কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায় ... বিশদ
হার্টের অসুখের প্রকারভেদ
সাধারণত হার্টের অসুখের কথা বললেই প্রথমে হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেলিওরের কথা মাথায় আসে। সমগ্র বিশ্বে যত প্রাণহানি হয়, তার বেশিরভাগই হয় হার্টজনিত সমস্যার কারণে। বা আরও পরিষ্কার করে বললে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের কারণে। এর অর্থ হার্ট ও মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালীর অসুখ। মূলত রক্তবাহী ধমনীতে কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য চর্বিজাতীয় পদার্থ জমে নালীর অন্দরের গায়ে একটা আস্তরণ তৈরি হয়। ফলে রক্তবাহী নালীপথ সংকীর্ণ ও শক্ত হয়ে যায়। সোজা কথায় কোলেস্টেরলের প্লাক জমে রাস্তাটি সরু হয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল হয় না। তার জন্য অক্সিজেন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান হার্টে পৌঁছতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। একে বলে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ।
দ্রুত গতিতে হাঁটলে বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করলে অনেকের বুক ধড়ফড় করে, নিঃশ্বাসের কষ্ট হয়। সঙ্গে বুকে সামান্য ব্যথা বা চাপ অনুভব করতে পারেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে যা আবার ঠিক হয়ে যায়। একে বলে ক্রনিক স্টেবল অ্যানজাইনা। আবার করোনারি আর্টারিতে হঠাৎ রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হার্টের মাংসপেশিতে রক্ত সরবরাহ ভীষণভাবে কমে যায় বা একদমই বন্ধ হয়ে যায়। হার্টের মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মাংসপেশি মরে যায়। এই সমস্যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন। চলতি কথায় আমরা বলি হার্ট অ্যাটাক।
তাহলে হার্ট ফেলিওর অসুখটি কী? সহজভাবে বোঝার জন্য বলা যায়— যখন কোনও ব্যক্তির হার্ট শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে রক্ত সরবরাহ করতে পারে না, তখন সেই অবস্থাকে হার্ট ফেলিওর বলে। সাধারণভাবে আমরা মনে করি হার্ট ফেল মানে মারা যাওয়া। কিন্তু ডাক্তারি পরিভাষায় হার্ট ফেলিওর মানেই মৃত্যু নয়। হার্ট ফেলিওরের ফলে ওই ব্যক্তি দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাঁর শ্বাসকষ্ট হতে পারে বা পা ফুলে যেতে পারে। যা ডেকে আনে মৃত্যু।
এ ছাড়াও রয়েছে জন্মগত হার্টের অসুখ, রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ, হার্টের ইনফেকশন, পালমোনারি এমবলিজম, পায়ের শিরার অসুখ প্রভৃতি।
শত্রুদের চিহ্নিতকরণ
যে কোনও অসুখের ক্ষেত্রেই কোন জিনিস সেই রোগের কারণ বা আমাদের শত্রু সেটা আগে চিনে নিতে হয়। তাহলেই প্রতিবিধানের পথ অনেকটা পরিষ্কার হয়। যেমন হার্টের রোগের ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি শত্রু হল কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস বা সুগার।
কোলেস্টেরল: রক্তের সঙ্গে প্রবহমান চর্বি বা মোম জাতীয় পদার্থকে আমরা কোলেস্টেরল বলি। প্রতিটি মানুষের শরীরেই এর উপস্থিতি আছে —তবে বিভিন্ন মাত্রায়। রক্তে এর পরিমাণ বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়। কোলেস্টেরল জমার ফলে কীভাবে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ে সেকথা আগেই বলেছি। তবে সব কোলেস্টেরল মানেই ক্ষতিকর নয়।
লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করলে আমাদের শরীরে এলডিএল, এইচডিএল, ট্রাইগ্লিসারাইড, টোটাল কোলেস্টেরলের মাত্রা জানা যায়। এলডিএল-এর পুরো নাম লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন। চলতি কথায় একে ব্যাড কোলেস্টেরল বা খারাপ কোলেস্টেরল বলা হয়। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে হৃদরোগ বা বিভিন্ন ধমনীর অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের (ধমনীতে কোলেস্টেরল জমার জন্য শক্ত ও সরু হয়ে যাওয়া) জন্য এর ভূমিকাই প্রধান। অন্যদিকে এইচডিএল বা হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনকে আমরা বলি গুড কোলেস্টেরল বা ভালো কোলেস্টেরল। কারণ এই কোলেস্টেরল ধমনীকে সুরক্ষিত রাখে। বিভিন্ন কোলেস্টেরলকে নির্দিষ্ট মাত্রায় না রাখতে পারলে বিপদ। তাহলে নির্দিষ্ট মাত্রা কী? সুস্থ স্বাভাবিক হার্টের জন্য সাধারণভাবে টোটাল কোলেস্টেরল রাখতে হবে ২০০-র নীচে। এলডিএল কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন মাত্রা (তাঁর টোটাল রিফ্র্যাক্টর অনুসারে)। ট্রাইগ্লিসারাইড ১৫০-র নীচে রাখতে পারলে ভালো হয়। অর্থাৎ চিকিৎসকই বিভিন্ন পরিস্থিতি দেখে ঠিক করবেন কার কতটা থাকা উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ: আমাদের শরীরে হার্ট হল একটি পাম্প। অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত পাঠায় হার্ট। ধমনীর মধ্যে দিয়ে যখন রক্ত চলাচল করে, তখন পার্শ্ব দেওয়ালগুলিতে চাপ সৃষ্টি হয়। একেই বলে ব্লাডপ্রেশার বা রক্তচাপ। রক্ত সঞ্চালনের সময় হার্ট যখন সঙ্কুচিত হয় তখন রক্তচাপ সর্বোচ্চ পরিমাণে যায়, তখন তাকে বলে সিস্টোলিক ব্লাডপ্রেশার। আর হার্ট যখন রক্ত গ্রহণ করার জন্য স্ফীত হয়, তখন যে নিম্নতম চাপ অনুভূত হয়, তাকে বলে ডায়াস্টোলিক ব্লাডপ্রেশার। বিভিন্ন পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে কোনও ব্যক্তির রক্তচাপের সঠিক মাত্রা নির্ণয় করা হয়। তার মানে এই নয় যে সবসময় এই চাপ থাকবে। যেমন পরিশ্রম করার সময় রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। সেইজন্য বিশ্রামরত অবস্থায় রক্তচাপ মাপা হয়। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে এই রক্তচাপ ১৩০ থেকে ১২০/ ৮০ থেকে ৭০-এর মধ্যে থাকলে ভালো। আদর্শ ব্লাডপ্রেশার কত হওয়া উচিত তাও চিকিৎসকই ঠিক করে দেবেন। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে উচ্চ রক্তচাপ কিন্তু নিঃশব্দ ঘাতক—অর্থাৎ রক্তচাপ না মাপলে এর পরিমাণ বোঝা যায় না। হার্ট, মস্তিষ্ক ছাড়াও এ নিঃশব্দে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন চোখ, কিডনির ক্ষতি করে। তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।
উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হার্টের চেম্বারে চাপ পড়ে। তার জন্য হার্টের ওজন বৃদ্ধি পায় এবং দেওয়াল মোটা হয়ে যায়। হার্ট ফেলিওরের সম্ভাবনা বাড়ে। ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ ও হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ে এবং অ্যাওর্টিক ভালভ, মহাধমনী, পায়ের শিরা প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুগার: এছাড়াও আর একটি অসুখ নিঃশব্দে হার্টের ক্ষতি করে চলে, তা হল, বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস। সুগার থাকলে অনেকসময় হার্ট অ্যাটাক হলেও রোগী বুঝতে পারেন না। শরীরের নার্ভ অসাড় হয়ে পড়ে। তাই বুকে ব্যথা হলেও অনেকসময় রোগী তা বুঝতে পারেন না বা আমল দেন না। ফলে আচমকাই একদিন বড়সড় বিপদ ঘনিয়ে আসে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের চোখ, হার্ট, কিডনির বাড়তি যত্ন নিতে হবে। প্রয়োজনীয় টেস্ট ও হার্ট চেকআপও করাতে হবে নিয়মিত।
হার্ট ভালো রাখতে তাহলে করণীয় কী?
