ব্যবসায়িক কাজকর্ম ভালো হবে। ব্যবসার প্রসারযোগও বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় সন্তানের বিদেশ গমনের সুযোগ আসতে পারে। গৃহশান্তি ... বিশদ
ওরা থাকতে থাকতে আলমারি খোলার কথা মনে পড়েনি অনুরাধার। কেন মনে পড়েনি? কে জানে কেন বাধো বাধো ভাব, কোথাও অপরাধী লাগত?
আজ ও আলমারি খুলেই বন্ধ করে দিল, থরে থরে শাড়ি দেখে ওর গা কেঁপে উঠল। গুনতেও সাহস পেল না।
আশি পেরিয়ে হঠাৎ কিডনি সমস্যা ডেভেলপ করেছিল অণিমার। অপ্রত্যাশিত ছিল না এই মৃত্যু। কিন্তু প্রত্যাশিতও তো ছিল না!
দ্রুত হাতে ননদ বাঁশরিকে ফোন লাগাল অনুরাধা। গত ক’দিনে বারবার বাঁশরি এসেছে, কথা হয়েছে। শ্রাদ্ধের দিন অতিথিদের জল শরবত সন্দেশ দেওয়া-থোয়া এসবের দায়িত্বে ছিল বাঁশরিই। দোর্দণ্ডপ্রতাপ অণিমার জন্য চোখের জল ফেলতে অজস্র আত্মীয় এসেছে। একটা প্রজন্মের, যুগের অবসান এই পরিবারে। বিষয়টা খুব সহজ নয়। বাঁশরির মেয়ে মুনিয়া দিদার ওপরে ডিজিটাল ফোটো দিয়ে গোটা একটা পিপিটি স্লাইড শো বানিয়ে দিয়েছিল। মস্ত একটা ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি ভাড়া করে সেটা দেখানো হয়েছিল শ্রাদ্ধবাসরে।
এতসব কাণ্ডের পর, মোবাইলে সবচেয়ে বেশি কল করার দৌলতে ননদের নম্বরটি কল লিস্টে ওপরের দিকেই আছে।
বল বউদি।
—হ্যাঁ শোন বাঁশরি। কাজের কথা একটা। ভুলেই গেসলাম রে। ... মায়ের আলমারিটা খুলিনি এর মধ্যে। খুলতে তো হবে রে একদিন না একদিন। আয় না একবার সময় করে। তুই আমি দেখে রাখি।
কিন্তু মেজ বউদি?
বাঁশরি এক সেকেন্ডে ঠিক পয়েন্ট ধরে ফেলল। মেয়েদের বুদ্ধি আর কাকে বলে।
কী করা যায় বল তো? নাহয়, ওকে হোয়াটস্যাপে ছবি পাঠাব। মায়ের ভালো শাড়িটাড়ি, শাল। তারই কিছু যদি ও নেয়! আলাদা করে রেখে দেব। পরের বার দেব। করার তো কিছু নেই, আপাতত। আগে স্ট্রাইক করেনি রে আমার।
অনুরাধা বলতেই পারে না, যে, আসলে তার প্রবৃত্তি হয়নি ওই আলমারিটা খোলার।
—এত কাজের মধ্যে কী করেই বা করবে বউদি। যাইহোক, যা ভালো বোঝ! আমার আবার এ ক’দিন মায়ের কাজের ঠেলায় বাড়ির সব কাজ মাথায় উঠে আছে। আজ প্লাম্বিং মিস্ত্রি ডেকে ভাবছিলাম কলগুলো সারাব। তুমি নিজেই দেখে নাও না খুলে বউদি। মায়ের আলমারিতে গয়নাগাটি তো কিছু নেই। সেসব তো মা কবেই বিলিবন্দোবস্ত করেছিলেন।
বলতে বলতেই বাঁশরির গলা কেমন যেন ফোঁপানো, বাকরুদ্ধ ।
—না না তা হয় না। তুই কী এমন ব্যস্ত রে? এসে যা একবার। আজ নয় কাল। একা ওই কাজ আমি পারব না রে। জাস্ট হবে না আমার দ্বারা।
—আচ্ছা গো, দেখি।
ফোন রেখে অনুরাধা থমকাল। বাঁশরি হঠাৎ ছদ্ম ঔদার্য দেখাল কেন? প্রথমে খুব উৎসুক হল যদিও। স্বাভাবিক তো, বন্ধ আলমারির ডালা খোলা হবে। তার ওপর নিজের মায়ের। কোন মেয়ে না উৎসুক হবে জিনিস দেখতে! মায়ের রেখে যাওয়া শাড়ির ভাগ পেতে। তার ওপর অনুরাধার ডাক, তাতে কোনও খাদ নেই। কোনও কপটতা নেই। সাদাসিধে বউদি নিজে সব দেখে বেছে নিয়ে নিজের জন্য রেখে দিয়ে তারপর ডাকছে না, নিশ্চিতই। এই প্রথম আলমারি খুলছে ওর গলা শুনেই বুঝতে পেরেছে বাঁশরি।
বিকেলবেলায় চলে এল বাঁশরি।
ঘরের কাজ সেরেই লাঞ্চ-এর পর। বর আপিসে। এই সুযোগ।
ওকে নিয়ে মায়ের ঘরে এই প্রথম ঢুকল সম্ভবত। অণিমা শ্মশানে চলে যাওয়ার পর। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে প্রথমেই অস্বাভাবিক বদ্ধ লাগল ঘরটা। মাথার ওপর পাখা ছেড়ে দিল ফুল স্পিডে অনুরাধা। মায়ের ঘরটা একদম পুব-দক্ষিণ খোলা। বাড়ির শ্রেষ্ঠ ঘর। কিন্তু মায়ের টানা একশো দশ দিন বেড রিডেন থাকার চাপা দুর্গন্ধ সে কি এখনও মিশ্রিত হয়ে আছে বাতাসে? বারবার ফিনাইলে মোছানো ঘর। আরেকটা তীব্র গন্ধ দিয়ে সেই দুর্গন্ধ চাপা পড়ত ঠিকই। তবু সব মিলিয়ে হাসপাতালের আবহ। মায়ের জন্য আয়া রাখা হয়েছিল দুটো। সকাল বিকেলের। তাদের পান, মশলা, শায়া শাড়ির মেটে মেটে গন্ধও লেগে আছে যেন ঘরটাতে। লেগে আছে পেচ্ছাপে ভেজা লেপ তোশক বেডকভারের গন্ধ।
