ব্যবসায়িক কাজকর্ম ভালো হবে। ব্যবসার প্রসারযোগও বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় সন্তানের বিদেশ গমনের সুযোগ আসতে পারে। গৃহশান্তি ... বিশদ
করোনার প্রকোপ নিম্নগামী হওয়ার পরে ঠিক করেছিলাম প্রতিবেশী রাষ্ট্র, নেপাল ঘুরে দেখব। ইচ্ছেটা ছিল বহুদিনের। সেই মতো খোঁজখবর শুরু হল। অবশেষে এক ট্র্যাভেল এজেন্সির ব্যবস্থাপনায়, দুর্গাপুজোর রেশ কাটিয়ে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে নেপালের উদ্দেশ্যে আমরা রওনা দিলাম। সাতাশ জনের দলটি হাওড়া থেকে মিথিলা এক্সপ্রেস চড়ে পৌঁছলাম বিহারের রক্সৌল স্টেশনে। সেখানেই কয়েক ঘণ্টার বিরতি নিয়ে বীরগঞ্জ (ভারত ও নেপালের বর্ডার শহর) পার হয়ে প্রবেশ করলাম চিতওয়ান জাতীয় অরণ্যে। জঙ্গল লাগোয়া এক লজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। উপরি পাওনা এখানকার উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকনৃত্য দর্শন।
পরের দিন চিতওয়ানের জঙ্গল ভ্রমণ। দূর নীলাকাশের প্রান্ত ঘেঁষে সার বেঁধে মৌন ঋষির মতো ধ্যানমগ্ন তুষারশৃঙ্গগুলি নজরে এল প্রথমেই। চিত্ত পুলকিত। আনন্দে আত্মহারা আমরা।
তবে প্রকৃতি মন ভরিয়ে দিলেও পশুদের তেমন দেখা পেলাম না। অরণ্যপথে মাত্র কয়েকটি চিতল হরিণ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। পথের পাশে বয়ে চলা নালাপথে কুমিরের উঁচু মাথা ক্ষণিকের জন্য ধরা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু খুব ভালো করে নজর করার আগেই জলে মিলিয়ে গেল সে। মধ্যাহ্নভোজ সেরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য তথাগতর জন্মস্থান, পুণ্যভূমি লুম্বিনী। অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়া পেলাম যেন। শাক্যরাজা শুদ্ধোধন ও রানি মায়াদেবীর পুত্র সিদ্ধার্থর জন্মস্থান এই লুম্বিনী! উত্তর জীবনে সিদ্ধিলাভ করে সিদ্ধার্থ হন গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধের জন্মের প্রায় সাতশত বছর পর তীর্থপথে সম্রাট অশোক আসেন লুম্বিনীতে। বুদ্ধের জন্মস্থান স্মরণীয় করে তোলার জন্য তিনি একটি স্তম্ভ নির্মাণ করেন এই স্থানে। দীর্ঘ সময় অজ্ঞাত থাকার পর ১৮৯৬ সালে খাদা সামশের-এর উদ্যোগে খননের সময় অশোক স্তম্ভটি আবিষ্কৃত হয়। সেই সঙ্গে লুম্বিনী যেন নতুন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লুম্বিনীর এলাকায় ঘুরে বেড়িয়ে, বুদ্ধের জীবন, উত্তরণ এবং কীভাবে বৌদ্ধধর্ম ক্রমাগত বিকাশ লাভ করেছিল তার সম্যক ধারণা গড়ে তোলার চেষ্টা করলাম আমরা। মূল মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের প্রশান্ত মূর্তি বিরাজমান। অদূরে শাশ্বত দীপশিখা বা ‘ইটারনাল পিস ফ্রেম’। