কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায় ... বিশদ
বেঁচে থাকার কায়দাকানুন শিখতে শিখতে আমরা সবাই মরে যাই, আর মহাসাধকেরা আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে রাজার মতো মরতে হয়। মৃত্যুর আয়নাতে জীবনের অর্থ খুঁজে নেওয়ার কথা বারবার আমাদের বলেছেন তিব্বতের শক্তিধর বৌদ্ধ সাধকেরা— Death is a mirror in which the entire meaning of life is reflected.
মন থেকে কামনা, যাবতীয় চাহিদাকে দূর করতে জানলে মরণশীল মানুষেরা অমর হয়ে যাবে। এই জীবনে সর্বাত্মা ব্রহ্মের উপলব্ধি অনায়াসে লাভ করতে পারবে— বৈদান্তিক সাধকেরা এসব কথা কবে আমাদের বলে গিয়েছেন— ‘যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যেঽস্য হৃদি শ্রিতাঃ। অথ মর্ত্যোঽমৃতো ভবতি অত্র ব্রহ্ম সমশ্নুতে।।’
মানুষের মধ্যে রয়েছে স্নেহার্দ্র হৃদয়। তাতে লেগে আছে দয়া ও মায়া। দয়া চেনা-অচেনা সকল মানুষের প্রতি হয়। দয়ার্দ্র হৃদয়— সকল মানুষের জন্য দুঃখবোধ সকলের থাকে না। এ ধরনের হৃদয়বত্তার অধিকারী হন উঁচু স্তরের মানুষেরা। দয়া সাধারণত মহাত্মাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। মায়া থাকে কেবলমাত্র নিজের বাপ, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি— এদের ওপর। মায়া মানুষকে মুগ্ধ করে, প্রতিনিয়ত বদ্ধ করে রাখে। কিন্তু সমদর্শীদের দয়ার্দ্র মনগুলো আত্মীয়, বস্তু নিজের অতি প্রিয় শরীরের প্রতি মমতা থেকে বেরিয়ে পড়ে সর্বভূতে ভালোবাসার দিকে চলে যায়। মহাপুরুষ, সাধু-মহাত্মাদের এই কারণে সর্বত্র সমদৃষ্টি লাভ হয়। সকলের প্রতি দয়া হতে হতে এঁদের মন থেকে প্রিয়জনের প্রতি ঠুনকো বন্ধন ছিঁড়ে যায়। এঁরা বন্ধনমুক্ত হয়ে দেহসত্তার ওপর থেকে নিজেদের মনকে তুলে নেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনদের দেখে অর্জুনের মধ্যে মোহ ও মায়া চলে এল। তৃতীয় পাণ্ডব ভাবতে পারলেন না, দেহের ক্ষয় ও নাশ আছে। দেহ অজর, অমর, শাশ্বত নয়। দেহের মধ্যে বাস করছেন আত্মা— তাঁর ক্ষয়-ব্যয় কিছু নেই, তিনি জন্ম-মৃত্যুহীন অমর ও শাশ্বত।
সাধারণ মানুষ দেহাত্মবোধ নিয়ে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের দেখে ও বিচার করে, তাদের শাশ্বত ও অমর আত্মার প্রতি দৃষ্টি থাকে না। তাই মোহাচ্ছন্ন অর্জুনকে জ্ঞানদৃষ্টি দিলেন শ্রীকৃষ্ণ।
কৃষ্ণ বললেন, ‘অর্জুন, তুমি যাঁদের মৃত্যু হবে এই বোধে শোক করছ, সত্যকারের তাঁরা কেউ জন্মের পূর্বে ছিলেন না, তুমিও ছিলে না, যদি বল মৃত্যুর পর এই দেহ নিয়ে তুমি থাকবে ও তোমার আত্মীয়-স্বজনেরা সকলে থাকবেন— তাও ঠিক নয়। তাই স্বজনেরা মারা যাবেন বলে আমি যুদ্ধ করব না— তোমার এ ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। এটা জেনে রেখ অর্জুন, যার সত্তা বা অস্তিত্ব আছে তার নাশ কোনওদিন হতে পারে না, কেননা সদবস্তুর সত্তা সর্বকালে সবসময় থাকে ও থাকবে। আত্মা পরিবর্তনশীল জগতে অপরিবর্তনীয় ও সত্য, সুতরাং তুমি দেহদৃষ্টি ছেড়ে দিয়ে আত্মদৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠিত হও।’
ভারতীয় দর্শন ও অধ্যাত্মবাদে বলা হয়েছে, আত্মা সর্বদা সত্য ও অবিনাশী, তাঁর জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, তিনি দেহের সীমান্তে কোনওভাবে আবদ্ধ নন, তিনি সর্বদেহে ও বিশ্বের সর্বত্র চৈতন্যময়। এক ও অদ্বিতীয় চৈতন্যরূপে বিদ্যমান— ‘নাসতো বিদ্যতে ভাবো না ভাবো বিদ্যতে সতঃ।’
ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন দার্শনিক মহর্ষি কপিল বলেছেন, ‘নাশ কথার মানে কারণাবস্থায় ফিরে চলে যাওয়া। কার্য থাকলে তার কারণ থাকবে আর কারণ থাকলে তার কার্য হবে। এটা মায়ার জগতের কথা।’
মায়ার অতীত রাজ্যের কথা বলেছে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ। জ্ঞানস্বরূপ আত্মার কথা বলতে গিয়ে সেখানে বলা হচ্ছে, ‘কারণ নেই, কার্য নেই, তা কার্য-কারণের অতীত। কার্য-কারণের অতীত এবং জন্ম-মৃত্যুর অতীত বস্তুই সত্য ও পরমার্থিক তত্ত্ব। জন্ম থাকলে মৃত্যু এবং মৃত্যুকে মানলে জন্ম— এই জাগতিক তত্ত্ব একমাত্র মরণশীল দেহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শাশ্বত দেহী আত্মার ক্ষেত্রে কখনও সত্য নয়।
