভিভিপ্যাটে দেখব... যাঁকে ভোটটা দিয়েছি, ঠিক তাঁর ঘরেই আমাদের ‘মতামত’ জমা পড়েছে কি না। আর তখন মনে পড়বে মণিরুজ্জামানদের। মনে রাখব সীতা মাইয়াকে। সোনার হরিণের মোহে লক্ষ্মণরেখা পার হয়েছিলেন তিনি। রাবণের কারাগারে বন্দি হতে হয়েছিল তাঁকে।
সোনার হরিণ হয় না। হতে পারে না। ওটা ধাঁধা। বাংলাতেও এমন এক ‘সুনার বাংলা’র ট্রেলার চলছে... রক্তাক্ত সেই ট্রেলার। পুরো ছবিটা তাহলে
কী হতে চলেছে?