বৈদিক ও তান্ত্রিক দ্বিবিধ চিন্তাপ্রবাহের কথা প্রারম্ভেই বলিয়াছি। এই দুইটি ধারার মিলনসূত্র হইল দেবীসূক্ত। শ্রীচণ্ডী পাঠের প্রথমেই দেবীসূক্ত পাঠের বিধি। এই সূক্তটি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৫ সংখ্যক সূক্ত। সুরথ রাজাও সমাধি বৈশ্য এই সূক্তটি জপ করিয়া মহাশক্তির আরাধনা করিয়াছিলেন। ‘‘স চ বৈশ্যস্তপস্তেপে দেবীসূক্তং পরং জপন্।’’ এই বৈদিক সূক্তটির জপদ্বারা তন্ত্র-প্রতিপাদ্য মহাশক্তির অর্চ্চনা ও সাক্ষাৎকার হইল। এই জন্য এই সূক্ত, দুইটি ধারার মিলনসূত্র বলা হইয়াছে। বৈদিকমন্ত্র ত্রিবিধ—পরোক্ষকৃত, প্রত্যক্ষকৃত ও আধ্যাত্মিক। দেবীসূক্তের মন্ত্রগুলি আধ্যাত্মিক। ঋষি এখানে নিজেই নিজের স্তুতি করিতেছেন। দ্রষ্টা ঋষি হইলেন অম্ভৃণ-কন্যা ব্রহ্মা-বিদূষী বাক্। দেবতা সচ্চিদানন্দ পরমাত্মা। ঋষির নামানুসারে এই সূক্তটিকে বাক্সূক্তও বলা হয়। আত্মস্তুতি বলিয়া সূক্তটি আধ্যাত্মিক। এই মন্ত্রের অর্থবোধ হইলে অনুভব হইবে যে, তন্ত্রশাস্ত্রে যে মহাশক্তির কথা বলা হইয়াছে, তিনি স্বয়ং ঋষিকন্যাকে যন্ত্ররূপে গ্রহণ করিয়া তাঁহার মাধ্যমে স্বকীয় পরমস্বরূপ পরিব্যক্ত করিয়াছেন। দেবী মাহাত্ম্য চণ্ডীগ্রন্থে প্রবেশ করিবার জন্য এই সূক্ত তোরণস্বরূপ। যে সকল তত্ত্ব চণ্ডীগ্রন্থে পরিদৃষ্ট হয় তৎসমুদয় বীজাকারে এই দেবীসূক্তে বিরাজমান। বেদভাষ্যকার সায়ণাচার্য্য বলেন যে, এই দেবীসূক্তে বাগ্দেবী নিজে পরমাত্মার সহিত একাত্মতা অনুভব করিয়াছেন এবং সেই পরমাত্মার (নিজেরই) স্তুতি করিয়াছেন। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে যে, বেদ প্রতিপাদ্য পরমাত্মার স্তুতিতে তন্ত্র-প্রতিপাদ্য পরাশক্তি স্তুত হইয়াছেন। সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে, পরমাত্মা ও পরাশক্তি অভিন্নবস্তু। দুইটি দৃষ্টিভক্তি দ্বারা যে একই মহাসত্যের পরিচয়, ইহা দেবীসূক্ত প্রতিপন্ন করিতেছে। দেবীসূক্তে আটটি মন্ত্র আছে। প্রথম মন্ত্রটি এই—
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহ—
মাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা ত্রিভর্মহ
মিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।।
আমি রুদ্র ও বসুরূপে বিচরণ করি। আমি আদিত্য ও বিশ্বদেব রূপে বিচরণ করি। আমি মিত্রাবরুণ (মিত্র ও বরুণ), ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে ধারণ করি। ওই মন্ত্রে রুদ্র ও বসু, আদিত্য ও বিশ্বদেব, মিত্রাবরুণ, ইন্দ্র ও অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারযুগল, এই অষ্ট বৈদিক দেবতার কথা বলা আছে। রুদ্র একাত্মাভিমুখী শক্তি—বসু বহুত্বাভিমুখী শক্তি।
মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর ‘চণ্ডী চিন্তা’ থেকে