মানুষের বিশ্বাস, মৃত্যুর পর কোনও অস্তিত্ব থাকে না— শূন্যে বিলীন হয়ে যায় আত্মা। সাধকেরা বললেন, ‘মানুষ ও সকল প্রাণী জন্মগ্রহণ করে যে যার কর্মফল নিয়ে, ভোগভূমি সংসারে এসে কিছুকাল তারা কৃতকর্মের ফল ভোগ করে আবার নতুন কর্মফল সৃষ্টি করে, তারপর ভোগের শেষে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। সেই বিদায় কিন্তু চিরদিনের জন্য হয় না— কিছু সময়ের জন্য, আর এই বিচ্ছেদ ও মিলন অনন্তকাল ধরে চলছে।’
বাসনা-কামনার পথে থাকলে, মানুষের আসা-যাওয়া চলবে। গীতায় অক্ষরব্রহ্মযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই তত্ত্ব পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যে অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে মানুষ ইহলোক থেকে চলে যাবে, সেই না পাওয়া চাহিদাই তাকে ফের বদ্ধ করে পৃথিবীতে টেনে আনবে।’
মহাত্মারা বলছেন, ‘নিবৃত্তির পথ ধরো। তাহলে সংসারে থেকে যে কষ্ট পাচ্ছ মিলন-বিচ্ছেদের খেলায়, মৃত্যুর আগে যদি খেদহীন হও, কোনও আক্ষেপ রেখ না মনে, আত্মস্থিতি, ব্রাহ্মীস্থিতির সাধনা শিখতে পার গুরু লাভ করে, তবে জন্ম মৃত্যুহীন আত্মার সর্বব্যাপক পরমসত্তাকে তুমি ধরতে পারবে। মৃত্যুলোক ও মৃত্যুর অতীতলোক নিয়ে মনে কোনও কৌতূহল বা প্রশ্ন আসবে না। অমরাত্মার অমৃতময় সত্তার অস্তিত্ব তুমি টের পাবেই পাবে।’
ভারতীয় দর্শন ও অদ্বৈতবাদের পুঁথি পড়লে বোঝা যায় যে, মানুষ এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয় না, যতদিন পর্যন্ত— না শাশ্বত স্বরূপকে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে ততদিন সে বারবার মরজগতে যায় আর আসে এবং নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ফলে কোনও এক জন্মে তার বিবেক-বিচারের পথ সদগুরুর কৃপায় উন্মুক্ত হয়, তার অজ্ঞানের অন্ধকার দূর হয়, সে উপলব্ধি করতে পারে জন্ম- মরণশীল আপন অমৃতসত্তাকে।
সংসারে কাজ করতে গিয়ে মানুষ গণ্ডগোল পাকায়। কাজের ফল আশা করে নানারকম বন্ধন ও মায়ার সৃষ্টি করে ফেলে। এটাই মায়াদেবীর খেলা। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বললেন, ‘মায়াকে তোমরা জানো। তাকে যদি একবার জেনে যাও, মায়া আর থাকে না। মায়া ব্রহ্মে লীন হয়ে যায়। মৃত্যুলোক বলে তখন কিছু থাকে না। মহামুক্তিতে বারে বারে মানুষের জন্ম-মৃত্যুর সমস্যাটা মিটেও যায়।’
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ তাই বললেন, ‘সব কাজ তোমরা করে যাও। সেই কাজ থেকে কোনও ফলের আশা না করা ভালো। ফল চাইলে আকাঙ্ক্ষা পুনরায় তোমাকে কর্মের-সংসারে টেনে আনবে। আবদ্ধ করে দেবে। জন্ম-মৃত্যুর পথে যাওয়া আসা তোমার আর শেষ হবে না। কর্ম কর জগতের কল্যাণের জন্য। পরের জন্য কাজ করলে মনে নিরাসক্তির ভাব সৃষ্টি হবে। চাওয়া-পাওয়ার বাইরে এই অচঞ্চল ভাব এলে তোমার মনে শুদ্ধ চৈতন্যের জন্ম হবে। এ চৈতন্য তোমাকে তৎক্ষণাৎ পরমচৈতন্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেবে। একটা সময় পর সংসার বন্ধন থেকে তোমার মুক্তি হবে। না হলে দিন যাবে, রাত্রি আসবে, সুখ যাবে ও দুঃখ আসবে, জন্ম হবে ও মৃত্যু আসবে। আলো-ছায়ার কিনারা তুমি কোনওকালে করে উঠতে পারবে না।’
আমাদের বেঁচে থাকাটা স্থূল ইন্দ্রিয়ের রাজ্য। সূক্ষ্ম মনের ও মানসিক সংস্কারের আলাদা একটা রাজ্য আছে। সেটা জাগ্রত অবস্থার বিষয় নয়। জেগে থেকে আমরা যে সমস্ত কাজ করি, স্বপ্ন-অবস্থায় তাদের সংস্কার মনের মধ্যে বসে যায়। জীবাত্মা সূক্ষ্মদেহে সেই সব ভোগ করে। স্বপ্ন বা সুষুপ্তির জায়গা হল সূক্ষ্মলোক। অজ্ঞানের জন্য জীবাত্মা পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে, ভোগ করছে ও যা কিছু কাজ করছে সমস্তটাই ভোগের বস্তু বাসনা-কামনার প্রেরণায়।