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ৬২টি স্থান আবিষ্কার করেন, যেখানে বেশ কিছু স্তূপের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারকোণা পুষ্করিণীটি। জনশ্রুতি, রানি মায়াদেবী, পুত্র সিদ্ধার্থের জন্মের পূর্বে এই পুকুরে স্নান করেন। বর্তমানে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে দেখলাম। এছাড়া ‘তিলৌরাকোট’ অঞ্চলটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে কপিলাবস্তুর রাজধানী হিসেবে। প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে একটি ঢিবির নীচে। লোকশ্রুতি, বৌদ্ধত্ব লাভের পর সিদ্ধার্থ হলুদ বস্ত্র পরিধান করে তার পিতা রাজা শুদ্ধোধনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এই স্থানে।
ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর তকমা পাওয়া লুম্বিনী উদ্যান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান রূপে পরিচিত। লুম্বিনী ডেভেলপেমেন্টস বোর্ড গঠিত হওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধরা এখানে নির্মাণ করেছেন আনন্দ বিহার, মনাস্ট্রি এবং বৌদ্ধ মন্দির। মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীতে গড়ে তোলা হয়েছে অপূর্ব সব গুম্ফা বা মনাস্ট্রি। বিশালাকার সেরিমোনিয়াল বেল, উপাসনা সেন্টার, গোলাপি পাথরের অশোকস্তম্ভ, ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা মিউজিয়াম ইত্যাদি নিয়ে এক অপরূপ প্রশান্তির তীর্থক্ষেত্র এই লুম্বিনী। দেখতে দেখতে মন যে কখন প্রশান্তিতে ভরে উঠেছিল বুঝতে পারিনি। বাইরে বেরিয়ে বুঝলাম, শহুরে কোলাহল ছেড়ে মন যেন কোন অজানা জগতে বিচরণ করছিল এতক্ষণ।
আবার পথ চলা শুরু হল আমাদের। গন্তব্য পোখরা। লুম্বিনী থেকে পোখরার দূরত্ব প্রায় ১২৭ কিমি। পথ চলতে চলতেই পার হচ্ছি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামগঞ্জ, শস্যক্ষেত, জলপ্রপাত। প্রকৃতির ডাকে মন সাড়া দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। ব্যাকুল হয়ে উঠছি আমি। পাহাড়ি নাম না জানা নদীগুলি যেন আজ আমাদের পথ চলার সঙ্গী। কখনও সেই নদী বয়ে চলেছে ডাইনে, আবার লুকোচুরির খেলায় মেতে কখনও তার দেখা মিলছে পথের বাঁয়ে। লোহার রশি দিয়ে তৈরি সেতু সব এক পাহাড় হতে অপর পাহাড়ের প্রান্তে বিছিয়ে রয়েছে। ছবির মতো পটে আঁকা যেন চারিদিকের পরিবেশ! সবুজের আলপনা আঁকা পাহাড়গুলি দূরান্তে আকাশের নীলিমায় গিয়ে মিশেছে। পথিমধ্যে কোথাও নজরে ধরা দিল সারি বেঁধে তুষার শৃঙ্গরাজি। মৌন, ধ্যানগম্ভীর রূপে দিগন্তে বিরাজমান তারা।
পোখরা নামকরণ হয়েছে ‘পোখরি’ বা জলাশয় থেকে। ফেওয়া লেকের পাড়েই গড়ে উঠেছে এই সুন্দর, ছবির মতো শহর। মেঘমুক্ত দিনে লেকের জলে পাগলপারা মনভোলানো রূপ নিয়ে তুষারশৃঙ্গগুলি ছায়া ফেলে। উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গের মধ্যে রয়েছে জগৎ বিখ্যাত মাছাপুছরে (মাছের লেজের মতো যে শৃঙ্গ), অন্নপূর্ণা রেঞ্জ। দীর্ঘ যাত্রার পর পোখরার হোটেলে সান্ধ্যকালীন চা পর্ব শেষে শরীর, মন চাঙ্গা হল যেন। আগামিকাল সকালে আবারও তীর্থপথে রওনা দেব আমরা।