বন্ধ জানলাগুলো খুলে হাট করে দিতে দিতে অনুরাধা ভাবল, নিজেরা এই ঘরটাকে ব্যবহার করার কথা মাথায় আসেনি আজও। কেন আসেনি? দখলদারি মনোবৃত্তি বলে মনে হবে? নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না সে, এত দ্রুত এ ঘর দখল করলে? তাই? কীসের অপরাধবোধ তার। সে তো মায়ের জন্য যথাসাধ্য করেছে। কতদিন ধরে সেবার দায়িত্ব পেলেছে।
বাঁশরি ভাবল, মায়ের আলমারির জিনিস বউদি তার সঙ্গে সমবণ্টন করে সঠিক থাকবে। কিন্তু মায়ের ঘরটা, তার কত আপন, ছোটবেলায় এই খাটে বসে লেখাপড়া করা, সিলিংপানে চেয়ে দিবাস্বপ্ন দেখার এই ঘরটা তো বউদির জন্যই রয়ে গেল। বাঁশরি তো শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে এই ঘরটাকে ভোগ করতে পারবে না!
হঠাৎ বাঁশরির মনে হল, আমাদের কোনও বাড়ি নেই, কখনও নেই। বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির মাঝখানে কবে কোথায় টুপ করে পড়ে যায় আমাদের নিজেদের বাড়ি।
আলমারি খোলা হল। খুব বড় একটা অকেশনের মতো করেই। গত দু’বছর এ আলমারি বন্ধ পড়ে ছিল। মা অসুস্থ ছিলেন। চাবি তুলে রাখা হয়েছিল। অনেক গল্প শোনা আছে আয়াদের টাকা, গয়না, শাড়ি চুরির। মায়ের বালিশের নীচে রাখা চাবির গোছা সরানো হয়েছিল তাই। টাকাকড়ি থেকে শুরু করে আধার কার্ড, গ্যাসের বই আরও হাজার জরুরি কাগজ এসব তারপর থেকে বিকাশের নতুন কেনা চাবি দেওয়া লেখার টেবিলের ভেতরে একটা গোদরেজের লকারেই থাকত।
অসম্ভব বেশি ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলল। খুব নাটুকে আলমারি তো।
বাঁশরি নিশ্চিত হল, এই আলমারি সত্যই দু’বছর পরে খোলা হচ্ছে। ন্যাপথলিন ওডোনিল মেশানো গন্ধটা এসে নাকে লাগল। বাঁশরির মন খারাপ হয়ে গেল। একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়া ছেয়ে গেল।
গুনে গুনে আটত্রিশটা ভালো শাড়ি আলাদা করল ওরা। এর মধ্যে অর্ধেক শাড়ি শাশুড়িকে পরতেই দেখেনি কখনও অনুরাধা। তত ভালো নয়, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো, বাঁশরি এমন একটা শাড়ি দেখে বিহ্বল হয়ে কেঁদে ফেলল। মায়ের বহু প্রাচীন শাড়ি। এটা কলেজে থাকতে বাঁশরি অ্যানুয়াল সোশ্যালে পরে গেছিল। মাংসের ঝোলের ছিটে লাগিয়েছিল। সেই দাগ কেরোসিনে চুবিয়ে তুলেছিল বাড়ি এসে, তাও ভালো করে ওঠেনি। দাগটাও খুঁজে পেল বাঁশরি।
পুরনো শাড়ি তোয়ালে দিয়ে মুড়ে আলাদা ছিল। নিমপাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে ভাঁজে ভাঁজে দেওয়া। এইসব পুরনো শাড়ির প্রতিটির পেছনে একটা করে গল্প আছে। সবগুলো শুনল বাঁশরির থেকে অনুরাধা।
তারও তলায় একটা বড় সুজনি। কোনওদিন দেখেনি অনুরাধা। বাঁশরি বের করেই হাহাকার আর উল্লাস একসঙ্গে মেশানো একটা গলায় যেন আবিষ্কারকের মতো চেঁচিয়ে উঠল—
আরে আরে! এইটার কথা তো ভুলেই গেছিলাম। এটা একটা মাস্টারপিস। কতজনের হাতের ছোঁয়া আছে এটায়। দেখো বউদি দেখো।
আসনের থেকে বড়, আবার একটা শতরঞ্চির থেকে ছোট। তলায় মোটা ঘেষো কাপড় দিয়ে লাইনিং দেওয়া। ওপরে চটের ওপর সেলাইয়ের আঁকিবুকি। তুমুল রঙিন। পুরনো, সোয়েটার থেকে খুলে নেওয়া নানা রঙের উলের বড় বড় ক্রসটিচ বা হেরিং বোন স্টিচের ফোঁড়। আর মাঝে মাঝে একটা করে অ্যাপ্লিক। অ্যাপ্লিকের ফুল বা পাতাগুলো তৈরি হয়েছে পুরনো সোয়েটার থেকে। উল জমে যাওয়া সোয়েটার।
উল জমে যাওয়া সোয়েটার? অবাক হল অনুরাধা।
