কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায় ... বিশদ
‘দেবা যক্ষাস্তথা নাগা গন্ধর্বাপ্সরাসোহসুর
ক্রুরাঃসর্পাঃ সুর্পণাশ্চ তরবো জিক্ষগা খগাঃ
বিদ্যাধরা জলা ধারান্তস্তথৈবাকাশাগামিনঃ।।’—
মানব সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব ভালো আর মন্দের। দ্বন্দ্ব সুখ আর দুঃখের। দ্বন্দ্ব সুর আর অসুরের। দ্বন্দ্ব দেবতা আর অপদেবতার। অশুভ শক্তি সর্বদাই শুভর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সম্মুখ সমরে প্রতিবারই অশুভ শক্তির পরাজয় হয়েছে।
বিভিন্ন পুরাণে দেখা গেছে দেবতাদের বরে পরিপুষ্ট হয়ে বর দাতাদেরই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে অসুরেরা। সেই বিদ্রোহী অসুরদের শায়েস্তা করতে কখনও বিষ্ণু ধরেছেন বিভিন্ন অবতারের রূপ, শিব করেছেন তাণ্ডব আবার জগজ্জননী আবির্ভূতা হয়েছেন দুর্গা বা মা কালী রূপে। অসুর দমন করে পৃথিবীতে শান্তির বাতাবরণ ছড়িয়েছেন দেবতারা। পুরাণের বেশিরভাগ অসুরই জ্ঞানী ছিলেন। পরে দাম্ভিক হয়ে ডেকে এনেছেন নিজেদের বিপদ। সময় এগিয়ে চলেছে নিজের গতিতে। মনুষ্য সমাজে এই অশুভ শক্তি রূপ পরিবর্তন করে পরিণত হয়েছে অপদেবতাতে। সমাজ বিভক্ত হয়েছে নানা বৈশিষ্ট অনুসরণ করে; ঠিক তেমনভাবেই জন্ম নিয়েছে অপদেবতার। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অপদেবতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বিভিন্ন কুসংস্কার।
অপদেবতার বাংলা অর্থ অপকৃষ্ট দেবতা। অর্থাৎ যে সকল দেবতা অপকার সাধন করে। অপদেবতা বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি ভূত, প্রেত, যক্ষ ইত্যাদি। লক্ষ করা গেছে অপদেবতা অধিকাংশ জায়গাতেই লৌকিক দেবতা বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে আঞ্চলিক লৌকিক দেবতা। এই দেবতার থান সাধারণত গ্রামের বাইরে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে এই অপদেবতারা সাধারণ লৌকিক দেবতা হিসেবে পূজিত হন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-যক্ষ যক্ষিণী পুজো বর্তমানে পরিণত হয়েছেন মুর্শিদাবাদের যাখিন চণ্ডীতে অথবা বর্ধমানের অন্যতম অপদেবতা জটাধারী এখন সাধারণ লোকদেবতায় পরিণত হয়েছেন। হিন্দু ধর্ম অনুসারে দেবতা তিন শ্রেণির। ১) বৈদিক দেবতা। ২) পৌরাণিক দেবতা। ৩) লৌকিক দেবতা।
অপদেবতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লৌকিক দেবতা। অবশ্য সব লৌকিক দেবতাই অপদেবতা নন। ভাগবতপুরাণের ৪, ৬, ১০ অধ্যায়ে এদেরকে উপদেবতায় ভূষিত করা হয়েছে। আবার বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবযোনি সম্ভূত বা উপদেবতাকে বলা হয়েছে ‘ব্যন্তর দেবতা’। ‘ব্যন্তর’ শব্দটির অর্থ হল, এই দেবতারা মানুষ ও দেবতার মধ্যবর্তী ক্ষমতা সম্পন্ন পৌরাণিক পুরুষ। এরা সাধারণত অবৈদিক দেবদেবী। পুরাতাত্ত্বিক খননে যেমন দেবতাদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তেমনই পাওয়া গিয়েছে অনেক অপদেবতার সন্ধানও।
