উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
রিভোনা নামে এক ছোট জনপদ পেরিয়ে প্রায় ষোলো কিলোমিটার যাওয়ার পর ডানদিকে একটা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দেওয়া ছোট দিকনির্দেশ দেখা গেল। গ্রামে লোকেদের থেকে খবর নিয়ে আমার গাড়ি ঢুকে পড়ল লোকালয়বিহীন বড় বড় হলুদ হয়ে যাওয়া ঘাসের জঙ্গলে মেঠো পথে। মাঝে মাঝে জমা জলে আঁকা হ্রদের রূপ নেওয়া পরিত্যক্ত লোহার খনি পেরিয়ে গাড়ির রাস্তা শেষ হল এক নির্জন জায়গায়। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে একটু এগিয়ে গেলেই একটা ছোট খড়ের ছাউনি। দেখা হল আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে নিযুক্ত চৌকিদারের সঙ্গে। আমার অভিপ্রায় শুনে নামধাম নথিভুক্ত করে নিয়ে গেল ঘন জঙ্গল ঘেরা একটি ফাঁকা জায়গায়। আমরা এসে দাঁড়ালাম অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকা একটা চ্যাটালো ল্যাটেরাইট পাথরের চাতালের ওপর। অদূরে ছোট নালার মতো আঁকাবাঁকা বয়ে চলেছে হাঁটুডোবা স্বচ্ছ জলের কুশাবতী নদী। উনিশশো তিরানব্বই সালে কুশাবতী নদীর তীরের একাংশের মাটি বন্যায় ধুয়ে গিয়ে বেরিয়ে আসে নীচের এই চ্যাটালো ল্যাটেরাইট পাথর। আর তখনই সবার নজরে আসে আট হাজার থেকে নয় হাজার বছর আগে মানুষসৃষ্ট এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। দেখা যায় সেই পাথরের বুকে খোদাই করে আঁকা আছে নানা জীবজন্তু, মানুষের রেখাচিত্র। তখনও লৌহযুগ আসেনি, তাই ধরে নেওয়া হয় ধারালো আর সুচালো পাথর দিয়ে খোদাই করে এই লৌহসমৃদ্ধ ল্যাটেরাইট পাথরের ওপর প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা ওদের চেনা জগতের রেখাচিত্র তৈরি করেছিল।
চৌকিদারের হাতে ছিপির মুখ ছিদ্র করা প্লাস্টিকের বোতলে কুশাবতী নদী থেকে সদ্য ভরে আনা জল। তাতে চাপ দিয়ে সরু জলের ধারা সেই ধুলোর আস্তরণে ঢাকা রেখাচিত্রের রেখার ওপর ফেলে সে ফুটিয়ে তুলছিল একে একে হাতি, ষাঁড়, বাইসন, ময়ূর, হরিণ, কুকুর এমনকী মানুষের
অবয়ব-ও। অবাক করে দেয় অদ্ভুত গোলোকধাঁধার মতো একটি রেখাচিত্র। তারই কাছে মানুষের পায়ের মতো বড় বড় পায়ের রেখাচিত্র কেন খোদাই করা হয়েছিল কে জানে। ঘন জঙ্গল আর ছোট নদী ঘেরা এই নির্জন পরিবেশে পাখিদের কলতান ছাড়া কোনও শব্দ নেই। আমি ছাড়া কোনও পর্যটকও নেই। আপাতদৃষ্টিতে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগশূন্য এই জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হতেই পারে এই চ্যাটালো পাথরে শুয়ে কান পাতলে বুঝি শোনা যাবে হাজার হাজার বছর আগেকার বন্যপ্রাণীদের খুরের আওয়াজ, শোনা যাবে প্রাগৈতিহাসিক নর, নারী ও শিশুর কলকোলাহল।
চৌকিদার জানায় ভারতীয় পর্যটকদের পদধূলি এখানে কমই পড়ে, তবে বিদেশিদের আসা যাওয়া লেগেই থাকে। অনেক ভারতীয় পর্যটক নাকি এখানে বেড়াতে এসে ওই গোলোকধাঁধা রেখাচিত্রকে পুজো করে, কেউ বা ওর ওপর বসে ধ্যান করে! কুশাবতী নদীর স্বচ্ছতোয়া জলে ছোট ছোট মাছের দল খুঁটে খুঁটে নুড়িপাথরের গায়ে লেগে থাকা শ্যাওলা খাচ্ছে। জুতো খুলে সেই জলে পা রাখতেই শরীর ঠান্ডা। নদী পেরিয়ে ওপারে জঙ্গলের মধ্যে একটি স্পাইস ফার্ম। সেখানে গিয়ে আলাপ হল ফার্মের মালিক কাকোদকার সাহেবের সঙ্গে। ঘুরিয়ে দেখালেন কীভাবে জৈব পদ্ধতিতে নারকোল, সুপারি, এলাচ, গোলমরিচ ইত্যাদি চাষ করছেন। দেখলাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গোয়ালঘরে অনেক গোরু। জানলাম সেইসব গোরুর গোবর শুধু চাষের কাজেই লাগে না, তা থেকে তৈরি গোবরগ্যাস ফার্মে জ্বালানির কাজে লাগে। পাথরের ওপর প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের খোদাই করা রেখাচিত্র দেখার জন্যই আমি এদিকে এসেছি জেনে কাকোদকার সাহেব একটি স্থানীয় লোক সঙ্গে দিয়ে দিলেন। ওর সাহায্যে কাছেই আরও একজায়গায় ল্যাটেরাইট পাথরের ওপর দেখলাম একটি মনুষ্যপরিবারের রেখাচিত্র। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল মাটি সরলে পুরো জায়গাটাতেই এরকম আরও অনেক শিল্পকর্ম বেরিয়ে আসবে। ফেরার সময় রিভোনা-তে দুটি প্রাচীন গুহা আর একটি ঝর্ণা দেখে সোজা পানাজির পথ ধরলাম।
কীভাবে যাবেন
পানাজি থেকে মারগাঁও, তারপর মারগাঁও কুয়েপেম রোড ধরে রিভোনা। রিভোনা থেকে সানগুয়েম অঞ্চলে উসগালিমাল গ্রাম। সেখানে সাইনবোর্ড দেখে মূল রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে এক কিলোমিটার মতো গেলেই পড়বে কুশাবতী নদীর অভীষ্ট তীর। ভাড়া গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। সময় লাগে ঘণ্টা দুই। পানাজি থেকে দিনে দিনেই ঘুরে আসা যায়।
কখন যাবেন
বর্ষা বাদে যে কোনও সময়।
ছবি: লেখক