গন্তব্য পোখরার বন্দিপুর এলাকায় অবস্থিত বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির। দেবী দুর্গার এক রূপ ‘বিন্ধ্যবাসিনী’। প্রসন্নময়ীমাতা রূপে মন্দিরে কষ্টিপাথরের অপরূপা মূর্তিতে যেন দেবী বিন্ধ্যবাসিনী বিরাজ করছেন! পাহাড়ের উপরে মন্দির চত্বর থেকে চারদিকের সৌন্দর্য অতুলনীয়! তুষারশৃঙ্গগুলি নীল আকাশের প্রান্তে নীরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মন্দির চত্বরে মহালক্ষ্মী মন্দির, মহাদেবের মন্দির। রাধাকৃষ্ণ, রামসীতা যুগলে পৃথক প্রকোষ্ঠে বিরাজ করছেন। পুজো দিলাম দেবীর পায়ে। সেই সঙ্গে প্যাগোডাশৈলীতে নির্মিত মন্দিরের কারুকাজও দেখে নিলাম চোখ ভরে। কারুকাজে ‘নেওয়ার’ শিল্পের প্রকাশ দেখা যায়। বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণে, অপরূপা প্রকৃতিকে সাক্ষী করে আমরা সবাই যে যার মতো ছবি তুলতে কসুর করলাম না। ফিরতি পথে গুপ্তেশ্বর মন্দিরে যাওয়ার জন্য সুড়ঙ্গ পেরিয়ে গুহায় প্রবেশ করলাম। অন্ধকার গুহায় পথ চলা বেশ কষ্টদায়ক। গুহার ছাদ থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছে মাথায়, গায়ে। পিচ্ছিল গুহার মাটি। অতি কষ্টে ধাপ ভেঙে স্বয়ং দেবাদিদেবের চরণপ্রান্তে পৌঁছলাম এক সময়। পুজো-প্রণাম সেরে ফিরতি পথ ধরতে যাচ্ছি, এমন সময় খেয়াল করলাম ভক্তের দল যেন আরও নীচের দিকে ধাপ ভেঙে নামছে! জিজ্ঞাসাবাদে মালুম হল, নীচে রয়েছে গুপ্ত জলপ্রপাত! সুতরাং, আবার সিঁড়ির ধাপ ভাঙার পালা। সরু লোহার সিঁড়িপথ পেরিয়ে বেশ কিছুটা নীচে নামতেই জলপ্রপাতের মুখোমুখি একেবারে। কানে শুনছি জলধারার পতনের ঝরঝর ধ্বনি, আর চোখে দেখতে পাচ্ছি দুই পাহাড়ের মাঝ বরাবর জলপ্রপাতের অনন্য সুন্দর রূপ। প্রকৃতির রূপ রস মন প্রাণ ভরে অনুভবের বেলায় বিমূঢ় রইলাম যেন বেশ কিছুক্ষণ।
এরপর লজে ফিরে মধ্যাহ্নভোজ শেষে সামান্য বিশ্রাম। বিকেলের সফর আজ দারুণ আকর্ষণীয়। ফেওয়া লেকের বুকে বোটিং করে পৌঁছতে হবে আবার এক দেবীর মন্দিরে। এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বারাহী মাতা। দেবী দুর্গার এক রূপ বলা যায় তাঁকে। বিকেলের সোনালি রোদ গায়ে মেখে সদলবলে আমরা হাজির হলাম ফেওয়া লেকের ধারে। ‘লাইফ জ্যাকেট’ না নিলে বোটিং করা যাবে না। সেটি তাই নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করতে হল। এরপর কালবিলম্ব না করে আমরা, কর্তা-গিন্নি চড়ে বসলাম একটি ছোট বোটে, আরও দু’জন সঙ্গী সহ। পড়ন্ত বিকেলের সোনালি রোদ ঝলমলিয়ে বিছিয়ে রয়েছে, লেকের ধারে অন্নপূর্ণা শৃঙ্গরাজির চূড়ায় তখন সূর্যের