অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
‘আমাকে আঘাত করলে আমি করি প্রত্যাঘাত। ভয়ে ঘরে ঢুকে যাওয়ার লোক আমি নই। আমি স্ট্রিট ফাইটার।’ কথাগুলি কার, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। কারণ বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে ১০ বছর কাটানোর পরেও যিনি প্রবল পরাক্রমশালীর চোখে চোখ রেখে কথা বলার ধৃষ্টতা দেখান, তিনি আর কেউ নন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আন্দোলন যাঁর রক্তে, ‘অগ্নিকন্যা’ যাঁর ভূষণ তাঁকে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা বৃথা। আর সেটা তিনি দেখিয়েও দিলেন।
নির্বাচনের আগে প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট নেতানেত্রীদের কাছে মহার্ঘ। সেখানে ২৪ ঘণ্টা কাউকে প্রচার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার নির্দেশ যথেষ্টই চাপের। বিশেষ করে তিনি যদি হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দলের একমাত্র ‘স্টার ক্যাম্পেনার’। তাহলে দল বিপাকে পড়ে বইকি! কারণ তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয় তৃণমূল কর্মী সমর্থকদের আবেগ, উচ্ছ্বাস। ৪০ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মাথায় নিয়েও মানুষ অবলীলায় তাঁর পথ চেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় কাটিয়ে দেন। এহেন নেত্রীর প্রচারের উপর কমিশনের ২৪ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা জারি! তবে শাস্তি নয়, শাস্তি ঘোষণার সময় নিয়েই বেশি চর্চা।
শীতলকুচির ঘটনার উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য পঞ্চম দফার ৪৫টি আসনের প্রচার ৪৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ৭২ ঘণ্টা আগেই শেষ করার নির্দেশিকা জারি করেছিল কমিশন। তার সঙ্গে যুক্ত হল মুখ্যমন্ত্রীর উপর ২৪ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা। এর অর্থ, তৃণমূল সুপ্রিমোর প্রচারের মেয়াদ নির্দিষ্ট সময়ের ৪৮ ঘণ্টা আগেই শেষ। ভেস্তে গেল পঞ্চম দফার ভোট প্রচারের তাঁর সমস্ত পরিকল্পনা।
কথায় আছে, শিরে হইলে সর্পাঘাত তাগা বাঁধি কোথায়? সঠিক সময়ে মোক্ষম আঘাত হানলে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগটুকুও থাকে না। পরিকল্পনা ছিল অনেকটা তেমনই। কিন্তু, আক্রমণের লক্ষ্য যদি হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সবকিছুই তালগোল পাকিয়ে যায়। কারণ লড়াই তাঁর রক্তে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকাই তাঁর স্বভাব। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূল করায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আক্রমণের মুখে পড়ে আত্মসমর্পণ নয়, নতুন করে লড়াইয়ের রণসজ্জা সাজানোই তাঁর ঐতিহ্য। তাই কমিশনের সিদ্ধান্তের ‘নীরব প্রতিবাদ’। গান্ধী মূর্তির তলায় ধর্না। তারপর থেকে তিনিই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। শুধু বঙ্গে নয়, দেশজুড়ে শুরু হল প্রতিবাদ।
শিবসেনার রাজ্যসভার সদস্য সঞ্জয় রাউতের কথায়, নির্বাচন কমিশন স্পষ্টত বিজেপির পক্ষ নিয়েই পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব লিখলেন, ‘বাংলায় বিজেপি সম্ভবত বুঝে গিয়েছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তারা পরাস্ত হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আসলে বিজেপির হতাশারই প্রতীক।’ বিরোধীদের আক্রমণের ফলায় স্বশাসিত নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার পর্দা হল ছিন্নভিন্ন। গায়ে কি লেগে গেল গেরুয়া রং?
রাজ্যে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্যই নাকি আট দফার ভোট। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোট ঘোষণার সময় কমিশনের দাবি অন্তত তেমনটাই ছিল। নির্বাচন কমিশন যে এবার বেশ আঁটঘাট বেঁধেই নামতে চলেছে, তার পূর্বাভাস মিলেছিল বিজেপি নেতাদের কথাবার্তায়। তাঁরা প্রতিদিন সভায় গিয়ে দলীয় কর্মীদের বলেছিলেন, এবার আর দিদির পুলিস নয়, ভোট করাবে ‘দাদার পুলিস’। সুতরাং এবার পশ্চিমবঙ্গে ‘অন্যরকম’ ভোট হবে।
একেবারে হক কথা বলেছেন। বাংলার ভোট এবার সত্যিই অন্য রকম। দাদার পুলিসের ‘দাদাগিরি’ দেখলেন বাংলার মানুষ। চতুর্থ দফাতেই ‘দাদার পুলিসে’র গুলিতে চারজনের মৃত্যু। ভোটের আগে এই ‘দাদার পুলিসে’র কথাই বড়মুখ করে বলে বেরিয়েছিলেন বিজেপি নেতারা। তাই শীতলকুচির ঘটনায় জওয়ানদের পাশে দাঁড়ানো তাঁদের ‘নৈতিক কর্তব্যে’র মধ্যেই পড়ে। সেই কারণে কেউ বলছেন, ‘দিকে দিকে শীতলকুচি হবে।’ কেউ বলছেন, ‘গুলি করে আটজনকে মারা উচিত ছিল।’ নেতাদের এই ‘নির্লজ্জতা’য় সন্দেহ জাগে, তাহলে সত্যিই কি ‘দাদার পুলিস’ নির্বাচনে বিজেপির হয়ে কাজ করছে?
