নীরব কেন? নাম কর্! এই রাম নাম—এই কৃষ্ণ নাম—মধুর হতেও মধুর, একথা কি জন্য বলছি জানিস্? দেখ্, মধুর কোন দ্রব্য জিহ্বায় রাখলে তার মাধুর্য্য অল্পক্ষণ থাকে, কিছুক্ষণ পরে আর জিহ্বাতে স্বাদ থাকে না; কিন্তু এই যে নাম—প্রথম বৈখরীতে জিহ্বায় রাখ, জিহ্বায় জপ করতে করতে এর মধুরত্ব শতগুণ বৃদ্ধি পাবে, জিহ্বা কৃতার্থ হবে, কণ্ঠ ধন্য হবে। পরে মধুর হতে মধুর হয়ে এই নামই মধ্যমায় উচ্চারিত হতে থাকবে। হৃদয় হতে নামের ধ্বনি সহস্রারে উঠে সহস্রার প্রতিধ্বনি করবে। এই সুষুম্নাজপে সুপ্তা ভূজঙ্গী জেগে উঠবে। শ্বাসে শ্বাসে শরীর শিহরিত ও স্পন্দিত হতে থাকবে। দেহাভিমান বিগলিত হবে। সেই সহস্রারে শত শত জন্মের স্মৃতি অঙ্কিত আছে। তোর বর্ত্তমান দেহাভিমান জন্মান্তরের দ্বার রুদ্ধ করে রেখেছে। সুষুম্নার জপে সে দ্বার মুক্ত হবে, সে যবনিকা অপসৃত হবে। “অপরিগ্রহস্থৈর্য্যে জন্মকথন্তা সংবোধঃ”—পাতঞ্জল সাধনপাদ। এই সুষুম্নার জপে আত্মা যখন উদ্বুদ্ধ হয়ে শরীর পরিগ্রহ ত্যাগ করবে অর্থাৎ দেহাভিমানশুন্য হবে, তৎক্ষণাৎ জন্মান্তরে ‘কোহহমাসং, কিং কার্য্যমকারী’—আমি কে ছিলাম, কি করেছিলাম,—এই সব স্মরণ হতে থাকবে; সেই সময় নামেতে শতগুণ অনুরাগ হবে। স্ত্রী, পুত্র, বিষয়, বৈভবে বৈরাগ্য আসবে। তারপর নাম আরও মধুর হয়ে ‘পশ্যন্তী’তে উপস্থিত হবে, অর্থাৎ নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নামীর রূপদর্শনলাভ ঘটবে। প্রথম স্থূল রূপ, তারপর জ্যোতিঃ, তারপর বিন্দু, তারপর নাদরূপে নাম সেই অনন্ত প্রেম পারাবারের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। নামে ডুবলে পরা অবস্থা লাভ অনিবার্য্য। কি আনন্দের সংবাদ। আমি জিহ্বায় “রাম রাম” উচ্চারণ করলেই পড়া অবস্থা লাভ করতে পারব—কি আনন্দ সংবাদ! রাম রাম! যাই যাই দুঃখব্যাকুল নরনারীকে সংবাদ দিয়ে আসি। সেই জন্যই তো তোকে নাম করতে বল্ছি। মধুর হতেও মধুর কেন বললাম—বুঝেছিস্ তো? আবার শোন্, এ নাম মঙ্গলের মঙ্গল। মঙ্গলজনক কার্য্য—যজ্ঞ, দান, তপস্যা, ব্রত হোম ইত্যাদি। এই সমস্ত কার্য্যের দ্বারা জীব স্বর্গলোক পর্য্যন্ত যেতে পারে। তারপর “ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্ত্যলোকং বিশন্তি”—পুণ্যক্ষয়ে মর্ত্ত্যলোকে এসে কর্ম্মানুযায়ী গতি লাভ করে; অবিরত যাতায়াত করতে থাকে। কিন্তু এই নাম করলে জীব মোক্ষলাভ সমর্থ হয়, তাকে আর নানারূপে নানা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না।
কলের্দোষনিধে রাজন্নস্তি হ্যেকো মহান্ গুণঃ।
কীর্ত্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তবন্ধঃ পরং ব্রজেৎ।।
দোষের আকর এই কলিযুগের একটি মহান্ গুণ যে নাম কীর্ত্তনের দ্বারা জীব বন্ধনশূন্য হয়ে পরমধাম প্রাপ্ত হয়। তাই তোকে বললাম—নাম মঙ্গলের মঙ্গল। এই নাম সমস্ত বেদলতার ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান ত্রিকালস্থায়ী, নিত্য চৈতন্যময় ফল। এ নাম জড়, এ নামের স্বরূপই চৈতন্য। তুই জড় দেহটার সঙ্গ করে জড় হয়ে গেছিস, এইবার এই চৈতন্যময় নামের সঙ্গ সদা সর্ব্বদা করে এই ভূতের বোঝার কথা ভুলে গিয়ে তুইও চৈতন্যময় হ, তোর স্বরূপ তুই লাভ কর্। আমার কথায় যদি তোর নামেতে শ্রদ্ধার উদয় না হয়ে থাকে তাহলেও তুই হেলা করেও নাম কর্, আমি তোকে উদ্ধার করব। তুই কি শুনিস্ নাই?
‘শ্রী ওঙ্কারনাথ-রচনাবলী’ (৩য় খণ্ড) থেকে