অস্তরাগের খেলা চলছে। মনমাতানো সেই দৃশ্য স্মৃতিপটে চিরদিনের জন্য আঁকা রয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে বোটের চালক পৌঁছে দিল বারাহী দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণে। মন্দির প্রাঙ্গণটি বাঁধানো। আর সেই বাঁধানো চত্বরের এক প্রান্তে অবস্থিত এই অপূর্ব সুন্দর প্যাগোডাশৈলীতে তৈরি বারাহী মাতার মন্দির। এর গায়ে অপরূপ কারুকাজ খোদিত রয়েছে। পোখরার গণ্ডকী জেলার অন্তর্গত এই বারাহীদেবী মন্দির। দ্বিতল মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের দুই পাশে গর্জনের ভঙ্গিমায় দু’টি পিতলের সিংহমূর্তি বিরাজ করছে। অপরূপ গঠনশৈলীতে গড়ে তোলা হয়েছে দেবীর বাহনদ্বয়কে। মন্দিরের গর্ভগৃহে মাতৃশক্তি বা নারীশক্তির প্রতিভূরূপে দেবী দুর্গার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, বারাহী মাতা রূপে। নেপালে মহা বারাহীদেবী, ভূদেবীর প্রতিভূ বলা চলে। অষ্টভুজা মাতৃমূর্তিটি মূল মন্দিরের দেওয়াল প্রান্তে বিরাজমান। সপ্তমাতৃকার এক রূপ এই বারাহীদেবী। চতুর্থ এই দেবী মাতার মুখমণ্ডলের আকৃতি শূকরীর মতো। শারীরিক গঠন নারীসুলভ বলা যায়। দশমহাবিদ্যার এক রূপ তিনি। ভূশক্তি বজ্রমুখী, ধান্যলক্ষ্মী, ধূম্রারূপী, মহাকর্ণিকা, সেনা নারায়ণী, ক্রোধমুখী ইত্যাদি রূপে বারাহী মাতা বিরাজিতা। মান শরীরের আজ্ঞা চক্রের এক বাহকরূপিণী এই দেবী। তিনি ভক্তদের মনোবাসনা পূরণ করেন। এছাড়া ভক্তদের গুণগুলির উন্নতি সাধন করেন। ভক্তদের মনের কালিমা ও দোষ-ত্রুটিগুলিকে দূরীভূত করে দেন এই দেবী মাতা। বারাহী মাতার আরাধনায় ভক্তদের অষ্ট ঐশ্বর্য এবং অষ্টসিদ্ধি লাভ হয়। আমরা পুজো দেওয়ার পরে একান্ত নম্রচিত্তে দেবীর উদ্দেশে প্রার্থনা জানিয়ে প্রণাম শেষে বেরনোর পথে চলে এসেছি। ফিরতি পথে বোটিং করে চলে আসা হল মূল পথের কাছাকাছি। ফেরার সময় বোটে কোনও চার্জ দিতে হয় না। যে কোনও বোট পৌঁছে দেয় পর্যটকদের। দূর হতে তখনও নজরে পড়ছে মাছাপুছরের চূড়ায় রোদের খেলা! আগামী গন্তব্য মনোকামনাদেবীর মন্দির। পোখরা শহর থেকে পরের দিন রওনা দিলাম মনোকামনাদেবীর দর্শনে। পোখরা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিমি দূরে এই মন্দির। বাসপথে ‘চেরিস’ বা ‘মুগলিং’ পৌঁছে রোপওয়ের মাধ্যমে যেতে হবে দেবী মন্দিরের প্রাঙ্গণে। ১৩০২ মিটার উচ্চতায় মনোকামনাদেবীর মন্দিরে পৌঁছে যাওয়া যায় মাত্র দশ মিনিটে।
