অর্থকড়ি প্রাপ্তির যোগটি বিশেষ শুভ। কর্ম সাফল্য ও চিন্তার অবসান। দেবারাধনায় মন। ... বিশদ
অ্যালিসা কার্সন। কোড নেম ব্লুবেরি। ছোটবেলা থেকেই আর পাঁচজনের মতো দু’চোখ জুড়ে মঙ্গলে যাওয়ার স্বপ্ন বুনতো আমেরিকার লুইজিয়ানা প্রদেশের বাসিন্দা এই কিশোরী। মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবাকে সেই ‘দুঃস্বপ্নে’র কথা জানিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটি। বলেছিল, ‘বাবা আমি বড় হয়ে মহাকাশচারী হব এবং মঙ্গল গ্রহ অভিযানে যাব।’ এখন তার বয়স ১৭ বছর। ছোটবেলার স্বপ্নকে বড় হয়ে হারিয়ে ফেলেনি অ্যালিসা। বরং সেই স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দেওয়ার সুযোগ এসে গিয়েছে তার সামনে। বর্তমানে নাসার অধীনে মঙ্গল অভিযানের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন সে। তবে, নাসার মুখপাত্র বিষয়টি স্বীকার করেননি। কারণ আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর না হলে আনুষ্ঠানিকভাবে নাসার মহাকাশচারী হতে পারবে না অ্যালিসা। এখনও পর্যন্ত কোনও মহিলা মহাকাশচারীকে চাঁদে পাঠানো হয়নি। সেদিক থেকে মঙ্গলে প্রথম অভিযানেই কোনও মহিলাকে পাঠানো হলে তা ইতিহাস সৃষ্টি করবে। ১৯৬২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার মহাকাশে মহিলা মহাকাশচারী পাঠানোর চিন্তাভাবনা করেছিলেন সোভিয়েত প্রযুক্তিবিদ সের্গেই করোলভ। ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন প্রথম মহিলা নভশ্চর হিসেবে মহাকাশে যান সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের মোট ৫৯জন মহিলা মহাকাশে গিয়েছেন।
২০৩৩ সালে মঙ্গল গ্রহে প্রথমবার মানুষ পাঠাতে চলেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। সেই অভিযানে একজন মহাকাশচারী হিসেবে জায়গা পেতে চলেছে অ্যালিসা। তখন তার বয়স হবে ৩২। চেষ্টা করা হচ্ছে আগামী দু’বছরের মধ্যেই তাকে মহাকাশে পাঠানোর। যাতে সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে মহাশূন্যে যাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করতে পারে সে। তবে, এই স্বপ্নের জন্য ব্যক্তিজীবনে চড়া মূল্যও চোকাতে হবে তাকে। মঙ্গল যাত্রার আগে বিয়ে করতে পারবেন না অ্যালিসা। পারবেন না মা হতেও।
এই কম বয়সে অনেক কৃতিত্বই রয়েছে অ্যালিসার ঝুলিতে। ২০০৮ সালে বাবা ব্রেথ কার্সনের মাধ্যমে নাসায় যোগ দেয় সে। সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে আমেরিকার অ্যাডভান্সড স্পেস অ্যাকাডেমির ডিগ্রি অর্জন করা হয়ে গিয়েছে অ্যালিসার। নাসার তিনটি স্পেস ক্যাম্পে অংশ নেওয়া একমাত্র ব্যক্তি ১৭ বছরের এই কিশোরী। এছাড়া নাসার সব ভিজিটার সেন্টার পরিদর্শন করা বা পাসপোর্ট প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ করা বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তিও অ্যালিসাই। এই বয়সের আর পাঁচটা ছেলে-মেয়ে যখন স্কুলের পড়াই শেষ করে উঠতে পারে না, তখন ১৭ বছরের এই কিশোরী কিন্তু তাল মিলিয়ে নিয়মিত স্কুলের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ইংরেজি, চীনা, ফরাসি এবং স্প্যানিস — এই চারটি ভাষায় স্কুলের সব বিষয়গুলি নিয়ে পড়াশোনা করছে সে। পড়াশোনা ও নাসার প্রশিক্ষণের ফাঁকে আম-পড়ুয়াদের উত্সাহমূলক বক্তৃতা দিতেও বহু জায়গায় আমন্ত্রণ পেয়েছে অ্যালিসা। কীভাবে এত অল্প সময়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে সে? তার সাফল্যের মূল মন্ত্রই বা কী? অনুষ্ঠানগুলিতে হামেশাই এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। সেইমতো জবাবটাও মুখস্থ হয়ে গিয়েছে অ্যালিসার। ‘নিজের স্বপ্নকে চোখের আড়াল করবে না। স্বপ্নের পিছনে নিত্য ধাওয়া করো এবং কখনওই কাউকে তোমার স্বপ্ন ছিনিয়ে নিতে দিও না’, বলেছে মার্কিন এই ‘বিস্ময় বালিকা’।