মনে রাখতে হবে সুস্থ ও স্বাভাবিক হার্ট বজায় রাখতে হলে প্রথমেই জীবনযাত্রা প্রণালীর পরিবর্তন আবশ্যক—যথাযথ খ্যাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, তামাকজাতীয় পদার্থ পরিহার প্রভৃতি।
• সুষম খাদ্য: মাত্রাতিরিক্ত তেল-মশলা দেওয়া খাবার একদম বর্জন করতে হবে। জিহ্বায় লাগাম দরকার। খাদ্যতালিকা থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, চিপস, প্রিজারভেটিভ দেওয়া খাবার, মিষ্টি, রেড মিট ইত্যাদি। যে কোনও ব্যক্তির ওজন, দৈহিক পরিশ্রম, বয়সের উপর নির্ভর করে কতটা ক্যালরি গ্রহণ তিনি করতে পারবেন। খাদ্যে রাখতে হবে পরিমাণ মতো ভাত, ডাল, মাছ, ডিম বা চিকেন। সাধারণত রেড মিট খেতেই বারণ করা হয়। তবে মাত্রাতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিনও এড়িয়ে চলা উচিত। রোজের খাবারে শাকসব্জি রাখতে হবে। খেতে হবে মরশুমি ফল। পাতে অতিরিক্ত নুন খাওয়া কোনওমতেই চলবে না। রান্নাতেও কমাতে হবে নুনের ব্যবহার। (প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে দৈনিক পরিমাণ ৫ গ্রাম বা তার কম হতে হবে)। কমাতে হবে মিষ্টির ব্যবহারও।
• শরীরচর্চা: সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা দরকার। বয়স্ক লোকের ক্ষেত্রে দ্রুত হাঁটাই যথেষ্ট। কমবয়সিদের দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা চালু রাখতে হবে। শরীরচর্চা ওজন কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, উচ্চ রক্তচাপ কমায়। হার্ট স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। যাঁরা প্রথম ব্যায়াম বা হাঁটা শুরু করছেন, তাঁরা গোড়ায় অল্প করে শুরু করে ধীরে ধীরে সময় বাড়াবেন।
তবে ইতিমধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়ে থাকলে বা হার্টের অন্য কোনও অসুখ অথবা অন্য কোনও সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো হাঁটা বা এক্সারসাইজ করতে হবে।
আবার যাঁরা বয়স্ক বা আর্থ্রাইটিসের রোগী, বেশি হাঁটতে অসুবিধা হয়, তাঁরা নিজেদের উপযুক্ত ব্যায়াম কী হবে তা সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষকের থেকে জেনে নিয়ে শুরু করুন শরীরচর্চা।
• ডায়াবেটিস: সুগার থাকলে ডায়েট কন্ট্রোলের সঙ্গে এক্সারসাইজ মাস্ট। চিকিৎসকের পরামর্শমতো খেতে হবে ওষুধও। ব্যক্তিবিশেষে ডায়াবেটিসের ডায়েট চার্ট আলাদা।
• কোলেস্টেরল: রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে ডায়েট কন্ট্রোল ও ব্যায়ামের সঙ্গে ওষুধও খেতে হবে নিয়মিত।
• উচ্চ রক্তচাপ: হাই ব্লাডপ্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপের প্রথম চিকিৎসা হল সুস্থ জীবনযাত্রায় নিজেকে গড়ে তোলা। প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ওষুধ খেতে হবে। ওজন কমিয়ে ফেলতে পারলে ব্লাডপ্রেশার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
• কুঅভ্যেস: ধূমপান, মদ্যপানের অভ্যেস হার্টের রোগে ভোগার আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। তাই এই ধরনের বদভ্যাস অবশ্যই ছাড়তে হবে। অনেকের ধারণা পরিমিত মদ্যপান হৃদরোগের আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। আমি সেকথা একদমই বলব না। আমার সাফ কথা, এই ধরনের কোনও প্রমাণ আমাদের দেশে এখনও নেই। ফলে মদ্যপান না করাই ভালো। তবে যারা প্রচুর পরিমাণে মদ্যপানে আসক্ত, তাদের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এই প্রবণতা কমিয়ে আনতে হবে। ধূমপান ও তামাকজাতীয় পদার্থ (বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, পান মশলা, দোক্তা, গুটখা, গুড়াকু ইত্যাদি) একেবারে বর্জন করতে হবে। কোনওসময় শুরু না করলেই সবচেয়ে ভালো।
স্থূলকায়: দৈহিক উচ্চতা অনুয়ায়ী একজন মানুষের ওজন কত হওয়া উচিত, সেই চার্ট এখন ইন্টারনেটেও উপলব্ধ। এরমধ্যে একটি মাত্রাকে বলা হয় বিএমআই। এই বিএমআইকে নির্দিষ্ট মাত্রার নীচে রাখতে হবে। তাহলে শুধু হার্ট নয়, বিভিন্ন রোগের কবল থেকে রেহাই সম্ভব। এর জন্যও যথাযথ খাদ্যতালিকা মেনে চলা, ব্যায়াম করা প্রভৃতি জরুরি।
বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থায় আরও কিছু নতুন ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ চিহ্নিত করা হচ্ছে। সেই বিষয়গুলিরও নিয়ন্ত্রণ দরকার—
মানসিক চাপ: কর্মক্ষেত্র হোক বা বাড়ি, স্ট্রেস আমাদের নিত্যসঙ্গী। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপে ভুগলে অন্যান্য অসুখও দেহে বাসা বাঁধতে পারে। হতে পারে হার্টের অসুখও। তাই মানসিক উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। স্ট্রেস থেকে দূরে থাকুন। অবসর সময়ে যা করতে ভালো লাগে করুন। গল্পের বই পড়ুন, বাগান করুন, শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান, পরিবারকে সময় দিন। অর্থাৎ মন ভালো রাখুন। সেইসঙ্গে পর্যাপ্ত ঘুমও দরকার।