বাবার, ঠাকুর্দার, ঠাকুরমার পুরনো কোট আর সোয়েটার। পোকায় কাটা গো! মা তো কিছু ফেলতে পারত না! সেইসব পড়ে পড়ে ফেলে দেওয়ার অবস্থায় গেছিল। কিন্তু মা স্মৃতি ছাড়তে পারেনি। সেইসব থেকেই টুকরো কেটে কেটে এই কার্পেটে বসিয়ে দিয়েছিল। পাশগুলো দেখো কী সুন্দর করে হেরিং বোন আর বাটনহোল স্টিচ দিয়ে সেলাই করা।
আমরাও তো তিনজন, আমি তো দাদাদের সোয়েটারই ছোট হয়ে গেলে পরতাম। ক্রমাগত একজনের থেকে আর একজনে হাতবদল। সেগুলোও যখন ছোট হয়ে যেত, মা উলগুলো খুলে গোলা পাকিয়ে রেখে দিত গো। এই যে চেন স্টিচ, এই যে জিগজ্যাগ স্টিচ, এই বাকি অংশটা ওইসব করে করে ভরাট করা হয়েছিল। প্রতি শনি রবিবারে মা এটাকে নিয়ে বসত। দুপুরে খাবার পাট চুকলে বসে বসে সেলাই করত। আমিও মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়েছি কত।
স্বামী শ্বশুর তিন ছেলেমেয়ে। প্রথম সন্তানের গায়ে, ধরা যাক সত্তর সালে যে সোয়েটারটি উঠেছিল, সেটা শীতের পর শীত ক্রমশ ছোট হয়েছে আর পরের সন্তানের গায়ে উঠেছে। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়। মা বুনেছিলেন প্রতি শীতেই, কাঁটা নিয়ে বসে, উলের জামা। ফাঁক ফাঁক করে, একটু বড় ঝুলের, ঢোলাঢালা সোয়েটার। যাতে একাধিক সন্তান অনায়াসে শরীর গলিয়ে দিতে পারে। সেই সোয়েটারও যখন বেড়ে উঠতে থাকা এক ছেলের গায়ে আঁট হতো, ছোট একজন দু’জনের গায়ে তো নিশ্চয়ই ঠিকঠাক এঁটে যাবে? ফেলাফেলির কিচ্ছু নেই।
কিন্তু বছরের পর বছর কাচতে কাচতে, ময়লা হতে হতে সে উলের জামার উল তো জমে যাবেই। ফাঁকফুটোগুলো বুজে যাবেই। বুজে গেলে সেগুলো কি আর পরা যাবে না নাকি?
কিন্তু ধীরে ধীরে যখন সব বাচ্চা বড় হয়ে যায়, তখন তো আলমারির এককোণে পড়েই থাকে সব। পড়ে থাকে, জমে থাকে। জমে যায়। কিছু দান দাতব্য করা হলেও, সব তো আর দেওয়া হয় না, অনেক জামাই রয়ে যায়। তখন মা জমে যাওয়া উলের জামার লাল বা হলুদটার থেকে কেটে নেন অ্যাপ্লিক-যোগ্য ফুল, সবুজের থেকে পাতা। কচকচ করে কাঁচি চলে, আর নানা আকৃতির ফুল পাতা ঝরে পড়ে সাদা শাড়ির কোলে।
তারপর সেগুলি লাগানো হয় সেই চটের ওপর। সেলাই করে দিয়ে চারপাশে বুনে দেওয়া হয় হলুদ লাল উল। এই সব উলও এসেছে অন্য পুরনো সোয়েটার থেকে। যেগুলো জমে যায়নি এমন উলের, যেগুলোর এক প্রান্ত ধরে, ছিঁড়ে, টানতে শুরু করলে ফুর ফুর ফুর ফুর, উল বেরতেই থাকে, বেরতেই থাকে। আর নানা রঙের পুরনো সোয়েটার খুলে খুলে আবার গোলা পাকিয়ে রাখেন মা। অবশ্য সেগুলোও দু’বার রিসাইকল করা। তা দিয়ে আবার সোয়েটার বোনা হয়েছে হয়তো, আবার খুলে ফেলাও হয়েছে। সেই উলগুলোও যখন আর সোয়েটারযোগ্য থাকে না, তখন লাগে এইসব বুননের কাজে, মানে চটের ওপর ফোঁড় তোলার কাজে।
গল্পগুলো শুনতে শুনতে একটা নতুন আর আলাদা মহাদেশ দেখতে পাচ্ছিল অনুরাধা। সেই মহাদেশের নাম বাঁশরির মা, বিকাশের মা, সুকান্তর মা। বিধবা এক মহিলা। স্বামীর আপিসে কেরানির চাকরির একঘেয়েমি, ছেলেমেয়েদের মানুষ করার চাপ আর সমস্ত ধরনের সামাজিক বাধা পেরনোর ভার সহ্য করা এক মহিলা।
আর বর্তমানের বাধা পেরিয়ে অনুরাধা বুঝতে পারছিল তার জন্য আর একটা মহাদেশ রেখে গেছেন অণিমা। তার নাম অনুরাধার শাশুড়ি। নিজে যা যা পাননি তা এবার হাসিল করতে চাওয়া, বউমার ওপর কর্তৃত্ব ফলানো, বউমার জীবনের খুঁটিনাটির ওপরে নজরদারি করা এক শাশুড়ি।
ছেলে-বউমার বিছানা পরখ করে, সেখানে একফোঁটা রক্তের মতো দাগ খুঁজে পেয়ে পরের দিন, মুখ ছোট করে চোখ সরু করে বউমাকে জেরা করা শাশুড়ি। ‘তোমরা মশারি টাঙাও না? মশার কামড়ের দাগ দেখেছি আমি বিছানায়।’ বলে অনুরাধাকে হতবাক করে দিয়ে যাওয়া শাশুড়ি।
দুটো মহাদেশ কবে যেন কন্টিনেন্টাল ডিফ্রটের মতো করে দু’পাশে সরে গেছিল। বড় ছেলে বিকাশের বিয়ের দিন থেকেই কি একটু একটু করে?