অপ্সরা– এঁরা মূলত উপদেবী। হিন্দু এবং বৌদ্ধ পুরাণ অনুসারে মেঘ এবং জল থেকে উদ্ভূত এক নারীর আত্মা হল অপ্সরা। সংস্কৃত শব্দ ‘অপ্স’ বাংলায় এর অর্থ জল থেকে এদের উৎপত্তি, তাই এদের অপ্সরা বলা হয়। অপ্সরার ইংরেজি হল জলপরী, অনেকে এঁকে স্বর্গীয় জলপরী এবং স্বর্গীয় কুমারী বলেও অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। অপ্সরা আবার দুই ধরনের লৌকিক এবং দৈবিক। লৌকিক অপ্সরার সংখ্যায় ৩৪ এবং দৈবিক অপ্সরারা সংখ্যায় মোটামুটি ১০ জন। শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধধর্মেও অপ্সরাদের উল্লেখ আছে। অপ্সরারা মায়ারূপিণী, সেইজন্য নিজেদের দেহের পরিবর্তন করতে পারেন।
যক্ষ— যক্ষের উদ্ভব দেবযোনি থেকে। যক্ষের স্ত্রীলিঙ্গ হল যক্ষিণী। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে— ব্রহ্মা প্রথমে জল সৃষ্টি করেন, পরে সেই জল রক্ষার জন্য প্রাণী সৃষ্টি করলেন। সেই প্রাণীদের একদল বলল— যক্ষামঃ, অর্থাৎ আমরা পুজো করব। অন্যদল বলল- রক্ষামঃ, অর্থাৎ আমরা রক্ষা করব। ব্রহ্মার আদেশে—যারা যক্ষামঃ বলেছিলেন, তাঁরা যক্ষ হলেন, আর যারা রক্ষামঃ বলেছিলেন– তাঁরা হলেন রাক্ষস। সেই থেকেই বোধহয় যক্ষদের বাস পুকুরে। যক্ষরা ভীষণ রাগী। তাঁরা কুবেরের অনুচর ছিলেন। এঁদের বর্ণ কালো, মুখ বিকৃত, পিঙ্গল বর্ণের চোখ, বিরাট পেট, দীর্ঘ কাঁধবিশিষ্ট। কুবের হলেন ধন-দৌলতের দেবতা, তাঁর অনুচরেরা সেই ধনসম্পদ রক্ষা করে চলেছে। কথায় আছে ‘যক্ষের ধন’, ধন-সম্পদ রক্ষা করার কাজে যক্ষের জুড়ি মেলা ভার। যক্ষরা দেখতে যে সবাই ভয়ংকর এমনটা নয়। হাতিমুখো এক যক্ষ আছেন অমরাবতী স্তূপে। তিনমুখো এক যক্ষের নাম ত্রিমুখী, তাঁর তিনটি চক্ষু। কুবেরের হাতে থাকে টাকার থলি, তাঁর বাহন নর। অন্য যক্ষ যক্ষীরা চামর ধরে থাকে ডান হাতে। যক্ষিণীরা দেখতে যক্ষদের চেয়ে সুন্দর, অনেকেই রূপবতী, সৌন্দর্যের ছলনায় মানুষকে ভুলিয়ে দূরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে।
কিন্নর— কিন্নর শব্দের অর্থ কিম্পুরুষ; দেবলোকের সুকণ্ঠ গায়ক। স্ত্রীলিঙ্গ হল কিন্নরী, অর্থাৎ দেবলোকের গায়িকা। পুরাণে আছে কিন্নরদের ঘোড়ার মতো মুখাবয়ব এবং মানুষের মতো দেহ। পুরাণ অনুযায়ী এঁদের দু’ভাগে ভাগ করা হয়— উপমান কিন্নর ও উপমিত কিন্নর। বৌদ্ধ পুরাণ অনুসারে কিন্নর স্বর্গীয় সঙ্গীতজ্ঞ বিশেষ। অংশত পাখি। পা দুটি হাঁসের মতো। কিন্নরী বীণা এঁদের আবিষ্কৃত বাদ্যযন্ত্র। এঁরা সূক্ষ্মদেহী। পলকে বিশ্ব ভ্রমণে সক্ষম। এঁরা শুধুই স্রষ্টার আজ্ঞাবহ।
