ব্যবসায়িক কাজকর্ম ভালো হবে। ব্যবসার প্রসারযোগও বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় সন্তানের বিদেশ গমনের সুযোগ আসতে পারে। গৃহশান্তি ... বিশদ
অভিনয় জীবনের ৫১ বছর কেটে গেল। ১৯৭১-এর ৩১ ডিসেম্বর আমি প্রথম শ্যুটিং করতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ পুণের কিছু ছেলেমেয়ে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘জীবনের জটিলতা’ নিয়ে ছবি করবে বলে আমার বাড়ি এসে হাজির হয়েছিল। বলেছিলাম, কোনওদিন অভিনয় করিনি। বাড়িতেও আপত্তি ছিল। কিন্তু ওরা বারবার অনুরোধ করায় আমার দিদি বলল, তুমি অভিনয় করো, আমি থাকব তোমার সঙ্গে। আসলে একটা স্টুডিওতে আমার বড় করে বাঁধানো ছবি দেখে ঠিকানা জোগাড় করে ওরা বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল। পরিচালক ছিলেন অর্চন চক্রবর্তী। দিদি সঙ্গে করে শ্যুটিংয়ে নিয়ে যেত। এইভাবে শ্যুটিং শেষ হল।
তার কিছুদিন পর ‘দীনেশ চিত্রম’-এর দীনেশ দে হঠাৎ একদিন বাড়িতে এসে হাজির। আমি বললাম, আর অভিনয় করব না। উনি ছাড়বেনই না। ‘আমার ছবি করতেই হইব’ বলে দিদি-জামাইবাবুকে রাজি করালেন। ‘হারায়ে খুঁজি’-তে অভিনয় করলাম। দীনেশদার পরপর ছবি হিট হতে শুরু করল। আমাকে আর ছাড়লেন না। আমি আর ফিরতেও পারলাম না।
আমার বাবা মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা যান। তখন সবে আমি স্নাতক পাশ করেছি। স্কটিশে বাংলা নিয়ে পড়েছি। আমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। আর গান ছিল প্রাণ। বাবা ক্লাসিকাল গানবাজনা পছন্দ করতেন। আমরা উত্তর কলকাতায় থাকতাম। বাবার ইচ্ছে ছিল, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো যেন গান গাইতে পারি। তখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গুরু ছিলেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়। ওঁর কাছে আমাকে ভর্তি করে দেন। সেই থেকে আমার গান শেখার শুরু। বহু বছর ক্লাসিকাল শেখার পর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখব বলে ‘গীতবিতান’ থেকে পাঁচ বছরের কোর্স করলাম। তারপর অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা ঘটকের কাছে শিখেছি। বাবার হঠাৎ চলে যাওয়ার ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ভাবলাম, যার জন্য আমার এতদূর এগিয়ে যাওয়া, তার অনুপস্থিতিতে কীভাবে গাইব? গান ছেড়ে দিলাম। এখন মনে হয় ছেলেমানুষি ছিল।
অভিনয়ের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না আমার। সবই দেখে শেখা। নিজের শট হয়ে গেলেও ফ্লোরে বসে বাকিদের কাজ দেখতাম। কেমন ভাবে কথা বলছে, হাঁটছে, ক্যামেরা নিচ্ছে, দেখতাম, শিখতাম। তখনকার মানুষরাও অন্যরকম ছিলেন। সারাদিন শ্যুটিংয়ের শেষে সবাই একসঙ্গে বসত। জলখাবার খাওয়া হতো। নানারকম গল্প হতো। কত কিছু যে জেনেছি তাঁদের থেকে, তা ভোলার নয়। রবিদা, মানে রবি ঘোষের সঙ্গে আমার একটা আলাদা পরিচয় ছিল। ওঁর স্ত্রী আমার স্কুলের বন্ধু। রবিদার যে কত রকমের গল্প ছিল, তা বলে শেষ করা কঠিন। আগেকার দিনে ছবি শুরু হওয়ার আগে প্রোডাকশন বয় থেকে শুরু করে ডিস্ট্রিবিউটার— সকলে বসে আলোচনা করতেন। সেখানে সকলের মতামত নেওয়া হতো। প্রত্যেকটা প্রোডাকশন তখন খুব ভালো ছিল। এখন ইন্ডাস্ট্রি অনেক বদলে গিয়েছে।
মাঝে দু’বছর কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখন সারা রাত শ্যুটিং হতো। আমি সেটায় রাজি ছিলাম না। আবার সময়টা ঠিক হওয়াতে স্নেহাশিসবাবুর (চক্রবর্তী, প্রযোজক, পরিচালক) প্রোডাকশনে ‘যমুনা ঢাকী’ ধারাবাহিক দিয়ে শুরু করি। খুব সুন্দর চরিত্র ছিল। ভালো গল্প নিয়ে সিনেমা তৈরি হলে এখনও দর্শক গ্রহণ করেন। যদিও আমার কাছে ছবির অফার একদম আসছে না। আসবেও না। কারণ এখন সব গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এখন যাঁরা ছবি করছেন, তাঁদের কিছু ব্যক্তিগত পছন্দের শিল্পী রয়েছেন। বারবার তাঁরাই সেই প্রযোজনার বিভিন্ন প্রোজেক্টে সুযোগ পান। এটা আক্ষেপ বলতে পারেন। আজ এত বছর হয়ে গিয়েছে ঈশ্বর জানেন, কোনওদিন কাউকে কাজের জন্য বলিনি। আমার অনেক ভালো কাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। হতে হতেও হয়নি। ‘বিকেলে ভোরের ফুল’-এর জন্য আমার সঙ্গে প্রথমে কথা হয়েছিল। লুক টেস্টও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফোন করে বলা হয়েছিল, আমরা দুঃখিত।
আমি বিশ্বাস করি, আমি যদি সিদ্ধান্ত নিই যে কোনও মূল্যে আমাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে তাহলে আলাদা কথা। পরে কিন্তু আপসোস করা যাবে না। এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে আমি এমন প্রলোভনের ফোন কম পেয়েছি? জীবনে ভাবতেই পারিনি এরকম কিছু করব। আমি বম্বের (মুম্বই) বড় জায়গা থেকে অফার পেয়েছিলাম। ফ্ল্যাট দিতে চেয়েছিল ওরা। বলেছিলাম, আমার কোনও আগ্রহই নেই। আমি কলকাতাতেই খুশি। বাংলা ইন্ডাস্ট্রি থেকেও অনেক ফোন পেতাম। কিন্তু চিরকাল ভেবেছি, আমার ক্ষমতা দিয়ে যতদূর উঠতে পারব, উঠব।