সূক্ষ্মলোকে বাসনা-কামনা বলে কিছু নেই, দ্বৈত বা দুই জ্ঞান নেই, আছে এক ও অখণ্ড জ্ঞান এবং শাশ্বত আনন্দ। যাঁরা এই লোকের বাসিন্দা তাঁরা হলেন প্রাজ্ঞ। আমরা প্রত্যেকে ইহজগতে স্থূলভোগের মধ্যে বসবাস করি। স্থূলভোগে বিতৃষ্ণা এলে কিংবা নানান মায়া ও বন্ধনে তিক্ত হলে মন, গুরুর আশ্রয়ে গিয়ে সূক্ষ্ম-সংস্কার লাভ করলে নিবৃত্তির প্রথম স্তর কারণের অবস্থায় চলে যায়। প্রবৃত্তির বীজ ধ্বংস হতে থাকে, বিবেক-বিচারের পথে যেতে সাহায্য করতে থাকেন মহাত্মা, গুরু কিংবা সাধকদের নানান উপদেশ। বা সাধুসঙ্গ। এসবের ফলে বীজসংস্কারহীন একটা আনন্দলোক তৈরি হয় মনে। এ ভাবটিকে আচার্য গৌড়পাদ বললেন, ‘পৃথিবী ভোগের জায়গা। শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে আমরা এখানে ভোগ করি। ত্যাগ এলে পরমামৃতরূপ আত্মার ছবি ধরা পড়ে মনে, আমরা আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হই।’
সাধারণ মানুষ হিসেবে যে আত্মার কথা আমরা মনে করি সে হল বিদেহী আত্মার কথা। আবার পূর্বপুরুষ যাঁরা পৃথিবীতে সংসারে পরমাত্মীয় হয়ে সুখ-দুঃখের অংশীভূত হয়ে আমাদের সঙ্গ দিয়ে গেছেন, তাঁরা আজ কোথায়? এই প্রশ্ন কোনও না কোনও সময় আমাদের মনে পরম কৌতূহল তৈরি করে। সত্যিই তো, তাঁদের অস্তিত্ব বলে কী কিছুই নেই! এই প্রশ্ন বিশ্বব্যাপী মানুষের প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্ল্যানচেট করে প্রিয়জনের আত্মার সাক্ষাৎকার করেছেন। দেশে-বিদেশে এই নিয়ে চর্চার অন্ত নেই।
অশরীরী আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন বহুখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার উইলিয়ম ক্রুক্স। তিনি তাঁর স্ত্রীকে মিডিয়াম করে অশরীরী আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন উনিশ শতকের শেষভাগে। ১৮৭০ সাল থেকে ক্রুক্স তাঁর বাড়িতে অশরীরী আত্মাদের বৈঠক বসাতেন। মিসেস ক্রুক্স কেটি কিং নামে এক বিদেহী আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ আসত, ছবিও তোলা হতো। কেটি কিং তাঁর চুল উইলিয়ম ক্রুক্সের বাড়িতে আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে আগ্রহশীল উপস্থিত ব্যক্তিদের বিতরণ করেছিলেন। আমেরিকায় মিস্টার ক্রুক্স প্রথম অশরীরী আত্মাদের নিয়ে গবেষণা কর্ম শুরু করেন। এর ১৫ বছর পর লন্ডনে বিদেহী আত্মাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও পরলোকতত্ত্ব নিয়ে পুরোদমে গবেষণা করার জন্য একটি সংসদ গঠন করা হয়। যার নাম সোসাইটি ফর দ্য সাইকিক্যাল রিসার্চ— সংক্ষেপে এস. পি. আর। এখানে গবেষণা করতেন এডমাণ্ড গারেন, ডক্টর এফ ডব্লিউ, এইচ মায়ার্স, ফ্রাঙ্ক পোডমোর। এস. পি. আর-এর সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মায়ার্স। তিনি তাঁর বন্ধুমহলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, মৃত্যুর পর দেখা দেবেন।
অধ্যাপক মায়ার্স মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে স্যার অলিভার লজের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করেন। তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত মিডিয়াম মিসেস টমসনকে অধ্যাপক মায়ার্স বলেন, ‘আমার মৃত্যু হয়েছে এটা বুঝে ওঠার আগে পর্যন্ত আমি ভেবেছিলাম যে, একটা অজানা শহরের বুকে আমি হারিয়ে গেছি।’
‘হিউম্যান পার্সোনালিটি অ্যান্ড ইটস সারভাইভাল আফটার বডিলি ডেথ’ নামে একটি বহুল প্রচলিত বইও এইচ মায়ার্স এস. পি. আর-এর সভাপতি থাকাকালীন সময়ে লিখে গিয়েছেন।
এস. পি. আর-এর আমেরিকা শাখার সভাপতি ডক্টর হজসনও মৃত্যুর পর ফিরে আসেন মিসেস পাইবারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। অধ্যাপক উইলিয়ম জেমস ছিলেন আমেরিকা শাখার সহ সভাপতি। তিনিও মৃত্যুর পর মিডিয়ামের মাধ্যমে এসে জানালেন, ‘এমন মানুষ যাঁরা আছেন প্রেতসাধনাতে ইচ্ছুক তাঁদের কাছে আমি আসি। আমি এসেছি এখন এক প্রেত সাধকের শরীরে, যিনি নিজে বেরিয়ে গিয়ে তাঁর শরীরটি আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন।’