আক্রান্ত শৈশব: নজর দিতে হবে শিশুদের দিকেও। আগে বাচ্চারা মাঠে খেলাধুলা করত। এখন পড়ার চাপে হোক বা নানাবিধ কারণে তারা অনেক ক্ষেত্রেই সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। পরিবর্তে ঘরে বসে টিভি দেখে বা মোবাইলে ভিডিও গেমস খেলে সময় কাটায়। আমাদের সমাজে অন্য আর একটা দিকও আছে। অনেক শিশু বা কিশোর বাধ্য হয়ে শ্রমিকের কাজ করতে। তারা যথাযথ পুষ্টি তো পায়ই না, সঙ্গে বিড়ি সিগারেট খাওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়।
শরীরচর্চা না করার ফলে ওবেসিটিতে (স্থূলকায়তা) ভুগতে শুরু করে। ছোট থেকেই অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় রক্তবাহী নালীতে। তাই বাচ্চারা যাতে ঘাম ঝরিয়ে মাঠে খেলতে যেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে বললেই তো হল না। খেলার ফাঁকা মাঠ পাওয়াও ইদানীং মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক স্কুলেও খেলার মাঠ নেই। এদিকটাতেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
দূষণ: গত কয়েক বছর ধরে হার্টের অসুখের পিছনে বড় ধরনের রিস্ক ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে দূষণ। মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশ দূষণের ফলে ফুসফুসের সমস্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনই হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানির মতো সমস্যাও হার্টের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। ফলে যতটা সম্ভব দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
প্রতিরোধের উপায়
হার্ট ভালো রাখতে উপযুক্ত জীবনযাত্রা নির্বাহ ছাড়াও প্রধানত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে সুগার, প্রেশার আর কোলেস্টেরল। ডায়াবেটিস রোগীদের অন্তত ৩ মাস অন্তর এইচবিএ১সি (HbA1C) পরীক্ষা করতে হবে। মান রাখার চেষ্টা করতে হবে ৬.৫-এর (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) মধ্যে। নিয়মিত নজরে রাখতে হবে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা। বিশেষ করে সুগার বা প্রেশারের তারতম্য হলে রোগীর মাথা ঘোরে, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষদের। তাঁদের সেই সময় পড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। এই ধরনের অসুবিধা যাতে না হয়, সেই দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তার জন্য অনেকসময় আমাদের ২৪ ঘণ্টা রক্তচাপ মনিটরিং করতে হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে এবিপিএম। সেটাও আজকাল করা যায় বাড়িতেই। কোনও একটা সেন্টারে গিয়ে যন্ত্রটা লাগিয়ে রোগী দৈনন্দিন জীবনযাপনে ফিরে যাবেন। পরের দিন আবার সেন্টারে গিয়ে যন্ত্রটা খুলে দিয়ে আসতে হবে। আবার অনেক সংস্থা থেকে এখন বাড়িতে গিয়েও যন্ত্রটা লাগিয়ে দিয়ে আসে। তারপর যন্ত্রটা খুলে রেকর্ডিং কম্পিউটারে দেখে বিশ্লেষণ করতে হবে। চিকিৎসক রিপোর্ট দেখে ঠিক করবেন কোনও সময় খুব বেশি বাড়ছে কি না, বা খুব বেশি কমছে কি না। ওঠা-নামার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকছে কি না ইত্যাদি। এছাড়া অনেক রোগীকে বাড়িতে প্রেশার মনিটরিং করা শিখিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা যাতে দিনের বিভিন্ন সময় বিপি মনিটর করতে পারেন। সবকিছু খতিয়ে দেখে ওষুধের ডোজ চিকিৎসক ঠিক করে দেবেন।
তার মানে একটা বিষয় পরিষ্কার যে হার্টের অসুখের পিছনে অনেকগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করে। তাই একটার বদলে যদি আমরা সবগুলো রিস্ক ফ্যাক্টরকেই একযোগে আক্রমণ করি, তাহলে মূল অসুখটিকে পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সেগুলোকে রুখে দিতে পারলে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। আর যাঁদের একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে, তিনি যেন আবার একটি অ্যাটাকের সম্মুখে না পড়েন, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। (সেকেন্ডারি প্রিভেনশন)
কতদিন পরপর সুগার/ প্রেশার / কোলেস্টেরল মাপা প্রয়োজন
এটা রোগী বিশেষে নির্ভর করে। কারও যদি সুগার খুব বেশি ওঠা-নামা করে, পড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, হঠাৎ ব্লাড সুগার কমে বা বেড়ে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয় তাদের একরকম ভাবে চিকিৎসা করতে হবে। আর যাদের সুগারের খুব বেশি তারতম্য হয় না, মাঝে মাঝে দেখতে হয়, তাঁকে হয়তো চিকিৎসক তিন মাস অন্তর মাপার কথা বলবেন। কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রেও একই কথা। যাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, কোলেস্টেরল কমানো দরকার, তাঁর ক্ষেত্রে একরকম। আর যার প্রাইমারি প্রিভেনশনের দিকে নজর দিয়েছি তাঁদের ৬ মাসে একবার বা এক বছরে একবার দেখলেই হবে। প্রেশার মাপাও রোগীর প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে।
ধূমপায়ী মহিলার হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেশি?