প্রেত— সংস্কৃত শব্দ প্রেত অর্থ ‘গত, মৃত, মৃত ব্যক্তি’। প্রেত হল তারাই যারা পূর্ব জীবনে মিথ্যুক, ভ্রষ্ট, বলপ্রয়োগী, ধূর্ত-প্রতারক, হিংসুক বা লোভী ব্যক্তি ছিল। এরা এমনই এক অতিপ্রাকৃত সত্তা যারা চরম ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মানুষের চেয়ে অধিক পীড়াভোগ করছে। হিন্দু ধর্ম মতে, পার্থিব শরীর জল, বায়ু, অগ্নি, পৃথ্বী ও আকাশ দ্বারা গঠিত। এরমধ্যে যেকোনও একটি বা একাধিক উপাদান কম থাকলেই তাকে প্রেত বলে।
এই পদার্থের অনুপস্থিতির কারণেই প্রেতরা কিছুই হজম করতে পারে না, তাই ক্ষুধার্ত রয়ে যায়। প্রেত অনেকটা মানুষের মতো দেখতে, তবে সঙ্কুচিত ত্বক, সরু অঙ্গ, অতিশয় ফোলা পেট ও লম্বা গলা বিশিষ্ট। প্রেতরা স্বভাবতই আবর্জনাময় ও পরিত্যক্ত স্থানে বাস করে। এরা ক্ষুধার সঙ্গে সঙ্গে অসহনীয় উষ্ণতা ও শীতের পীড়াভোগ করে। জাপানে প্রেতকে ‘গাকি’ বলা হয়। হিন্দু ধর্ম অনুসারে পারলৌকিক ক্রিয়া কর্মাদির সময় প্রেতের উদ্দেশে খাবার উৎসর্গ করা হয়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রেতদের করুণা দেখাবার জিনিস হিসেবেই দেখা হয়। বৌদ্ধ মঠে ভিক্ষুরা আহারের পূর্বে প্রেতেদের উদ্দেশে খাদ্য, অর্থ বা ফুল রেখে দেন।
পিশাচ— পিশাচ শব্দের অর্থ ভূত বা প্রেতযোনি বিশেষ। এর স্ত্রীলিঙ্গ পিশাচী বা পিশাচিনী। এরা সাধারণত শ্মশানবাসী। মৃতদেহ খায়। এরা থাকে মাটির নীচে। দেহে সূর্যের ছটা লাগলেই এরা শেষ হয়ে যায়। পিশাচরা সম্ভবত এক হাজার এবং এক রাত্রি বাঁচে। এদের অবস্থান রাক্ষসদের চেয়ে নীচে। এরা মানুষকে বিপথে ও বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। হিন্দুপুরাণে সৃষ্টিতত্ত্বের গোড়ায় আছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা দেবতা, দানব ও মানুষ তৈরি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। প্রচণ্ড খিদেয় তাঁর সর্বশরীর জ্বলছে, হঠাৎ তাঁরই গড়া একদল প্রাণী অন্য এক দলকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। এরা হল যক্ষ, রক্ষঃ বা রাক্ষস। ব্রহ্মা ভীষণ অসন্তষ্ট, রাগে তাঁর মাথার চুল খসে পড়ে। সেগুলো ক্রমে রূপ নিল সাপের। জঘন্য সেই সাপ দেখে খেপে গেলেন সৃষ্টিকর্তা। সেই ক্রোধ থেকে জন্ম নিল মাংসখেকো পিশাচ।
এ তো গেল বেশ কিছু বহুল প্রচলিত অপদেবতা বা উপদেবতার কথা। এবার বলা যাক কয়েকটি অ-লৌকিক দেবতার কথা।