দুই
অনুরাধার বিয়ের যৌতুক হিসেবে এসেছিল এই আলমারিটা। যেটা তার শ্বশুরবাড়িতে ঢোকার দিন, প্রথমেই শাশুড়ি তাঁর নিজের বেডরুমে ঢুকিয়ে নিলেন। বিয়ের সময়ে প্রায় কিশোরী ছিল অনুরাধা। বাবা তাকে যথাশীঘ্র সম্ভব ঘাড় থেকে নামাবে বলে হায়ার সেকেন্ডারির পরেই বিয়ে ঠিক করে ফেলল। বাবা কীই বা করতেন! মা চলে গেল অনুরাধার স্কুল জীবনেই।
বাবা স্ত্রীহীন জীবনে মাথা গুলিয়ে ফেলল। নিজের দশটার ভাত নিজে রেঁধে নিতে হবে ভেবেই আকুল বাবা। স্কুলের গণ্ডি পেরতে না পেরতে বাবা কার বুদ্ধিতে কে জানে, পিসির কাছে রেখে এসেছিল। সোমত্ত মেয়েকে ম্যানেজ করতে পারবে না বলে কোনও আত্মীয়া এই সর্বনাশটা ঘটিয়েছিল? বাবাকে এই অদ্ভুত উপদেশ দিয়েছিল?
হঠাৎ মা-হারা অনুরাধা বাড়িও হারাল। চোদ্দো বছরের মেয়ে তখন ভালো করে নিজের পিরিয়ড ম্যানেজ করতে শেখেনি। মা শয্যাশায়ী ছিল যখন তার প্রথম পিরিয়ড হয়। তবু তো মা ছিল। তবু তো মা মুখে বলেছিল মেয়েকে, কী করতে হবে, কেমন করে সামলাতে হবে। অসুখের যন্ত্রণা সইতে সইতেও মা তাকে বলেছিল। অনুরাধা ভেবেছিল, এই অসুস্থ অবস্থায় মাকে যেন ও আরও বড় বিপদে ফেলেছে। বারো বছর বয়সে, প্রথম দিন রক্ত দর্শন করে ও মৃত্যুভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল মায়ের মতো ওরও ক্যান্সার হয়েছে।
পিসির বাড়িটা বিশ্রী ছিল। কোনও ছায়া ছিল না বাড়িটায়। কোনও কোণ ছিল না লুকানোর মতো। স্কুল শিক্ষিকা পিসি একটাও কথা বলত না ওর সঙ্গে। অবিবাহিতা পিসি ছিল ব্লটিং পেপারের মতোই শুকনো। চকের গুঁড়োর মতো শীতল। পিরিয়ড, স্কুলের স্কার্টে দাগ লাগলে স্কুলে ক্লাসমেটদের টিটকিরি, হাসাহাসি, অভব্য বুলিং, কমন রুমে গিয়ে টিফিন টাইমে মীরাদির সহানুভূতিহীন মুখের সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন চাওয়া, বাথরুমে গিয়ে জল দিয়ে ঘষে দাগ ওঠাতে গিয়ে সারা স্কার্ট ভিজে একাকার করে ফেলা। ফিরে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে জামাকাপড় কাচা পিসির বকুনির ভয়ে।
বড় হয়ে ওঠার দিনগুলো অনুরাধার ছিল বিষ। মায়ের স্নেহ সে ভুলেই গেছিল। মায়ের ঘরে তার যে কোনও নিজস্ব টেবিল ছিল, সেখানে স্বপনকুমার আর টারজান, বেতাল আর ম্যানড্রেক-এর বই ভূগোল আর ইতিহাস বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে রেখে পড়া ছিল, মায়ের বিছানার পাশে সরু ক্যাম্প খাটে শুয়ে তার যে আকাশপাতাল ভাবনার বিশাল বিস্তার ছিল, স্কুলের পথে পাড়ার অমুকদা তমুকদার চাউনি নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখার ফাঁকফোকর ছিল, এসব, সবকিছুই হারিয়ে গিয়েছিল চোদ্দো বছর বয়সে।
আঠারো বছর বয়সে সে আবার বাড়ি পাল্টাল। বাবা তাকে বিয়ে দিল কীরকম যেন কাঁচুমাচু মুখ করে। যেন ক্যান্সারে নিজের স্ত্রীকে চার বছর আগে হারিয়ে বাবা একটা বিশাল অপরাধই করে ফেলেছে।
কাজেই বাবার সেই অপরাধী, অনধিকারী, পায়ের তলায় মাটি না থাকা অনুভব নিয়েই অনুরাধা শ্বশুরবাড়িতে ঢুকল। যেন চোরের মতো। শ্বশুর নেই। শাশুড়িই তার বর বিকাশের সর্বেসর্বা, বাবা মা দুই-ই। দুটো কমবয়সি দেওর ননদ সেদিন তাকে করল বেশি, বন্ধু হল কম। কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে যেভাবে ক্যাবলারা -এর শিকার হয় তেমনি ভাবেই।
