নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি: ভোরের আলো ফুটতে তখনও খানিক দেরি। ডাউনে বেলাইন হয়ে পড়ে আছে মালগাড়ি। আপ লাইনে ছিটকে গিয়েছে তার একটি বগি। সেদিকে ধেয়ে আসছে হাওড়া-মুম্বই মেল। রেলের কাছে খবর পৌঁছয়নি। সিগন্যাল গ্রিন। মাত্র ৬ মিনিটের মধ্যেই সজোরে এসে মুম্বই মেল ধাক্কা মারল দুর্ঘটনাগ্রস্ত মালগাড়ির বগিতে। আর সেই ধাক্কায় সঙ্গে সঙ্গে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ল ইঞ্জিন। খেলনাগাড়ির মতো ছিটকে গেল মুম্বই মেলের ১৮টি কামরা। একটি এসি কামরা উল্টে এসে পড়ল অন্যটির উপর। ঠিক যেন এক বছর আগের বাহানাগা কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি। বালেশ্বরে করমণ্ডল এক্সপ্রেস, জলপাইগুড়িতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, গোন্ডায় ডিব্রুগড় এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার স্মৃতি এখনও ফিকে হয়নি। সেই তালিকায় এবার জুড়ল হাওড়া-মুম্বই মেলের নাম। মঙ্গলবার ভোর পৌনে চারটে নাগাদ ঝাড়খণ্ডের চক্রধরপুরের কাছে এই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে দু’জনের। তাঁরা রাউরকেল্লার বাসিন্দা। আহত অন্তত ২২ জন। তাঁরা চক্রধরপুরে চিকিৎসাধীন।
নরেন্দ্র মোদি জমানায় রেল দুর্ঘটনা প্রায় বিভীষিকার আকার নিয়েছে। এই নিয়ে গত দেড় মাসে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে অন্তত ৯টি ট্রেন। এর মধ্যে তিনটি বড় ঘটনা। মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে রেলমন্ত্রক। হাওড়া-মুম্বই মেলের দুর্ঘটনার নেপথ্যেও রেলের গাফিলতির দিকে আঙুল উঠেছে। এদিন রেল বোর্ডের চেয়ারপার্সন জয়া ভার্মা সিনহাকে সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালে বদলি করা হয়েছে। লাগাতার ট্রেন দুর্ঘটনার জেরেই এই সিদ্ধান্ত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। রেলের অবশ্য দাবি, এটি রুটিন বদলি। যাত্রী সুরক্ষায় রেলের উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক্স হ্যান্ডলে মৃতদের পরিবারের প্রতি সমাবেদনা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আরও একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা। আমি প্রশ্ন করতে চাই, এটাই কি সরকার চালানোর নমুনা? প্রতি সপ্তাহে দুঃস্বপ্নের এই ধারাবাহিকতা, রেললাইনে এই মৃত্যুমিছিল—আর কত দিন আমাদের সহ্য করতে হবে? কেন্দ্রের অকর্মণ্যতার কি কোনও শেষ নেই?’ এক্স হ্যান্ডলে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে একহাত নিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশও। তাঁর সাফ কথা, ব্যর্থ রেলমন্ত্রীর জনসংযোগ মেশিন কিন্তু চলছে।
বালেশ্বরের বাহানাগায় দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির পিছনে তীব্র গতিতে ছুটে এসে ধাক্কা মেরেছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। মঙ্গলবার অবশ্য মালগাড়িটিই আগে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। জানা যাচ্ছে, ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ ঝাড়খণ্ডের বড়াবাম্বু স্টেশন ছেড়ে আসে সেটি। প্রায় ন’মিনিট পর, ৩টে ৩৯ মিনিটে পশ্চিম সিংভূম এবং সরাইকেল্লা-খারসওয়ান জেলার সীমানায় বেলাইন হয় মালগাড়িটি। একটি বগি ছিটকে চলে আসে পাশের আপ লাইনে। সেই সময় ওই আপ লাইন দিয়ে ধেয়ে আসে হাওড়া থেকে মুম্বইগামী ট্রেনটি। যে ১৮টি কামরা বেলাইন হয়েছে, তার মধ্যে ১৬টিই যাত্রীবাহী। বাকি দু’টির মধ্যে একটি ট্রেনের বিদ্যুৎ সংযোগের কামরা এবং অন্যটি প্যান্ট্রি কার। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে রেলের উদ্ধারকারী দল। হাত লাগান স্থানীয়রা। ঘটনাস্থলে যান সিংভূম পশ্চিমের ডিসি কুলদীপ চৌধুরীও। দুপুরের মধ্যে শেষ হয় উদ্ধার কাজ। বেলা সওয়া ১২টা নাগাদ মুম্বই মেলের আটকে পড়া যাত্রীদের চক্রধরপুর থেকে বিকল্প ট্রেনে গন্তব্যে পাঠানো হয়।
মৃতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করেছে দক্ষিণ-পূর্ব রেল। আহত আটজনকে এক লক্ষ টাকা করে দেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে। ঝাড়খণ্ড সরকারের তরফে মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা, আহতদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন।