নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি: একজন প্রচার ভালোবাসেন। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব বা বিভাজনের আঁচে আম আদমি জেরবার হলেও তাঁর ফর্মুলা একটাই, ‘যো দিখতা হ্যায়...’। আর একজন বাস্তবেই লো প্রোফাইল। তিনি ভারতের অর্থনীতিকে দিশা দেখান, সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করেন, আর্থিক মন্দার ঝাপ্টা থেকে দেশকে বাঁচান। কিন্তু তারপরও থেকে যান প্রচারের আড়ালে। প্রথমজন নরেন্দ্র মোদি, এবং দ্বিতীয় মনমোহন সিং। দু’জনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী। একজন অধুনা, আর একজন তাঁরই পূর্বসূরি। তাঁদের এই জমিন-আসমান ফারাক আচমকাই বিশ্বজুড়ে চর্চার কেন্দ্রে। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতির অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, জার্মানির প্রাক্তন চ্যান্সেলার অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জনসমক্ষে নিয়ে এসেছেন এই পার্থক্য। অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করেছেন ‘ফ্রিডম: মেময়ার্স ১৯৫১-২০২১’ বইতে। সেখানেই তিনি লিখেছেন রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদিকে সামনে থেকে দেখার কথা। ভারতের অধুনা প্রধানমন্ত্রীর জন্য তাঁর বিশেষণ, ‘প্রচারসর্বস্ব’। আর মনমোহন সিং?—‘দূরদর্শী। উন্নয়নশীল দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, ওঁর থেকে শিখতে হয়।’
তৃতীয় ইনিংস শুরু করেছেন নরেন্দ্র মোদি। বিশ্বজুড়ে বহু রাষ্ট্রনেতার সংস্পর্শে এসেছেন। কেউ এখনও পুরোদস্তুর রাজনীতিতে থেকে গিয়েছেন। কেউ আবার অস্তাচলে। অ্যাঞ্জেলা মার্কেল কিন্তু জার্মানির সবথেকে ক্ষমতাশালী পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পরও আলোচনার বাইরে চলে যাননি। সেই মার্কেলই যখন লেখেন, ‘ভিজ্যুয়াল এফেক্ট বড্ড ভালোবাসেন মোদি’... নড়েচড়ে বসতে হয় বইকি। আপামর ভারতবাসীর তখন মনে পড়ে যায় নরেন্দ্র মোদির নানাবিধ দাবি। কীভাবে তিনি নিজেকে ‘ঈশ্বরের দূত’ বলে অভিহিত করেছেন, সরকারের পরিষেবাকে বদলে দিয়েছেন ‘মোদির গ্যারান্টি’তে। আবার কেদারনাথের গুহায় ধ্যানে বসার সময় ‘ছাড়’ দিয়েছেন ক্যামেরাকে। তাই মার্কেলের বয়ান দেশবাসীর কাছে নতুন না হলেও আকর্ষক বটেই। মার্কেল লিখেছেন, ‘২০২১ সালে বৈঠকের সময় মোদি নিজের ভোটপ্রচারের বেশ কিছু ছবি, আর ভিডিও দেখিয়েছিলেন আমাকে। বলেছিলেন, এই দেখুন, আমার ভাষণ সর্বত্র জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে।’ একইসঙ্গে তিনি টেনে এনেছেন ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর প্রথম বৈঠকের প্রসঙ্গও। অ্যাঞ্জেলা লিখেছেন, ‘মোদি নিজেই আমাকে বলেছিলেন, ২০১৪ সালে ভোটপ্রচারের সময় তিনি হলোগ্রাম প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিলেন। ভাষণ দিয়েছিলেন স্টুডিওতেই বসে। কিন্তু দেখা গিয়েছিল, আলাদা আলাদা ৫০টিরও বেশি জায়গায় ভাষণ দিচ্ছেন মোদি! সেটা কিন্তু ওই সব এলাকার ভোটারদের উপর প্রভাব ফেলেছিল।’ তবে ব্যক্তি মোদিতেই শেষ নয়, মার্কেল ভারতে সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রসঙ্গও তুলেছেন বইতে। সাফ লিখেছেন, ‘মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারতে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উপর নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছে, সেটাও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমি জানিয়েছিলাম। কিন্তু মোদি তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভারত আগের মতোই ধর্মীয় সহিষ্ণুতার দেশ রয়েছে। পাল্টা তখন আমি বলি, তথ্য তো সে কথা বলছে না!’ তাহলে কি মনমোহন জমানা অনেক ভালো? সরাসরি সে কথা না বললেও মনমোহন সিংয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। ভারতের উদার অর্থনীতির জনক, আরটিআই ও ১০০ দিনের কাজের মতো একের পর এক সামাজিক প্রকল্প, আধার... সংস্কারক মনমোহন সিংকে প্রাক্তন জার্মান চ্যান্সেলার ব্যাখ্যা করেছেন ‘আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ’ বলে। লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, ৮০ কোটি গ্রামীণ ভারতীয়ের জীবনযাত্রার উন্নয়ন। ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝি, উন্নয়নশীল দেশ সম্পর্কে আমরা কতটা ভুল জানি। এই দেশগুলির প্রতি পশ্চিমি দুনিয়ার কর্তব্য ঠিক কী হওয়া উচিত, সেটা উনিই শিখিয়েছেন আমাকে। মনমোহন সিংয়ের থেকে পাওয়া শিক্ষাতেই আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা বদলেছে। মনমোহনের থেকেই বুঝেছি ভারতের ৫ হাজার বছর প্রাচীন ইতিহাসের গুরুত্ব।’ কিন্তু প্রচার? সেটা মনমোহন সিংয়ের ছিল না। কাজ করেছেন, মার্কেটিং নয়।