মোটামুটি চার ঘণ্টায় বাসপথে চেরিস পৌঁছে সেখান থেকে রোপওয়ে ধরলাম আমরা। এরপর মন্দির যাওয়ার জন্য টিকিট সংগ্রহ করে, সার বেঁধে লাইনে অপেক্ষার পালা আমাদের। তিনটি পাহাড় এবং ত্রিশূলী নদীর উপর দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে, রোপওয়ের পথ। প্রায় তিন কিমি দূরত্বের পথ অতিক্রম করে কেবল কারে বসে দশ মিনিটের মধ্যে চলে এলাম মন্দির লাগোয়া এলাকায়। প্রকৃতি এই সফরে আমাদের সারাক্ষণের সঙ্গী। মোট ছ’জন যাত্রীর বসার ব্যবস্থা রয়েছে কেবল কারে, সঙ্গে দু’টি বাচ্চাও। দোকানপাট লাগোয়া বেশ কিছুটা পথ সিঁড়ির ধাপ ভেঙে তবেই পৌঁছনো গেল মন্দিরের প্রাঙ্গণে। ভক্তদের দল সার বেঁধে অপেক্ষা করছে, আমরাও সেই অপেক্ষার পথে শামিল হলাম। পুরো দু’ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে চলে এসেছি মন্দিরের গর্ভগৃহ দ্বারে! প্যাগোডাশৈলীতে তৈরি অপরূপ এই মনোকামনা মাতা মন্দির! গর্ভগৃহে দেবী ভগবতী তান্ত্রিক মতে ইচ্ছেপূরণের দেবী রূপে পূজিত হন। ডিম, কমলালেবু, চাল ও কুমকুম দিয়ে পূজারী মাতার উদ্দেশে পুজো দেন এবং ভক্তদেরও এই পূজার্চনায় সাহায্য করেন। কিছুক্ষণ আগে মন্দির চত্বরে মায়ের সম্মুখে ‘বলি’ দেওয়া হয়েছে। ছাগ, মোরগ ইত্যাদির বলি প্রথা রয়েছে এই মনোকামনা মায়ের মন্দিরে। রোপওয়েতে কেবল কারে চলাকালীন মালবাহী উন্মুক্ত ট্রলিরও আসা যাওয়া নজরে পড়ে। তাতেই মানত করা বলির সামগ্রী নিয়ে আসা হয়।
পুজো দেওয়ার পরে আমরা মন্দির প্রাঙ্গণে এসে আরও কিছু সময় কাটালাম চারদিকের অপূর্ব পরিবেশে! তুষার শৃঙ্গগুলি নীরবে হাতছানি দিচ্ছে যেন সবাইকে! ত্রিশূল, ধৌলাধার-সহ নাম না জানা অজস্র শৃঙ্গরাজি অনতি দূরে হাজির!
শিলাময়ী মনোকামনাদেবী মাতার এই মন্দির ঘিরে লক্ষ্মণ থাপার কিংবদন্তি কথা ছড়িয়ে রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে এসে সেই পুরাণ কাহিনি মনে এল। গোর্খারাজ রাম শাহের পত্নীর দৈবী ক্ষমতা ছিল। এই বিষয়টি একমাত্র লক্ষ্মণ থাপা নামক জনৈক ভক্ত জানত। একদিন রাজা তাঁর রানির দৈবী ক্ষমতার প্রকাশ দেখতে পেয়ে আশ্চর্য হলেন। রানির কাছে সেই কথা বলতেই রাজার মৃত্যু হল। দৈববাক্য অনুযায়ী শর্ত ছিল যে, এ কথা জানলেও রানির কাছে তা প্রকাশ করা যাবে না। রাজার মৃত্যুর পর দাহ করার সময় রানিও সতী হওয়ার জন্য চিতায় ঝাঁপ দেন। ভক্ত লক্ষ্মণ থাপা এই ঘটনায় অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। এই সময় শোকার্ত লক্ষ্মণ থাপা একদিন স্বপ্নাদেশ পেলেন যে শীঘ্রই রানি তার বাড়ির নিকট দেবী রূপে প্রকাশিত হবেন। কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ্মণ থাপার জমিতে চাষ করার সময় একজন কৃষকের লাঙল এক পাথরখণ্ডে বাধা পায়। সেই পাথর খণ্ড থেকে দুধ ও রক্ত ক্ষরণ হতে শুরু করে। ভীত সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের উদ্যোগে তান্ত্রিক পুরোহিতরা সেই স্থানে যাগযজ্ঞ করার ফলে দুধ ও রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়।
