মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
পাশেই উত্তেজিত ভঙ্গিতে মোবাইলে রানিং কমেন্ট্রিতে ব্যস্ত এক মাঝবয়সি ভক্ত। সেলফি মোডে ধরে রাখছেন, ‘এয়ারপোর্টের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এখনই বেরিয়ে আসবে আমাদের মা, মোহন বাগান দলের চ্যাম্পিয়ন ফুটবলাররা।’ সোশ্যাল মিডিয়ার জমানায় এই মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি না করলে হয় নাকি!
কারও কাছে মা, কারও কাছে সন্তান। কারও কাছে যৌবনের উপবনও। খিদিরপুরের বছর তিরিশের রবিন পাইতের গালে যেমন প্রিয় দলের রঙ। দু’হাতে মাথার উপর তুলে ধরা ট্রফির কাটআউট। তাতে লেখা ‘ভারত সেরা মোহন বাগান। ন্যাশনাল ক্লাব অব ইন্ডিয়া।’ কোলে বছর চারেকের মেয়ে, মধ্যমগ্রাম থেকে হাজির বিশ্বনাথ দাস। প্রিয় ক্লাবের পতাকা কাঁধে বাগুইআটির শচীন রজক। খানিক দূরে সবুজ-মেরুন শাড়িতে হাজির বছর পঞ্চাশের গৃহবধূ। আবির খেলায় লিপ্ত চতুর্থ শ্রেণির ধ্রুবরাজ আচার্য্য আর সপ্তম শ্রেণির অভিরাজ মান্না। নাতনির হাত ধরে ভিআইপি রোডে টিমবাসের পাশে পাশে ফুটপাথে হাঁটতে থাকা সত্তরোর্ধ দাদু। বিকেলে ময়দানের ক্লাব তাঁবুতে কাঠের বেঞ্চে বসে থাকা বয়স্কদের বিমানবন্দরে সেলিব্রেশনের বর্ণনায় মগ্ন সবুজ টি-শার্ট পরিহিতা তরুণী। গ্যালারির নীচে প্রীতমের জার্সি পরা ছোট্ট সাম্রাজ্ঞী গোস্বামী। উৎসবের আবহেই সবুজ লনে উড়ল আবির, চলল সবুজ রসগোল্লা বিতরণ।
টুকরো টুকরো ছবিতেও মিল একটাই— উপচে পড়া আবেগ। খুশির তুফান হয়তো একেই বলে। না হলে কোন জাদুমন্ত্রে আট থেকে আশি, বয়স নির্বিশেষে এমন পাগলপারা আনন্দে দিনভর মেতে থাকেন সমর্থকরা!
সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। সাড়ে এগারটা নাগাদ নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। প্রীতম, দিমিত্রি, কেইথদের বরণের জন্য সমর্থকরা আসবেন তো? দুরু দুরু আশঙ্কা দানা বাঁধছিল। সপাটে তা উড়িয়ে দিলেন ভাটপাড়া থেকে আসা রাজীব দে, ‘দূর, এমন দিনে ঘরে বসে থাকা যায় নাকি। আসতেই হবে। এ যে নাড়ির টান!’ সত্যিই তো। কোচ হুয়ান ফেরান্দোর গলায় যখন টিমবাসের জানলার ফাঁক গলে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রজনীগন্ধার মালা, তখন কোন মন্ত্রবলে উপস্থিত কয়েক হাজার সমর্থক। ‘জয় মোহন বাগান’ চিৎকারে কান পাতা দায়। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের ক্রমাগত ঝলকানি, মুহুর্মুহু স্লোগান, তুমুল নাচে উৎসবের আমেজ।
হলদিরামের মোড়ে দেখা গেল রাস্তা আটকে শুয়ে পড়েছেন অনেকে। টিমবাস যেতে দেবেন না। ভালোবাসার পাগলামি আর কী! ততক্ষণে চলন্ত বাইক আর স্কুটি থেকে হচ্ছে যাত্রাপথের ভিডিও। গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে তারস্বরে বাজছে গান, ‘আমাদের সূর্য সবুজ মেরুন।’ কিন্তু টিমবাস যে আর এগয় না। দমবন্ধকরা যানজট দেখে চটজলদি বদলানো হল রুট। উল্টোডাঙা নয়, স্টিয়ারিং ঘুরল রাজারহাট নিউটাউনের পথে। ইস্ট বেঙ্গলের টিম হোটেলের পাশ দিয়েই তা এল। কে জানে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিজয়োল্লাস কোচ স্টিফেন কনস্টানটাইনের কানে পৌঁছল কিনা!
মেঘের গর্জন অবশ্য একসময় ভয় ধরিয়েছিল। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিপথ, কোনও অঘটন হবে না তো? আবেগের কাছে হার মানল প্রকৃতি। আকাশভাঙা বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বাইক বাহিনী এল পিছু পিছু। জার্সি ভিজে চুপচুপে, জবজবে পতাকাও। পরম মমতায় তা গায়ে জড়িয়ে নিল টগবগে তরুণরা। ঝড়, বৃষ্টির চোখরাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। এই না হলে ফুটবলপ্রেম!
সন্ধ্যার মুখে প্রিয় ক্লাবে পৌঁছে গেল বেহালার ফ্যানদের রাত জেগে বানানো বিশাল পালতোলা নৌকা। প্রবীণরা বললেন, বাদলা দিনে এবার দিব্যি ভাসবে তরী। বৃষ্টিস্নাত রবিবাসরীয়তে এমন প্রাণঢালা আবেগই জ্বালাল ভালোবাসার সবুজ-মেরুন রংমশাল!