মাশান— উত্তরবঙ্গের বহুল পূজিত অপদেবতা (মতান্তরে উত্তরবঙ্গের লোকায়ত দেবতা) হল মাশান ঠাকুর। এই ঠাকুরের পুজো সাধারণত শ্মশানেই করা হতো। মাশানের জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে দুটি চালু মতবাদ আছে। প্রথমটি হল—
‘নাচিতে নাচিতে কালী আইয়ের/চুইয়া পড়ে ঘাম।
তাতে সৃষ্টি হইল/এ জলা মাশান।’—অর্থাৎ, নৃত্যরতা কালীর দেহ থেকে ঝরে পড়া এক একটি ঘামের বিন্দু থেকে একটি করে মাশানের সৃষ্টি হয়েছে।
অার একটি মতানুসারে মা কালী নদীতে স্নান করতে যান। হঠাৎ সেখানে ধর্মদেবতার আবির্ভাব ঘটে। উভয়ের মিলনের ফলে জন্ম হয় মাশানের। এই মত ছাড়াও মাশান ঠাকুর আসলে যক্ষ-যক্ষীর পুত্র। অথবা মাশান ঠাকুর শিবের অন্য রূপ এইসব মতবাদ চালু বলে শোনা যায়।
ভাদ্র মাসে জন্মের পর মাশানের নাড়িভুঁড়ি মা কালী জলাশয়ে ছুড়ে ফেলেন তা থেকে কলমি শাকের উৎপত্তি। তাই প্রচলিত প্রবাদ হল, ‘ভাদর মাসে কলমু শাকে যে বা জন খায়
মাশানের নাড়ি সে অবশ্য চবায়।’
তাই মাশানে বিশ্বাসী কেউ ভাদ্র মাসে কলমির শাক খায় না।
গদ্রবঙ্গা—সাঁওতাল গোষ্ঠীর পূজিত এক বিশেষ অপদেবতা হলেন গদ্রবঙ্গা। একে অনেকে গুদ্রা বঙ্গা বা কুদ্রা বঙ্গাও বলেন। গদ্রবঙ্গার মূর্তি মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় না। এটি সাঁওতালদের হাতে বানানো বিশেষ এক পুতুল। উচ্চতা দু-তিন ফুটের বেশি নয়। দেখতে হয় অনেকটা ছোট বাচ্চা মতো। সাঁওতালদের বিশ্বাস গদ্রবঙ্গাকে আরাধনা করে খুশি করতে পারলে তিনি প্রচুর ধনদৌলত দেবেন। আর যদি পুজো করে তাঁকে খুশি না করা যায় তবে তিনি প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারেন।
এমন সব অপদেবতাদের অস্তিত্ব কতটা আছে তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। কালক্রমে এই অপদেবতার আখ্যান জন্ম দিয়েছে অনেক কুসংস্কারের। বিশ্বব্যাপী একটি বহুল প্রচলিত শব্দ হল ‘ইভিল’। মাথায় সিং, পশ্চাতে একটি চাবুকের মতো লেজ, পশুর মাথা বিশিষ্ট অদ্ভুত দর্শন প্রাণী হল ইভিল। এর মানে মন্দ বা অশুভ। তাই এই অশুভর কাল্পনিক রূপ কদাকার। এছাড়াও টিউনিসিয়ার কার্থেজ অঞ্চলের একটি অপদেবতা ‘মোলক’কে দেখতে পাই। মাথাটা ষাঁড়ের আর দেহটা মানুষের, বিকট-দর্শন এক মূর্তি। শরীরে সাতটা প্রকোষ্ঠ। নীচের দিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হতো আগুন। আগুনের লেলিহান শিখা পৌঁছে যেত সব প্রকোষ্ঠে। আর সেই শিখায় দগ্ধ হতো শিশুরা! আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করত তাদের। এইভাবে চলত একটা নৃশংস উপচার। গোটা সমাজের বুকে অপদেবতা নিয়ে জ্বলন্ত সত্য হল এই ‘মোলক’।
পরিশেষে একটা কথা বলা যায়—‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও।’ অর্থাৎ দেবতা বা অপদেবতা নিয়ে শুভ-অশুভের যুদ্ধ চলতেই থাকবে।