স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, লক্ষ্মণ থাপা সেই স্থানে দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন। অপরূপ গঠন শৈলীর মন্দিরের গর্ভগৃহে রানি মনোকামনা ‘দেবীরূপে’ পূজিতা হন। দেবী দুর্গারই প্রতিভূ রূপে বিরাজ করেন তিনি এই মন্দিরে। রানির মুকুটে শোভিতা শিলাময়ী মাতার মুখমণ্ডল দর্শনকালে তিনি নাকি ভক্তবৃন্দর মনের বাসনা জানাতে পারেন।
আরও সুন্দরভাবে প্রকৃতির রূপ দর্শন করতে হলে নীচের দিকে মরিস্যা নদীর উপত্যকায় পৌঁছতে হবে। মন্দির থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে লক্ষ্মণ থাপার গুম্ফার কাছে চলে আসতে হবে। আমরা অবশ্য ফিরতি পথ ধরলাম। ত্রিশূলী নদীর ধারে ছড়ানো উন্মুক্ত জায়গায় অনতি বিলম্বে মধ্যাহ্নভোজনের তোড়জোড়, শুরু হল।
এরপর, কাঠমান্ডুর উদ্দেশে যাত্রা। দূরত্ব ১২৩ কিমি। সময় লাগবে প্রায় চার ঘণ্টা। দেবীদর্শনের পর এবার আমরা দেবাদিদেব মহেশ্বর দর্শনের লক্ষ্যে এগচ্ছি। পশুপতিনাথ দর্শনের আকাঙ্ক্ষায়। ‘জয় পশুপতিনাথজি কি জয়’ ধ্বনি তুলে শুরু হল আমাদের পথ চলা।
কাঠমান্ডু পৌঁছতে সন্ধে হল। পশুপতিনাথ মন্দিরের একেবারে বিপরীতে মূল পথের ধারে একটি হোটেলে ঠাঁই হল আমাদের। আগামিকাল ভোরে পশুপতিনাথ মন্দিরে পুজো দিতে যাব। সেই সঙ্গে দর্শন করব দেবাদিদেব মহাদেবের আরও এক রূপ!
পরদিন ভোরে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে গেল। স্নান সেরে দু’জনে ঘণ্টাধ্বনি অনুসরণ করে মূল রাস্তা পেরিয়ে চলে এলাম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমাপ্রাপ্ত এই মন্দির চত্বরে। বিশাল চত্বরটি পাথর দিয়ে সুন্দর বাঁধানো, মাঝে চওড়া পথ চলে গিয়েছে তোরণ দ্বারের কাছ বরাবর। রাজপ্রাসাদের তোরণ দ্বার মনে হবে, এখানকার মূল দ্বারটিকে! সম্মুখে বিশালাকার পেতলের নন্দী মূর্তি, বিরাজ করছে। খুব বেশি ভিড় নেই মন্দির চত্বরে। মূল দরজায় থাকা পুরোহিতের মাধ্যমে পুজো দিলাম এবং বাবাকে দর্শন করে এক অনির্বচনীয় আনন্দ পেলাম!
এই মন্দিরে চন্দনচর্চিত ফুল বেলপাতায় সজ্জিত শিবলিঙ্গ দর্শনেই পুণ্যলাভ। মূল গর্ভগৃহে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। কেবলমাত্র সন্ধ্যারতির সময় চারটি দরজাই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই সময় দেবতাকে প্রদক্ষিণ করা যায় এবং সন্ধ্যারতি দেখার সুযোগ মেলে! আমরা সেইদিন সন্ধেবেলায় শামিল হয়েছিলাম সন্ধ্যারতি দেখার জন্য। চতুর্মুখী শিবলিঙ্গটি অপরূপ গঠনশৈলীতে প্রস্তুত হয়েছে। কালো পাথরের লিঙ্গরূপী দেবতা মূল মন্দিরের প্রথম গর্ভগৃহে মুখ্য বেদিতে বিরাজ করেন। রুপোয় আবৃত পিনাকের উপর রুপোর সর্পদ্বারা বেষ্টিত লিঙ্গরূপী দেবতার মুখমণ্ডলের গূঢ়ার্থ রয়েছে। ফুলমালায় সজ্জিত লিঙ্গ, সর্বদা সোনালি বসনে আবৃত থাকে। কেবলমাত্র স্নানাভিষেকের সময় ব্যতিক্রম ঘটে। দুধ ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান, অভিষেক-পর্ব সারেন মূল পুরোহিত। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে, দ্বিতীয় করিডোর আকারে উন্মুক্ত রয়েছে। সম্মুখের রেলিং ঘেরা দ্বার দিয়ে দেখতে পাওয়া যায় অপর এক পিতলের বৃষমূর্তি, মাঝারি আকারের। দেবতা দর্শনের পর, মন্দিরের ছড়ানো চত্বরে ঘুরে বেড়িয়ে দেখে নিলাম, অন্যান্য দেবদেবীর উপস্থিতি। নন্দী, ভৃঙ্গী, ভৈরব, বীরভদ্র ও গণেশ রয়েছেন পার্শ্বচর রূপে। উল্লেখযোগ্য এই চত্বরের উন্মুক্ত ভৈরব মন্দির। বিষ্ণু মন্দিরটিতে কষ্টিপাথরের অপরূপ মূর্তি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এছাড়া প্রাঙ্গণের একদিকে অনন্ত শয্যায় শায়িত বিষ্ণুমূর্তির দেখা মেলে। ছোট হলেও এই মূর্তির অপরূপ গঠনশৈলী যেন সকলের নজর কেড়ে নেয়। নেপালের সবচেয়ে পবিত্র পুণ্যক্ষেত্র এই পশুপতিনাথ মন্দিরের পাশ বরাবর বয়ে চলেছে পবিত্র বাগমতী নদী। সেই নদীর ধারেই রয়েছে আরও অনেক দেবদেবীর মন্দির। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুহোশ্বরী মন্দির যা একান্ন সতীপীঠের একটি। বিশ্বরূপ মন্দির, গোরক্ষনাথের মন্দির, দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি, ষষ্ঠ শতকের বাদরেশ্বরী মন্দির ইত্যাদিও উল্লেখের দাবি রাখে।
একাদশী তিথিতে এবং শিবরাত্রিতে উৎসব পালন হয় পশুপতিনাথ মন্দিরে। প্যাগোডাধর্মী বর্তমান মন্দিরটি অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে তৈরি হয়। এর বহু আগে আদি মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন শঙ্করাচার্য। অপূর্ব কারুকাজ খচিত মন্দিরের দেওয়াল, ছাদের তল দু’টি সোনা ও তামা দিয়ে আবৃত। চারটি মূল দরজা রুপোয় আবৃত। কথিত আছে, পশুপতিনাথে ভক্তদের রুদ্রাক্ষের জপমালা নিতে হয়। নাহলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় দেবতা দর্শন এবং পুণ্যার্জন। অষ্ট রুদ্রের এক রুদ্র রূপে পশুপতিনাথের দেবতা বিরাজ করেন, যিনি অগ্নিকে ধারণ করেছেন। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের উপরে তেরোতম জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে দেবতা পূজিত হন এবং পরিচিতি পান। বলা হয়, কেদারনাথ দর্শনের পর পশুপতিনাথ দর্শন করলে পুণ্যার্জন অধিক হয়!
মোট চারজন ভট্ট পুরোহিত, কেবলমাত্র প্রতিদিনের পুজো আচারে যোগ দিতে পারেন। দেবলিঙ্গ স্পর্শ করার অধিকার একমাত্র তাঁদেরই রয়েছে! বিশেষ নিয়োগ পদ্ধতিতে এই চারজন পুরোহিত মন্দিরের জন্য নির্বাচিত হন। শ্রীঙ্গেরীর শ্রীশঙ্করাচার্য দক্ষিণামন্য পীঠের শিক্ষার্থীদের থেকে ভট্ট পুরোহিতদের নির্বাচন করা হয় ঋগ্বেদের শ্লোক পাঠে সক্ষম, পাশুপত যোগে সফল, শিব অগমর সম্যক ধারণা ইত্যাদি থেকে। তবেই তিনি ‘ভট্ট পুরোহিত’ রূপে নির্বাচিত হতে পারেন। এরপর তাঁকে হরিদ্বারে পাঠানো হয় সামবেদ থেকে ‘শ্লোক’ আবৃত্তির প্রশিক্ষণের জন্য! চূড়ান্ত নির্বাচন পর্বের পর তিনি আসেন পশুপতিনাথের পুরোহিত রূপে!