শঙ্করাচার্য সম্পর্কে প্রসিদ্ধি আছে যে, তিনি অমেরু রাজার দেহে প্রবেশ করেছিলেন কামকলা তত্ত্বের পরিশীলন করবেন বলে। ভারতের প্রাচীন যোগীরা পরকায়া প্রবেশ জানতেন। দেহকে বিদেহ দশাতে এনে ফেলার সাধনা অতি পুরনো সাধনা। আব্রাহাম, জেকব, মোজেসের সময় থেকে যিশু ও তাঁর শিষ্যদের সময় পর্যন্ত বহু ঋষি, মুনি, মহাসাধকেরা বিদেহী আত্মাদের দেখেছেন, তাঁদের কথাবার্তা শুনেছেন, তাঁদের শিক্ষা অনুসরণ করেছেন। আত্মাকর্ষণী একটি প্রাচীন বিদ্যা। এই বিদ্যার মাধ্যমে মৃত আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব। আত্মাকর্ষণী সাধকেরা বলেন, ‘মানুষেরা শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া, শরীরে প্রবেশ করা, সেখানে ঢুকে বিষয় সমূহকে ভোগ করা— এগুলোর কোনওটা মনে রাখতে পারে না বলে সাধারণ ভাবনা ওঠে সকলের মনে, মৃত্যুর পর জীবন শেষ। কথাটা একেবারে যে সত্য নয়। মৃত্যুতে জীবনের শেষ হয় কখনও, মৃত্যুর পর সমস্ত কিছু শেষ হয়ে যায় না। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর সময়ে যেটা হয়, শরীর থেকে আত্মা আলাদা হয়ে যায়, শরীরের ইন্দ্রিয়গুলো শরীরের ভেতরে থেকে যায়, কিন্তু তাদের আর কাজ করবার ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু মানুষের মনটা যে কাজ করে চলে! মন সূক্ষ্ম বাসনা অর্থাৎ না-মেটা কামনার খেদ নিয়ে সূক্ষ্ম সংস্কারে জড়িয়ে পড়ে আত্মার সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন যাত্রার পথে বেরিয়ে পড়ে।’
যাঁরা উচ্চকোটির সাধক তাঁদের মৃত্যুকালে কামনার খেদ থাকে না বলে মৃত্যু এঁদের সামনে কেবল নতুন দিগন্তের দরজা খুলে দেয়। মৃত্যু হল নিগম আর জন্ম আগম। সাধকের মৃত্যু হয় ধ্যানমগ্ন অবস্থায়, আর সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয় শারীরিক বেদনাদায়ক অবস্থায়। সাধকেরা শরীর থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন বলে চেতনার অবস্থায় থেকে অচেতনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন। সাধারণ মানুষের আত্মা অচেতন অবস্থায় শরীর থেকে বেরিয়ে যায় বলে মহাসাধকেরা এইসব আত্মাগুলোকে কর্ষণী বিদ্যার মাধ্যমে টেনে এনে সংযোগ স্থাপন করে কাজে লাগাতে পারেন।
তিব্বতি সাধকেরা বলেন, ‘কোনও কারণে কর্মফলে যারা জন্ম নিতে পারছে না, তারা চাইছে কর্মফলটাকে খণ্ডন করতে। জীব কল্যাণের জন্য এইসব আত্মারা উদগ্রীব হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেহেতু এরা বিদেহী, শরীরহীন, অশরীরী, তাই কাজকর্ম কিছু করতে পারছে না। এরা সব ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর আকাশে বাতাসে। যোগীরা যখন ধ্যানের গভীরে চলে যান, অনেক সময় এই আত্মারা জগতের কল্যাণার্থে ঢুকে পড়ে এঁদের দেহে, তারপর কর্ম শেষ করে দেহ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারে। উপযুক্ত পুনর্জন্মের কর্মফল এভাবে আত্মারা সংগ্রহ করে নিয়ে জীব হয়ে ফের জন্মগ্রহণ করে।’
আলেকজেন্ড্রা ডেভিড নীল ফ্রান্সের মানুষ। তিনি প্যারিসের পাসপোর্ট অফিসে এসেছিলেন একশো বছর বয়সেও। উত্তেজিত স্বরে তিনি অফিসারকে বলছিলেন, ‘আমি ষষ্ঠ বারের জন্য তিব্বতের লাসা শহর পরিভ্রমণ করতে চাই।’ ভগ্ন স্বাস্থ্য ও বার্ধক্যের কারণে চিফ অফিসার তাঁর পাসপোর্ট রিনিউ করতে চান না। অনেক বাকবিতণ্ডার পর বৃদ্ধার জেদাজেদিতে তাঁর পাসপোর্ট শেষ পর্যন্ত রিনিউ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই ঘটনার অল্প কয়েকদিন পরে হার্ট অ্যাটাকে নীল মারা গেলেন। ষষ্ঠ বারের জন্য তাঁর লাসা পরিদর্শনের ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়।
ডেভিড নীল তিব্বতের রহস্যময় বাতাবরণে প্রবেশ করেছিলেন অপরিসীম কষ্ট ও বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়ে। অনেক বিপদের সামনে তাঁকে পড়তেও হয়েছিল। তিনি নিজের রূপ ও রং লুকিয়ে ছদ্মবেশে তিব্বতি তন্ত্রসাধকদের সঙ্গে মিশতেন। তিনি তাঁর জীবনের বহুমূল্য ১৫ বছর এঁদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। লামাদের কাছ থেকে তিনি যোগ ও তন্ত্রবিদ্যা শিখেছিলেন। তিব্বত যাওয়ার আগে ডেভিড নীল ভারতে এসেছিলেন বেদান্ত দর্শনের পাঠ নিতে। ১৯৬০ সালে প্যারিসে তিনি মারা যান একশো বছর বয়সে। ১৯৩১ সালে বের হয় তাঁর পৃথিবী বিখ্যাত বই ‘বিদ্ উইথ মিস্টিক্স অ্যান্ড ম্যাজিসিয়ান্স ইন টিবেট।’ সেখানে তিনি লামাদের সিদ্ধি, যোগাভ্যাস, তান্ত্রিক চমৎকারিত্ব, আত্মাকর্ষণী বিদ্যার কথা লিখেছেন।
ডেভিড নীল লিখছেন, ‘আমি নিজের চোখে কয়েকজন লামাকে দেখেছি সহসা অদৃশ্য হয়ে যেতে এবং আবার আমার সামনে উপস্থিত হতে। তিব্বতের অতি প্রাচীন মঠ শালুমঠ। এখানে লুংগম শেখানো হয়। সাধক প্রথমে একটা মোটা গদির ওপর পদ্মাসনে বসেন। তারপর প্রাণায়ামের পূরক বিধি দিয়ে নিজের শরীরে বায়ু ঢুকিয়ে নেন। এরপর কুম্ভক করে করে কয়েক বছরের এ অভ্যাসে তাঁরা শরীরকে হালকা করে ওড়ার শক্তি অর্জন করতে পারেন। আমি লামাদের আকাশপথে গমন করতেও দেখেছি, পরকায়া প্রবেশও দেখেছি। এইসব বিদ্যা শেখার জন্য কঠোর থেকে কঠোরতম অভ্যাস করতে হয়। আমার সঙ্গে এমন একজন লামার দেখা হয়েছিল, যাঁর আগের জন্ম সৌরজগতের অন্য এক গ্রহে হয়েছিল। পরে তাঁর পুনর্জন্ম হয় এই পৃথিবীতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, এই জগতের সঙ্গে সেই জগতের অনেক তফাৎ। সেখানে সকলের আয়ু অনেক বেশি। কাজের স্বতন্ত্রতা আছে ওই জগতে। ওখানে ছল, ঈর্ষা, প্রবঞ্চনা, হিংসা— এসবের অস্তিত্ব নেই। জীবন সদা আনন্দময়।’
প্রসিদ্ধ সন্ত সেন্ট অগাস্টিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি মণিকা নামে একজন যোগিনীকে চিনি, যিনি প্রার্থনা করার সময় তিন ফুট ওপরে উঠে যেতেন। তাঁর শরীরের কোনও গুরুত্ব ছিল না। তিনি বায়ুমণ্ডলে ভাসতে পারতেন।’
ইজিপ্টে সেন্ট মেরি নামে এক যোগিনী ছিলেন। তিনি প্যালেস্টাইনের মরুভূমিতে একা থাকতেন। ফাদার জোজিমাস তাঁকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। মেরি পূর্ব দিকে মুখ করে প্রার্থনা করছিলেন এবং তাঁর দেহ মাটি থেকে পাঁচ ফুট ওপরে উঠে আছে!
বিশপ সেন্ট আরের গির্জা বন্ধ হয়ে গেলেও যোগকৌশলে খুলে নিতে পারতেন। প্রহরীদের কাছে চাবি, ঘর খোলা। ঘরের মেঝেতে বসে প্রার্থনা করছেন। ঘর দিব্য আলোকে ছেয়ে আছে। প্রহরীরা ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, তাঁর দেহ শূন্যে ভাসছে। ভারতীয় যোগীদের মধ্যেও এরকম অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। কাশীতে কিনারাম বাবার আসন শূন্যে ভেসে চলত। কাশীর প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক ভাস্কর রায়ের আসনও ধ্যানের সময় ওপরে ভাসত। পুরো ঘরে আলোয় ভরে উঠত।
বারো বছর বয়সে দীক্ষার পর গুরু অনঙ্গদেবের সঙ্গে রাম ঠাকুর শুরু করলেন পরিব্রাজক জীবন। হিমালয়ের শিখর অভিমুখে চলেছেন। চলতে গিয়ে প্রচণ্ড তুষারঝড়। বালক রাম শীতে নিঃসাড় হয়ে পড়ল। গুরুদেব পেটের কাছে আগলে পৌঁছলেন পর্বতের শেষ চূড়ায়। সেখানে এক গুহা। রাম ঠাকুর কাশীতে বসে প্রখ্যাত পণ্ডিত গোপীনাথ কবিরাজকে বললেন, ‘ওটাই বশিষ্ঠাশ্রম। পৌঁছে যুগলমূর্তি দেখতে পেলাম। প্রণাম করার পর মাতৃমূর্তি আমার হাতে একটি ফল দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। গুরুদেব বললেন, এ ফল তোমারই জন্য নির্ধারিত। খেয়ে ফেল। কী করে মাঈ নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ভেবে বিস্মিত হচ্ছি! আরও বিস্ময় উপস্থিত হতে থাকল।’
বশিষ্ঠাশ্রমে দু’একদিন থাকার পর অনঙ্গদেব রামকে নিয়ে চলেছেন পূর্বদিকের দুর্গম সিদ্ধপীঠে। সেখানে গুহাও নেই। বরফ ঢাকা পথের চারদিকে চারটি স্ফটিক স্তম্ভ। মাঝে তুষারশুভ্র শিবলিঙ্গ। এক জটাজূটধারী ভৈরবী ধ্যানস্থা হয়ে রয়েছেন। তিনি অনঙ্গদেবের কথায় তপঃসিদ্ধ দিব্যদেহ থেকে জ্যোতি বের করতে করতে তাঁদেরকে নিয়ে চললেন প্রাচীন গুহায়। গুহার সামনে ধুনি জ্বলছে। সেখানে বসে অতি বৃদ্ধ এক মহাত্মা সাধনা করে চলেছেন। গুরুদেব তাঁকে বললেন, ‘রাম, মহাত্মন দেবকল্প মহাসাধক। বহু শত বছর ধরে এভাবে বসে আছেন। এটা যোগীদের রাজ্য। যোগেশ্বর আশ্রম। আজ তিনি শরীর বদল করবেন। বহু পুণ্যবলে তোমার এই অলৌকিক অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ মিলেছে।’