বিয়ের পরদিন সেই যে শাশুড়ি মুহূর্তে তার গয়নাগুলো নিয়ে নিলেন। পোঁটলা বেঁধে নিজে নিয়ে ওই গোদরেজ আলমারিতেই লকারে ভরে রাখলেন। বউমা কচি, বোকা আর ক্যাবলা, হারিয়ে ফেলবে কোথায়। সে আলমারি যখন উঠে গেল তাঁর সুনিপুণ গৃহিণীপনায় নিজের পুব-দক্ষিণ খোলা বেডরুমের কোনায়, তাঁর পুরানো কাঠের আলমারি চলে গেল বিকাশের ঘরে। কিছু তো ফেলার নিয়ম নেই এ বাড়িতে। বিকাশের ঘর উত্তর পশ্চিম মুখ। ব্যাচেলরস ডেনের মতো। সেই ছোট ঘরে ঠেসে রাখা হল অনুরাধার বাবার দেওয়া নতুন খাট। সে ঘর গ্রীষ্মে গরম, শীতে কনকনে ঠান্ডা।
সেই ঘরের ভেতরে অনুরাধার নতুন জীবন শুরু হল এ বাড়ির বড় বউ হিসেবে। কতগুলো নতুন শাড়ি পেয়েছিল মনে নেই আর। বউভাতে পাওয়া উপহারের অনেকগুলোই আত্মীয়দের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল অণিমার নির্দেশে, যেমন নিয়ম।
তিন
বাঁশরি চোখ মুছে একের পর এক ছবি তুলছে ফোনে। আটত্রিশটা ভালো শাড়ি। নানা সময়ে বাঁশরি, অনুরাধা, পিসিশাশুড়ি, মাসিশাশুড়িরা অণিমাকে উপহার দিয়েছেন। শ্রাবণী কলকাতায় এলেই গড়িয়াহাট যেত শপিং করতে। ডালাসের জন্য ঢাউস স্যুটকেস প্যাক হতো। মনে মনে ডলারকে টাকায় কনভার্ট করলে ঢাকেশ্বরী থেকে ভোজরাজ— সব দোকানের শাড়িই তার সস্তা লাগে। ষোলোটা শাড়ি নিজের জন্য কেনার পর অনুরাধা ও অণিমার জন্যও সে একটি করে শাড়ি কিনত। এবং দামি শাড়িই। পাওয়ার পর অণিমার মুখ উজ্জ্বল হতো, পরতেন এক-আধবার। নিজেরটার সঙ্গে এটাও ফলস পিকো করিয়ে আনত অনুরাধাই, লোকাল মার্কেটের দর্জির দোকান থেকে। একবার পরার পর ইস্ত্রি করিয়ে সে শাড়ির স্থান হতো আলমারিতে।
এভাবেই জীবনের শেষ কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে পুজোর শাড়ি, নববর্ষের শাড়ি, ডলার দিয়ে কেনা শাড়ি, প্রণামীতে পাওয়া শাড়ি জমতে জমতে পাহাড় হয়েছে। সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্ক থেকে শুরু করে অসমের মুগা। মুর্শিদাবাদ সিল্ক থেকে কেরালা কটন।
সব ছবি শ্রাবণীকে হোয়াটস্যাপে পাঠানো হল। শ্রাবণী সে সব দেখতে দেখতে অনেক দেরি, আজ আর কোনও সিদ্ধান্ত হবে না। তার এখন মাঝরাত, ভোররাত। সে দেখবে, তারপর হাজার রকম কথা বলবে। প্রথমে বলবে আমি কিছু চাই না। আমার লাগবে না। তারপর আ-না-গা-তা করে সবচেয়ে সুন্দর শাড়িগুলোর ব্যাপারে আর্জি জানাবে। এদিকে বাঁশরিও নেবে। তারপরও অনেক কিছু পড়ে থাকবে। কিন্তু আজকাল অনুরাধাই কি আর শাড়ি পরে তেমন? কুর্তি পালাজো পরে যে আরাম, তারপর আর ওসব কিছুই তাকে টানে না। নাহ্, এমনিও, তার স্বভাবটাই এমন। কোনওকিছুই ভালোবেসে, চেখে চেখে ভোগ করতে পারবে না অনুরাধা মন খুলে... সে জানে, ঠিক জানে।
বাঁশরি প্রথমেই হামলে পড়েছিল মায়ের পুরনো শাড়িগুলোর ওপর। মায়ের বানানো ওই কার্পেট তো তারই। ওটায় তার নিজের হাতে করা হেরিং বোন স্টিচ আছে যে। নরম পুরনো উলের স্টিচ। সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু বউদি! এসব কি ফেলা যায়?