তবে বুথ রক্ষার দায়িত্ব ছিল যাদের উপর তারা চারজনকে গুলি করে মারার পর হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তাদের নাকি দীর্ঘক্ষণ বুথের ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। এই যদি ‘দাদার পুলিসে’র নমুনা হয়, তাহলে বাসের সিটের উপরে ‘মাল নিজ দায়িত্বে রাখবেন’ লেখাটা মাথায় রেখে ভোট দিতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
আট দফার নির্বাচন করে পশ্চিমবঙ্গের ভোট কতটা অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ হল, সেটা জানার জন্য ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে, করোনা আবহে এক মাসব্যাপী নির্বাচন রাজ্যের যে বিপুল ক্ষতি করল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাংলা দখল যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাখির চোখ, তা অনেক আগেই বোঝা গিয়েছে। বাংলা দখলের জন্যই তাঁর বারবার বঙ্গে উড়ে আসা। শুধু বাংলায় নয়, মতুয়া ভোটের আশায় বাংলাদেশেও ছুটেছেন। তাঁর সভায় হাজার হাজার মানুষ ভিড় করছেন। ৪০/৪৫ মিনিট ধরে ভাষণ দিচ্ছেন। পাঁচবার ‘দিদি অ দিদি’ বলে ব্যঙ্গ করছেন। কিন্তু, তিনি তাঁর প্রিয় কর্মী সমর্থকদের করোনা নিয়ে একটি বারও সতর্ক করছেন না। অথচ এই মানুষটাই দিনের পর দিন টিভির সামনে বলে গিয়েছেন, ‘দো গজ কি দোরি, মাস্ক হ্যায় জরুরি।’
দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ায় প্রধানমন্ত্রীর দিকে উঠছে অভিযোগের আঙুল। হু হু করে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। লখনউয়ে সারি দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে দেহ। কোথাও আবার শ্মশান ঢেকে দেওয়া হচ্ছে টিন দিয়ে। মমতার অভিযোগ, ‘এতদিন সুযোগ পাওয়ার পরেও প্রধানমন্ত্রী ভ্যাকসিনের ব্যাপারে তেমন উদ্যোগীই হননি। দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে অন্য দেশে ভ্যাকসিন পাঠিয়েছেন।’ মুখ্যমন্ত্রীর বোঝা উচিত, যিনি থালা বাজিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে করোনা তাড়ানোয় বিশ্বাসী, তিনি ভ্যাকসিনকে খুব বেশি গুরুত্ব দেবেন, এমনটা ভাবা ঠিক নয়।
মুখ্যমন্ত্রীর আরও অভিযোগ, ‘রাজ্যকে কেন্দ্র ভ্যাকসিন দিচ্ছে না, আবার বাইরে থেকে কেনার অনুমতিও নেই। কেন্দ্রের নিয়মের জন্যই রাজ্যবাসীর দুর্ভোগ।’ তবে, এই সমস্ত অভিযোগ তোলার আগে প্রধানমন্ত্রীকে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার ছিল। চায়ের দোকান থেকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক। তাই পরবর্তী ধাপ আন্তর্জাতিক নেতা হওয়া। সেই লক্ষ্যেই ট্রাম্পকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট করার জন্য ঝাঁপিয়ে ছিলেন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমেরিকায় ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানে প্রবাসী ভারতীয়দের সামনে আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘আগলিবার ট্রাম্প সরকার।’ তাতে হাততালি পেয়েছিলেন প্রচুর। কিন্তু গোহারা হয়েছিলেন ট্রাম্প। আমেরিকাও বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রচার নয়, ভোটের সময় গুরুত্ব পায় কাজ।
তবুও মোদিজির সেই প্রচারের উপরেই আস্থা। তা সে চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণ অভিযান হোক বা করোনার ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন তৈরি করলেন কারা? বিজ্ঞানীরা। ভ্যাকসিন দেবেন কারা? নার্সরা। রোগীদের পর্যবেক্ষণ করবেন কারা? ডাক্তাররা। আর সার্টিফিকেটে ছবি ছাপা হবে কার? যশস্বী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির। ১৩০ কোটি মানুষের পকেটে পৌঁছে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। জীবিত অবস্থাতেই মোদির নামে নামকরণ হয়েছে স্টেডিয়ামের। তাঁর পক্ষে এমন সুযোগ হাতছাড়া করা শোভা পায়?
করোনা বাড়তেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি, বাকি তিন দফার ভোট একবারে হোক। কিন্তু বিজেপি সেই আট দফাতেই অনড়। মমতা চান, বাংলার মানুষ থাকুক সুরক্ষিত। বিজেপির লক্ষ্য, বঙ্গ দখল। ফারাকটা এখানেই।