যুবক রাম অতি আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, এ কী করে সম্ভব হবে! তৎক্ষণাৎ যোগাসনে উপবিষ্ট মহাপুরুষের নিথর দেহ স্পন্দিত হয়ে উঠল! মুখ থেকে মন্ত্র বের হতে লাগল। ধুনির আগুন দপ করে উঁচুতে উঠে পড়ল। রাম দেখলেন একটা বিশালকায় সাপ সেখানে চলে এল। মহাত্মন সাপটাকে ধরে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধুনির আগুনে ছেড়ে দিতে ভস্মমাখা মাংস পিণ্ড বের হল। মহাপুরুষ পিণ্ড খাওয়া মাত্র শরীর ফুলে বিকট আওয়াজে ফেটে তরুণ তাপসমূর্তি উঠে এল। গুরুদেব বললেন, ‘রাম একে বলে কায়া বদল। যোগীরা সাধনা করতে করতে জীর্ণ শরীর ফেলে নতুন শরীর নেন।’
রাম ঠাকুরের সম্মুখে বিস্ময় যে বাকি ছিল। তিনি দেখলেন শরীর বদল করা মহাপুরুষ তাঁর সামনে দিয়ে বৃদ্ধ যোগীর পরিত্যক্ত আসন, চিমটা ও কমণ্ডুলু নিয়ে ধীরে ধীরে অরণ্যে ঢুকে যাচ্ছেন। তিনি গোপীনাথ কবিরাজকে বললেন, ‘জায়গাটা কৌশিকী আশ্রম। আপ্তকাম যোগী ও উচ্চকোটির সাধকেরা থাকেন।’
গোপীনাথ কবিরাজ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় এই আশ্রম?’
রাম ঠাকুর বললেন, ‘মানস সরোবর পেরিয়ে অনেক দূরের পথ।’
কবিরাজ মশাই বললেন, ‘বহু তীর্থযাত্রী সেখানে যান, কেউ আশ্রম দেখতে পান না কেন?’
রাম ঠাকুর বললেন, ‘দিব্য আশ্রম সহজে দেখা যায় না। মনের আসক্তি দূর হলে কায়াসাধনে সিদ্ধ গুরুদেব নিয়ে যেতে পারেন কোনও নির্বাচিত শিষ্যকে।’
অজ্ঞানতা ও অচেতনার অবসান যদি ঘটানো যায় তবে নিজের মধ্যে আত্মা ও অজ্ঞাতের আহ্বানের সম্ভাবনা তৈরি হয়। এ তো আর সকলের মধ্যে ঘটার জিনিস নয়। জৈব ও শারীরিক চেতনার অগ্রগতিকে রুখে দিতে পারে যোগকৌশল। যোগের মাধ্যমে আত্মা যায় মুক্তির দিকে। আত্মা প্রত্যেকবার জন্মগ্রহণ করে এবং সে যতটা কর্ম সঙ্গে নিয়ে যায়, তার ফলাফল পরের জন্মে এসে ভোগ করে। আত্মা বারবার জন্ম নিচ্ছে, কর্ম থেকে নানান অভিজ্ঞতা লাভ করছে— এ রকম চলে ততদিন, যদ্দিন মানুষের জড় আধার থাকে, অজ্ঞানতা ও অচেতনার মধ্যে মানুষ বসবাস করে। মানুষের মূল সত্তাটাই বারবার জন্ম নেয়, বাইরের সত্তা নয়, বাহ্যসত্তার একটা আধার দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকার কালে অভিজ্ঞতাগুলো সঞ্চয় করে মাত্র। মূল সত্তা ফের যখন জন্ম নেন, আর একটা ব্যক্তিস্বরূপ গড়ে নেয়, তার শক্তিসামর্থ্য ও জীবনধারা অন্যপ্রকার হয়ে যায়। ধরা যাক, একজন সঙ্গীতশিল্পী আবার জন্ম নিলেন, হয়তো পরবর্তী জীবনেও তিনি গানই গাইলেন, কিন্তু তিনি হয়তো আগে যেমন বিপুল সমাদৃত ছিলেন দেশ বিদেশে, এবার হয়তো তিনি কেবলমাত্র উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেন, যেটা তিনি গত জীবনে শিখতে চেয়েছিলেন, সে সময় নানা ধরনের হিট সিনেমায় গলা দিতে গিয়ে সম্ভবপর হয়নি আর।
আর এক জন্মে হয়তো তিনি আদৌ গাইয়ে হলেন না, পরমসত্যকে প্রাপ্ত করার একটা প্রচ্ছন্ন ঝোঁক তাঁর হয়তো বিগত জন্মগুলোতে ছিল, নতুন জন্মে সে বাসনা পূরণ হয়ে গেল। তিনি হয়তো হয়ে উঠলেন ঋষি অরবিন্দের মতো একজন দার্শনিক ও যোগী।
শারীরিক রূপান্তরের ধারণা পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাধকদের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে। সেন্ট পলের অসাধারণ অতীন্দ্রিয় অনুভূতি সব হয়েছিল এবং নিশ্চিতভাবে সুগভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছিল বলে তিনি স্থূল শরীর বা জড় দেহের বাইরে জ্যোতির্ময় দেহের কথা বলতেন। সাধকের শরীর যখন জ্যোতির্ময় পর্যায়ে চলে যায়, সেখানে প্রকট হয় আপন জগৎ, নিজস্ব ধাতু দিয়ে তৈরি ও-জগতে মরদেহ বলে কিছু যে থাকে না, জড় আবরণ, দেহকে যা আচ্ছন্ন করে রাখে, তাকে অবলুপ্ত করে দিতে পারেন উচ্চকোটির সাধকেরা। বৈষ্ণবরাও বলেন দেবশরীরের কথা। সিদ্ধি পূর্ণ হলে যা এই শরীরের স্থান গ্রহণ করে। অনেকে বলেন, অতি-প্রাকৃত দেহ। মরকে অমরত্ব দেয় এইসব শরীর। এক আধ্যাত্মিক শক্তি যা ভেতরে ঢুকে পড়ে আর এক ধরনের জ্যোতির্ময় স্ফীতি ঘটায়। এই শরীর, যে নিজের ভারে ফুটে ওঠে, দীপ্ত হয়ে ওঠে, নমনীয় ও জ্যোতির্ময়। সাধকের দেহের সঙ্গে সাধারণ মানুষের এই পার্থক্য থাকে। তাই ইন্দ্রিয়ের মধ্যে বিরাজ করা সাধারণেরা কি করে আত্মার উপস্থিতি টের পাবে?