শুধু ধূমপানের দিক দিয়ে তো ভাবলে হবে না, সব দিক বিবেচনা করেই মহিলাদের হার্টের রোগের আলোচনা করা দরকার। মহিলাদের মেন্সট্রুয়েশন যতদিন চলছে, ততদিন হার্টের রোগের সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু ডায়াবেটিস থাকলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা আবার বেড়ে যায়। যাদের তাড়াতাড়ি মেনোপজ হচ্ছে বা মেনোপজ হয়ে গেল, এই সময়টা কিন্তু পুরুষ-মহিলার একই রকম রিস্ক থাকে। মহিলাদের কিছু কিছু হার্টের অসুখ আলাদাভাবে হতে পারে। যেমন পেরিপার্টাম কার্ডিওমায়োপ্যাথি বলে একটা অসুখ আছে। প্রেগন্যান্সির শেষ দিকে বা বাচ্চা হওয়ার ঠিক পরে পরে দেখা গেল হার্ট ঠিকমতো পাম্প করতে পারছে না, ফেল করছে। এটা মহিলাদের একটা নিজস্ব অসুখ। এই ধরনের কিছু কিছু অসুখ আছে। কিন্তু মহিলাদের হার্ট অ্যাটাক হয় না বা কম হয়, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
ধূমপানের ক্ষেত্রে দুটো দিক দেখেছি। এক যাঁরা নিজেদের ওভারস্মার্ট ভাবেন বা সমাজে নিজেকে খুব স্মার্ট দেখাতে চান, সোসাইটি লেডি বা অল্পবয়সি স্কুল-কলেজের মেয়ে, তাঁরা যেমন ধূমপান করছেন। তেমনই আমাদের দেশে চিরন্তন আর একটা দিকও চলে আসছে। যাঁরা শ্রমজীবী মহিলা, তাঁরাও কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে বিড়ি সিগারেট খান। বাড়ির মহিলারাও অনেকেই দোক্তা বা জর্দা দিয়ে পান খান, গুড়াকু ব্যবহার করে দাঁত মাজেন। এদিকটাও লক্ষ রাখতে হবে।
সুগার, প্রেশার, কোলেস্টেরলের ওষুধ কি চিরদিন খেতে হবে?
আমাদের একটা ভুল ধারণা আছে যে সুগার, প্রেশার বা কোলেস্টেরলের ওষুধ একবার শুরু করলে আর বন্ধ করা যায় না। মাথায় রাখতে হবে যে অসুখটা তো আর সেরে যাচ্ছে না। সুগার হোক বা প্রেশার, এটাকে ওষুধ দিয়ে আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখছি। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ওষুধ ছাড়া কমে না। সেইজন্যই ওষুধটা চালিয়ে যাওয়া জরুরি। এমন নয় যে ওষুধ খেতে একবার শুরু করেছি বলেই খেয়ে যেতে হচ্ছে। ওষুধটা না চালালে কন্ট্রোলে থাকে না বলে চালিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ ওষুধ শুরু করলে আর বন্ধ করতে পারব না, এই ভেবে আমি বসে থাকলাম, সেটা করলে হবে না।
সবশেষে বলি, হৃদরোগ কবে হবে বা কখন তার চিকিৎসা করাবেন তার জন্য বসে না থেকে অল্প বয়স থেকেই সতর্ক হতে হবে। প্রতিবিধানের থেকে প্রতিরোধ অনেক ভালো। তাই প্রথম থেকেই এব্যাপারে সচেতন হয়ে পদক্ষেপ নিলে সুস্থ থাকবেন।