ভাণ্ডারি পুরোহিতরা কেবলমাত্র সহায়ক হিসেবে নিয়োজিত হন, পশুপতিনাথ মন্দিরে। চারজন ভট্ট পুরোহিতকে এঁরা সাহায্য করেন মন্দিরের আনুষঙ্গিক কর্মে।
পশুপতিনাথ দর্শন করে আমরা চলে এসেছি অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রে, কাঠমান্ডুর বুকে। বৌদ্ধতীর্থ স্বয়ম্ভূনাথ মন্দির এবং বোধিনাথ স্তূপ দেখে এলাম বিষ্ণুনারায়ণ দর্শনের জন্য।
কাঠমান্ডুর শিবপুরী পাহাড়ের এক পবিত্র সরোবরে শায়িত রয়েছেন, সপ্তম থেকে অষ্টম শতকে তৈরি অপরূপ সুন্দর বিষ্ণুমূর্তি বুড়া নীলকণ্ঠ। প্রায় পাঁচ মিটার লম্বা মূর্তিটি একখণ্ড কালো পাথরে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। অনন্ত শয্যায় শায়িত ভগবান বিষ্ণুর এই অসাধারণ মূর্তিটি পুষ্প দিয়ে সজ্জিত। ছবি তোলা নিষেধ। প্রহরারত রক্ষীদের সদা সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে সেই বিষয়ে। চতুর্ভুজ দেবতার চার হাতে চারটি প্রতীকরূপী বস্তু বিদ্যমান। ডানহাতে সুদর্শন চক্র মনের প্রতীক, বাম হাতে কোমদকী গদা শক্তির প্রতিভূ, নিচুতে বামহাতে পাঞ্চজন্য শঙ্খ পঞ্চভূতের প্রতিভূ, নিচুতে ডানহাতে পদ্ম চলন্ত বিশ্বের নিদর্শন। প্রায় চোদ্দোশো বছরের পুরনো ভাসন্ত বিষ্ণমূর্তিটি এক রহস্যের উদাহরণ বলা যায়! একখণ্ড ব্যাসল্ট পাথরের ওপর খোদিত এই মূর্তি। জনশ্রুতি, বর্ষাকালে দেবতা চার মাস নিদ্রায় মগ্ন থাকেন। এরপর হরবোধিনী একাদশীতে বুড়া নীলকণ্ঠের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয়। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তের দল আসে। একটানা নিদ্রার পর দেবতা জাগ্রত হন বা উত্থান করেন। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের রক্ষক রূপে শ্রীবিষ্ণুর উপস্থিতি তখন অনুভূত হয়। নীলবর্ণ গাত্র দেবতার, অনন্ত আকাশ এবং অপার সমুদ্রের সমার্থক বলা যায় তাঁকে। এছাড়া আকাশ ও সাগরের মতোই অসীম দেবতার বিস্তৃতি! তারই প্রতিভূরূপে বিরাজ করেন তিনি এই বিশ্বে। ‘বুড়া নীলকণ্ঠ’ আক্ষরিক অর্থ— নীলবর্ণ গলদেশ যাঁর অর্থাৎ শির। তিনি সমুদ্র মন্থনকালে গরল পান করেছিলেন, পৃথিবীর রক্ষার্থে! যা তাঁর গলদেশে সঞ্চিত থাকে। শিব ও বিষ্ণু দুই দেবতার স্বরূপ একই বলা যায়।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই উন্মুক্ত সরোবর লাগোয়া মন্দির চত্বর এক আদর্শ তীর্থক্ষেত্র। ধর্মসমন্বয়ের আদর্শ উদাহরণ! এই মন্দির ভ্রমণ শেষ হলে সাঙ্গ হল আমাদের তীর্থক্ষেত্র পরিদর্শন। সার্থক ভ্রমণ সম্পূর্ণ করে এবার ফিরে চলার পালা আপন আলয়ে।