১৯৩৪ সাল— বাংলা ১৩৪১ সনের ২৭ কার্তিক উত্তর-বাংলা সারস্বত আশ্রম, বগুড়াতে ঠাকুর নিগমানন্দকে এক শিষ্য প্রশ্ন করলেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলে মরে কে এবং ফলভোগ করে কে?’ প্রথম জীবনে ঠাকুর ছিলেন নাস্তিক, জন্মান্তরবাদ মানতেন না। বিয়ে করেছেন সদ্য সদ্য। সেটেলমেন্টের কাজে নারায়ণপুর আছেন। রাতে টেবিল বাতির আলোতে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন সামনে স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। চমকে উঠে ভ্রম মনে করে বার বার দেখার পর বুঝলেন স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে স্ত্রীর মুখখানা বেশি জ্যোতির্ময় দেখাচ্ছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। ধীরে ধীরে স্ত্রীর ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল। পরদিন কুতুবপুর থেকে খবর পেলেন ঠিক ওই সময়ে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এরপর হতে তিনি প্রেততত্ত্ব ও পরলোকতত্ত্ব বোঝার জন্য উৎসুক হলেন। নারায়ণপুর থেকে চলে গেলেন মাদ্রাজ। সেখানে থিওসফিক্যাল সোসাইটিতে যোগ দিয়ে পরলোকতত্ত্ব সম্বন্ধ গভীর গবেষণায় প্রবৃত্ত হলেন। ওখানে থাকতে প্ল্যানচেট করলেন। মিডিয়াম দিয়ে আত্মা আনালেন। মিডিয়ামের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে স্ত্রী সুধাংশুবালার আত্মা কথাও বলল। নিগমানন্দ লিখছেন, ‘আমি তাকে অনুরোধ করলাম— তুমি তোমার পূর্বস্বরে সেই গানটি গাও দেখি! আশ্চর্য! অবিকল সে সেই স্বরে গান গাইল। আমার তৃপ্তি হল না। আমি চাই প্রত্যক্ষভাবে তার দর্শন, তার সঙ্গে আলাপ। কলকাতায় এসে শুনলাম স্বামী পূর্ণানন্দ পরমহংসের কথা। তিনি আমার প্রতি দৃষ্টি করা মাত্রই আমার অবস্থা বুঝে ফেললেন। তিনি বললেন— তুমি যে তোমার স্ত্রীকে পেতে চাও, সেই স্ত্রী এবং স্ত্রী মাত্রেই সেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার ছায়া।’
পূর্ণানন্দের কথাতে যুবক নলিনীকান্তের মন টলল না। তিনি কাশী এলেন। সেখানেও মৃত স্ত্রীকে দেখাতে পারেন এমন সাধকের খোঁজে ব্যর্থ হয়ে কর্মস্থল নারায়ণপুরে ফিরে এলেন। এক রাতে স্বপ্নে জ্যোতির্ময় সৌম্যমূর্তি দেখতে পেলেন। একজন পাকা চুলের উজ্জ্বলবর্ণ পুরুষ তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারাপীঠ গিয়ে বামাখ্যাপার শরণাপন্ন হতে।
নিগমানন্দ লিখছেন, ‘আমি অমনি চলে এলাম তারাপীঠে তাঁর আদেশক্রমে। বামাখ্যাপা বললেন— ওরে, মায়ের মধ্যেই যে সব! ওর দেখা পেলেই সব পাবি। তোকে আমি সাধনা শিখিয়ে দেব। কয়েক দিনের মধ্যে আমায় সাধনপ্রণালী দেখিয়ে আর শিখিয়েও দিলেন। নির্দিষ্ট দিন রাত্রিতে সাধনায় বসলাম। সেই এক রাত্রির সাধনায় মায়ের দর্শন পেলাম দর্শনের আগে আমার শরীর থেকে প্রথমে তরল জ্যোতি বের হয়ে গিয়ে জমাট বেঁধে একটা ঘন জ্যোতির আকার ধারণ করল, ক্রমে তা আমার মনোময়ী মূর্তিতে পরিণত হল।’