তারপর বাঁশরি অবশ্য বুঝেছিল শাড়ির ব্যাপারে শুধু সেন্টি হলে চলবে না। সংখ্যার নিরিখে যদি সমবণ্টন হয় তাহলে সে ফাঁকি পড়ে যাবে। মায়ের দশটা পুরনো শাড়ি নিয়ে কী লাভ যেখানে প্রায় না পরা, নতুনের মতো আরও দশটা নেওয়া যায়? তাও বাঁশরির কান্না পায়। মন দোনামোনা করে। সে স্মৃতির দোহাই দিয়ে নিজেকে বোঝাতে থাকে।
এদিকে মায়ের অজস্র ব্লাউজ রয়ে গিয়েছে। ওদের কারও গায়ে সেগুলো হবে না। এগুলো ইমিডিয়েটলি দিয়ে দেওয়া দরকার। কাদের দেবে, বউদি? ঘাঁটতে ঘাঁটতে বাঁশরি বলল।
অনুরাধা ঠোঁট কামড়ে ভাবছিল। কাজের মেয়ে, মায়ের আয়া, সবাইকে সে ইতিমধ্যেই হাত ভরে ভরে দিয়েছে। মায়ের বিছানার চাদরগুলো, একটা লেপ। লেপটা, তোশকটা, সবই পেচ্ছাপের গন্ধে ভরা ছিল। তবু আয়া লেপটা নিয়ে গেছে সাবানে কেচেধুয়ে। অভাবের সংসারে এই লেপ তার কাছে অনেক। আয়াকে সেদিনই মায়ের আলনা থেকে নতুনের মতো ছ’টা ম্যাক্সি, দুটো ঘরোয়া শাড়ি ধরে দিয়ে দিয়েছিল। পাড়ার ছেলে, বস্তির, সে তোশকটা নিয়েছে। ব্লিচিং ছড়িয়ে দু’দিন রোদ্দুরে ফেললেই হবে। ওই ছেলেরাই অণিমাকে হাসপাতালে দেওয়ার সময়ে ফেরার সময়ে সাহায্য করেছে, স্ট্রেচার ধরেছে।
ব্লাউজগুলো সে এবার রান্নার মেয়েকে দেবে ভাবছে, ভাবছে ঘর মোছার মেয়েটাকেও অফার দেবে। বাঁশরি কিছু নিয়ে যাক।
পুরী থেকে আনা কটকি চাদর বেরল অনেক। শাল বেরল। ভালো শাল আলাদা করা হল। পুরনো শাল দানদাতব্য করতে হবে। কটকি চাদর যে যখন পুরী যায় একটা করে আনে। সেসব কাজের মেয়েদের দেবে ওরা। বাঁশরির বাড়িতেও তো হেল্পিং হ্যান্ড মেয়েটা আছে। দিয়ে দেবে ওকেও কিছু।
গয়নাগাটি কিছু নেই প্রায়। কিছুদিন আগেই সেসব নিজে হাতে মেয়েকে আর দুই বউকে দিয়ে দিয়েছিলেন অণিমা। অনুরাধা তার বিয়ের গয়নার পোঁটলাটা যতদিনে ফেরত পেয়েছিল, গয়নার প্রতি কোনও টানই আর ছিল না। বিয়ের গয়নাগুলো কেমন দেখতে তাও বিশেষ মনে নেই। মাঝেমধ্যে এক-আধটা অনুষ্ঠানে পরেছিল মাত্র। অণিমা যখন তাকে দিলেন, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল দু’টি মাত্র চেন। বাকি সব আশ্চর্য সুন্দর ঢাকাই কাজ করা জড়োয়ার সেট বাঁশরি পায়। বাঁশরির বিয়েতেও তাকে নিজেরগুলো অঢেল দিয়েছিলেন অণিমা। নিজের মায়ের কাছ থেকে পাওয়া উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এইসব জড়োয়া সোনা বেশি নেই। দেখতে অনবদ্য।
তবু লকারের ভেতরটা তারা তন্ন তন্ন করে দেখল। একটা কাশ্মীরি কাঠের কাজ করা বাক্স পেল। পেল একটা বেতের ঝুড়ি। খুব সন্দেহজনক দেখতে। অনুরাধার অদ্ভুত লাগছিল। এত অবাধে মানুষের ব্যক্তিগত জমিয়ে রাখা জিনিস হাতড়ানো যায়? তাও আবার অণিমার? যিনি নাকি এত গুছুনি, এত আঁটিসাটি মহিলা? একবার একটা ইলেকট্রিক বিলের কপি খুঁজতে চেয়েছিল অনুরাধা। বিকাশ ঘরে নেই, অথচ কপিটা জমা করতে হবে একটা ফর্মের সঙ্গে।
বিকাশ হলে মায়ের লুকনো জায়গা থেকে চাবি নিয়ে সটান আলমারি খুলত। অনুরাধাকে শাশুড়ির কাছে প্রার্থীর মতো দাঁড়াতে হয়েছিল। দরকারটা তিনবার বলতে হয়েছিল। তিনবারের বার অণিমা ভুরু তুলে বলেছিলেন, মানে, তোমার এখনই চাই? আলমারিটা খুলতে বলছ? বিকাশ এলে না হয় খুঁজে নিত?
তারপরও লজ্জার মাথা খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সে শাশুড়িকে দিয়ে আলমারি খোলায়। খোলার পর সে যতক্ষণ লাল-নীল প্লাস্টিকের ওই ফোল্ডারগুলো বার করে দেখছে, অণিমা বরাবর একটা পা আলমারির দরজায় ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এক মুহূর্তের জন্য নড়েননি আলমারির সামনে থেকে। তিন ফুট চওড়া আলমারির দেড় ফুট অংশ জুড়ে রেখেছিলেন নিজের শরীর দিয়ে।
সম্পত্তির জন্য বডি ফেলে দেওয়া। এটাকেই বলে, নাকি? অনুরাধার মনে হয়েছিল ইলেকট্রিক বিল খুঁজতে খুঁজতে সে হয়তো অনধিকার প্রবেশ করে ওঁর দামি কোনও দলিল দস্তাবেজ নিয়ে নেবে। চুরি করে নেবে ওঁর কোনও ক্যাশ বাক্স।
আজকে কিন্তু দামি আর কিছুই পাওয়া গেল না। থলি বটুয়া ভর্তি খুচরো পাওয়া গেল। লজ্জা করছিল অনুরাধার। শরীর খারাপ করছিল। একটা মুহূর্তের এদিক ওদিক। মৃত্যু আমাদের মহৎ করে না। মৃত্যু আমাদের অক্ষম করে। জিনিসপত্র নিয়ে সেইসব লোক ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারে যাদের আমরা চিরদিন সরিয়ে রেখেছিলাম, অচ্ছুৎ করে রেখেছিলাম। যাদের আমরা কোনওদিন চাইনি নিজের চারপাশে।
বাঁশরি কাশ্মীরি কাঠের বাক্স খুলে দেখল ফিতে দিয়ে বাঁধা একগোছা চিঠি। বাবার লেখা মাকে চিঠি। মা যত্ন করে রেখেছিল। বাবা চাকরির কাজে দূরে গেলে এই চিঠিগুলো লিখত। বাবা আর মার প্রেমের চিহ্নগুলো নিষিদ্ধ জিনিসের মতো ছুঁয়েই হাত সরিয়ে নিল বাঁশরি। নাহ্। বউদির সামনে তার এসব পড়তে লজ্জা করছিল।
অন্য ঝুড়িটা খুলেই দেখল আরও কত চিঠি। কী জানি, কে লিখেছিল। পড়তে কৌতূহল হচ্ছিল। বাঁশরির হাত নিশপিশ করছিল। সে যেন আরও কিছু গল্পও খুঁজে পাচ্ছিল। মায়ের কোনও গোপন প্রেমটেম ছিল নাকি? মা তো জীবনে সুখ পেল না কোনও। বাবা দূরে দূরে চাকরি করল। ছেলেমেয়ে মানুষের দায় মায়ের একার। তারপর বাবা মারাও গেল অসময়ে। মাকে বাবার আপিসেই চাকরি দিয়েছিল। কিন্তু অফিসারের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী যখন কেরানি হয় সে কখনও অ্যাক্সেপ্টেড হয় না ঠিক করে। মা সুখী ছিল না চাকরিতে। দাঁতে দাঁত চেপে তাও কাজ করত, আপিস যেত রোজ বাচ্চাদের জন্য রান্না করে। জীবনটা খুব টাফ ছিল মায়ের। বিকাশ আর সুকান্ত পরে এত সফল হয়েছে, তারা তো মায়ের জীবনের এই প্রচণ্ড স্ট্রাগলের ফেজ জানে, জানে মায়ের লড়াই করে তাদের মানুষ করার ইতিহাস। জানে কত চাপ সহ্য করেছে মা। অথচ সবটা মন দিয়েছিল ছেলেদের দিকে। বাঁশরি বরঞ্চ মায়ের বিশেষ মনোযোগ পায়নি, আহ্লাদ পেয়ে বখে গিয়েছিল। সাজুগুজুর দিকেই মন গিয়েছিল তার। লেখাপড়া, কেরিয়ার কিছুই হল না তাই।
অনুরাধা কাচের মতো নিস্পৃহ চোখে, বোতামের মতো প্রাণহীন চোখে বাঁশরির এইসব কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করা দেখছিল।
সব ফুরিয়ে গেছে একটা জীবনের। খাট, বিছানা, ঈর্ষা, হিংসা সব শেষ। টুথপেস্ট টিউব থেকে পুরো পেস্ট বেরিয়ে গিয়েছে। মায়ের সেইসব খিটখিটে ব্যবহার। শেষ দিনগুলো আর অনুরাধার খুঁত ধরত না মা। শুধু কাজের লোকেদের সঙ্গে সারাদিন কিটিরমিটির চলত। আয়া পালটে ফেলা বারবার। চোর বদনাম। কাজের মেয়েকে চোর বদনাম দেওয়া। আক্ষেপ ছিল কোথাও। অস্থিরতা। অথর্ব অবস্থা। শরীরের গাঁটে গাঁটে অদ্ভুত এক জড়তা। অসুখ পেড়ে ফেলেছে। অথচ চাইছে সংসারকে আগের মতো কনট্রোল করতে।
অনুরাধার মতো একটা ন্যালাক্যাবলা কচি বউ এসেছিল। তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন ভেবেছিলেন। নিয়েওছিলেন। কিন্তু কোনওদিন ভরসা আর করতে পারলেন কই! মেয়েটা যেন আকাশমুখো। আনাড়িই রয়ে গেল। ভালো করে সংসারের হাল ধরবে, তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড হবে, এ আশা ছিল না অণিমার।
হয়তো তাতেই ভালো হল। নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেন। যথাসম্ভব। শুধু শেষ কয়েকটা দিন বিছানায় শুয়ে প্রায় যেন নখদন্তহীন শরীর অথচ ক্ষুরধার মগজ নিয়ে, চেষ্টাই করে গেলেন ক্রমাগত, নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার।
চার
বিকাশ সন্ধেবেলা এল। বাঁশরি চলে যাওয়ার পর। বিকাশের কোনও তাপ উত্তাপ নেই এখন আর। মায়ের জন্য যা যা করণীয় বড় ছেলে হিসেবে সব করেছে। বাবা অনেক দিন আগেই চলে গেছিলেন। তখনও করেছিল। বিকাশের রগের সব চুল পাকা। বিকাশের শরীরও একটু করে ভাঙছে।
তোমায় জিরের জল দেব?