বগুড়ায় ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে নিগমানন্দদেব বললেন, ‘মরে দেহ। মৃত্যু হলে সূক্ষ্ম শরীর বের হয়ে যায়। তার সঙ্গে মন-বুদ্ধিও চলে যায়। সুখ-দুঃখ ভোগ করে মন। মৃত্যুর সময় মন-বুদ্ধিসহকারে একটা বায়ু শরীর থেকে বের হয়ে যায়। কিছুদিন পর্যন্ত তা বায়ুভূতো নিরাশ্রয় অবস্থায় থাকে। তারপর মন-বুদ্ধি নিয়ে সূক্ষ্ম শরীর গঠিত হয়। কম্পনের দ্বারা ক্রিয়া হয়। বাহ্যকরণ ইন্দ্রিয়গুলি। তার সমষ্টি দেহ। জ্ঞানেন্দ্রিয় মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহং— এই সকলের সমষ্টি অন্তঃকরণ। পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় সংগ্রহ করে তবে আত্মার ভোগ। শ্রাদ্ধের সময় ১০টা পিণ্ড যে দেওয়া হয়, তাতে ১০টা ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি হয়। আত্মহত্যা যারা করে, তাদের দেহ ধারণ করতে অনেক সময় লাগে। উন্নত জীবের শীঘ্র দেহ হয়। অজ্ঞানী আর দেহাত্মবাদীর অনেক সময় লাগে। যাদের দৃষ্টি খুলেছে, তারা ওই সমস্ত দেখতে পায়। সাতটি লোক। প্রত্যেক লোকে সাতটি করে স্তর। তাকেই প্রচলিত উনপঞ্চাশ বায়ু বলে। জীবের মৃত্যুর পর পরলোকগত আত্মার স্থিতি, অবস্থানুসারে এক এক স্তরে হয়। এক স্তর থেকে সেখানে ভোগ শেষ হলে আবার নতুন স্তরে নতুন দেহে জন্ম হয়। এইরূপে মানুষ যে কতবার জন্মে, কতবার মরে, তার ইয়ত্তা নেই।’
আমাদের দেহটা তিনটি শক্তির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকে। দেহের মধ্যে থাকে মল অর্থাৎ ময়লা বা মলিন সংস্কারজনিত দোষত্রুটি। এসবের মধ্যে থেকে মানুষ তখন বেরতে পারে, যখন সে নিষ্কাম কর্ম কীভাবে করতে হবে সেই প্রক্রিয়াদি শিখে ফেলে। কাজ থেকে ফলাফলের আশা না রেখে শুধু কাজটিকে যিনি প্রাধান্য দিতে শিখে যান— কাজের সাফল্য-ব্যর্থতা, ভালো-মন্দ, কাজ থেকে যশ-অখ্যাতি, নিন্দা-প্রশংসা কোনওকিছু যখন তাঁর মনে রেখাপাত করে না, তিনি তখন অবিদ্যার প্রধান শক্তি মল থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন। আমাদের মধ্যকার অবিদ্যার দ্বিতীয় শক্তি হল বিক্ষেপ অর্থাৎ মনের চাঞ্চল্য। শ্রীকৃষ্ণের পর্যন্ত চিত্ত-চাঞ্চল্য ঘটেছিল একটা সময়। সকলেরই এটা ঘটে। ঋষি-মুনি-যোগি থেকে সাধারণজন কেউ এর বাইরে নন। মনের ওঠা-পড়ার উৎপাত সকলকে ভোগ করতে হয়। মনের এহেন উৎপাত নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ গেলেন তাঁর গুরু ঋষি আঙ্গিরসের কাছে। আঙ্গিরসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর উপদেশ শুনে শ্রীকৃষ্ণ ‘অপিপাস’ অর্থাৎ অনাসক্ত হয়েছিলেন। পরে যখন চিত্ত স্থিরকৃত দশায় অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী হলেন, তিনি গুরুর সহায়তায়, ভগবদগীতার প্রবক্তা হয়ে অর্জুনসহ আমাদেরকেও শেখালেন— মনকে কেমন করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মনে নিবৃত্তি আসবে উপাসনার দ্বারা এবং নিজের আবরণ অর্থাৎ স্বরূপ-বিস্তৃতি— যা আমাদের অজ্ঞানের মুখ্য লক্ষণ, তার বিনাশ হবে জ্ঞানের মাধ্যমে। আবরণ বা স্বরূপ-বিস্তৃতি অবিদ্যার তৃতীয় শক্তি। বৈদিক ঋষিরা বললেন, ‘উপাসনা করলে জ্ঞান আসবে। ব্রহ্ম বা পরমাত্মার কোনও একটা নাম বা প্রতীক— যা মনকে তোমার অবিচল একাগ্রতায় সন্তত করবে।’
সমস্ত উপনিষদে পরমতত্ত্বকে ব্রহ্ম বা আত্মারূপে ব্যাখ্যা করেছেন ঋষিরা। কিন্তু ঋগ্বেদে ব্রহ্ম বা আত্মাকে পরমতত্ত্বরূপে স্তুতি করা হয়নি, বলা রয়েছে দেবতা বা পরমপুরুষের কথা। দেবতারা হলেন পরমপুরুষ বা পরমাত্মার নানা নাম-রূপ। অনামী, অরূপ, অসীম ব্রহ্মকে নাম-রূপের সীমার মধ্যে অনুভব করতে শেখার কৌশলগুলো আমাদের দেখালেন ঋগ্বেদের ঋষিরা। দেহের ভ??