দাও। বাদাম ভেজালে?
সকালে খালিপেটে বাদাম ভেজানো খায় বিকাশ। সারাদিনে এটা সেটা খাওয়ার অভ্যেস ছেড়েছে। কতদিন লুচি, কচুরি, শিঙাড়া খায় না। কতদিন যায় না কোনও নৈশভোজে। সান্ধ্য পার্টিতে। নিয়মিত সুগার আর লিপিড প্রোফাইল চেক করায়। নিয়মিত ডাক্তার দেখায়। খাওয়াদাওয়া মেপে খায়। ভাত রুটি কমিয়েছে। নিউট্রিশনিস্ট লিখে দিয়েছে, সব্জি খেতে হবে। ভেজিটেবল প্লেন্টি।
তবু অনুরাধা আজ খানিকটা সুজি করে রেখেছিল। বাঁশরি ভালোবাসে মোহনভোগ খেতে, ওর জন্যই করেছিল অনুরাধা। ফ্রিজে ঘি-এর শিশি পড়ে আছে, আজ এক চামচ ঘি দিয়েছিল।
রুটি আর সব্জির ঘ্যাঁট খাওয়া শেষ করল বিকাশ। তারপর বাটিতে করে মোহনভোগ তারিয়ে তারিয়ে খেল। খেতে খেতে বলল, ভালো হয়েছে। তোমার হাতটাও বেশ এখন মায়ের মতোই হয়ে গেছে।
অনুরাধা চমকে তাকাল। বিকাশ কখনও বলেনি এই কথাটা। বিকাশ কি মাকে মিস করছে বলে কথাটা বলল?
নাকি অনুরাধা এই প্রথম অণিমার জায়গাটা অধিকার করতে পারল।
একটা ছায়া সরে গেল?
বিকাশকে মুখ ফুটে কিছুতেই অনুরাধা বলতে পারল না, আজ সে আর বাঁশরি মায়ের আলমারিটা খুলেছিল।
মায়ের ঘরটা জানালা দরজা খুলে রাখার ফলে অনেকটা খোলামেলা লাগছে। শোওয়ার আগে বিকাশকে ডেকে ওই ঘরে নিয়ে গেল সে। বিকাশ ঘরে ঢুকেই ধপাস করে মায়ের বিছানায় বসে পড়ল। তারপর গড়িয়ে শুয়েও গেল। মায়ের জন্য একটা টিভি আছে এই ঘরে।
অনু, টিভিটা চালাও তো!
চালাল অনু। হাউমাউ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সারাঘরে টিভির শব্দ। মায়ের পছন্দের সেই সিরিয়ালের চ্যানেল। সারা সন্ধে ধরে শাশুড়ি বউমা, রামায়ণ, হনুমান, রামকৃষ্ণ, রাসমণি। যত না মা দেখত তার চেয়ে বেশি আয়াটা।
বিকাশকে খুব রিল্যাক্সড দেখাচ্ছিল। হঠাৎ শিশুর মতো মুখ করে হেসে বলে উঠল, আচ্ছা অনু, আজ রাতে এ ঘরেই শুলে হয়তো। কী সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে ।
হঠাৎ শিউরে উঠল অনুরাধা। তার মনে হল কে যেন তাদের দিকে একদৃষ্টে দেখছে। তার মনে হল আলমারির মাথায় একটা কোনও প্রাণী বসে আছে। লক্ষ্মীপেঁচার মতো তো গোল, লোমে ঢাকা, গা ফোলানো একটা কিছু। ভালো করে তাকিয়ে দেখল, মায়ের জন্য কেনা ছোট্ট টেবিলপাখাটা, সাদা প্লাস্টিকে ঢাকা। গরমের সময়ে নামানো হয়। অন্য সময়ে ওপরে থাকে।
তবু অনুরাধার মনে হল, ঘাপটি মেরে কে যেন পাহারা দিচ্ছে নিজের আলমারি নিজের ঘর। তবে কি অণিমা?