২০১৩ সাল থেকে মঙ্গল গ্রহের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু করেছে নাসা। মোট আট জন মহাকাশচারীকে মঙ্গল যাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে চার জনই মহিলা। যা মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে প্রথম। তাঁদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এইট বলস’। আবার বিভিন্ন মহলে এটাও শোনা যাচ্ছে, মঙ্গল অভিযানে শুধু মহিলাদের পাঠানোর চিন্তাভাবনা করছে নাসা। কিন্তু কেন? প্রথমত, মঙ্গল গ্রহে প্রায় দেড় থেকে দু’বছর থাকার কথা রয়েছে মহাকাশচারীদের। পুরুষ এবং মহিলা মহাকাশচারীরা এতদিন আইসোলেশনে (গোটা গ্রহে একা) থাকলে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন নাসার মনস্তত্ত্ববিদরা। সব ক্রু (সদস্য) মহিলা হলে তা হবে না। তবে দ্বিতীয় কারণটিকেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা হল, মক মার্স মিশনে অংশগ্রহণকারী কেট গ্রিনের গবেষণা। কেট দেখেন যে সারা দিন সব সক্রিয়তার পরেও পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের অর্ধেক ক্যালোরি খরচ হচ্ছে। এমনকী, মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা এও বলছে যে আইসোলেশনের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন মহিলারা। তাঁদের হৃদযন্ত্র বেশি শক্তিশালী হয়, যা মহাকাশযাত্রার ধকল নেওয়ার পক্ষে উপযুক্ত।
নাসার এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মঙ্গলগ্রহে মানব বসতি স্থাপন। একবার মঙ্গল গ্রহে গেলে পৃথিবীতে ফেরার সম্ভাবনা যে অত্যন্ত কম, সেটা ভালো করেই জানে অ্যালিসা। এ ব্যাপারে পরিবারকেও পাশে পেয়েছে সে। বাবা ব্রেথ কার্সন বলেন, ‘আমি মনে করি অ্যালিসা অবশ্যই মঙ্গল গ্রহে যাবে। এর জন্য সে যে কঠোর পরিশ্রম করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।’ অ্যালিসার উপর আস্থা রাখছেন নাসার কর্মকর্তা পল ফোরম্যান। তিনি জানিয়েছেন, অ্যালিসার মতো একজন নাসার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটাই মহাকাশচারী হওয়ার উপযুক্ত বয়স। আগামীদিনে মহাকাশচারী হওয়ার জন্য সঠিক প্রশিক্ষণও নিচ্ছে সে।’ তবে এত কিছুর মধ্যেও ছুটির দিনগুলো অন্যান্য কিশোরীদের মতোই পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলে বা পিয়ানো বাজিয়ে কাটে অ্যালিসার। মহাকাশচারী হয়ে মঙ্গল গ্রহে যাওয়াটাই তার কাছে প্রথম পছন্দ। তবে ফিরে এসে একজন শিক্ষক বা দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চান তিনি।
সর্বপ্রথম রাশিয়াই একজন মহিলাকে মহাকাশে পাঠিয়েছিল। ৪০ বছর আগে প্রথম একজন মহিলাকে মহাকাশ অভিযানে পাঠায় নাসা। ইরানের আনুশেহ আনসারি, জাপানের চিয়াকি মুকাই, ভারতের কল্পনা চাওলা, সুনীতা উইলিয়ামস, কানাডার রবার্টা বন্ডার, কোরিয়ার লিও ইয়াং চুক, ফ্রান্সের হেউগনেরে ক্লডি, আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারী ডঃ মে জেমিসন, চীনের ওয়াং ইয়াপিং...কত নাম। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও নারী চাঁদে যাননি। মহিলারা একদিন না একদিন চাঁদে যেতে পারবেন বলে আশাবাদী ছ’মাসেরও বেশি সময় মহাকাশে কাটানো নাসার মহিলা নভোশ্চর ক্যারেন নেইবার্গ। তবে বিষয়টি এখনও অনেকটাই দেরি আছে বলে মনে করেন তিনি। মহিলা মহাকাশচারীদের অবস্থাটা কোথায় দাঁড়িয়ে, একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। এবছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আশেপাশে ইতিহাসে প্রথমবার মহাকাশে পদচারণার কথা ছিল আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে থাকা মহিলা নভোশ্চরদের। নাসার মহাকাশচারী তথা ‘এইট বলস’-এর সদস্য অ্যান ম্যাকক্লেইন এবং ক্রিস্টিনা কোচের সেই স্পেস ওয়াকে যাওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু চার দিন আগে নাসা জানায় যে সঠিক মাপের স্পেসস্যুট না থাকার কারণেই সেই স্পেস ওয়াক বাতিল করা হল। আসলে মিডিয়াম-লার্জ-এক্সট্রা লার্জ এই তিন রকম মাপের স্পেসস্যুট আইএসএসে রাখা রয়েছে। যেগুলি মহাকাশচারীদের মাপে বানানো নয়। যে কেউ যাতে পরতে পারেন সেই কারণেই এই ব্যবস্থা। সেই স্যুট ম্যাকক্লেইনের গায়ে ফিট হয়নি। নতুন স্যুট তৈরি করাও সম্ভব হয়নি। এই প্রসঙ্গে এ কথাও বলে রাখা দরকার যে এখনও পর্যন্ত হওয়া ২১৪টা স্পেসওয়াকে মাত্র চারবার মহিলা মহাকাশচারীরা পুরুষদের সঙ্গে অভিযানে পা মিলিয়েছেন।
অন্যদিকে, অ্যালিসন ম্যাকলিনটায়ার নামে নাসার এক বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, এতদিন পর্যন্ত যতজন চাঁদে গিয়েছেন তাদের ১২জনই ছিলেন পুরুষ। তাই মঙ্গলে প্রথম পা রাখা উচিত একজন মহিলারই। চলতি বছর মহাকাশে প্রথম নারীর পদার্পণের ৫৬ বছর পূর্তি। এই বছরেই ১৮ বছর বয়সে পা দেবে অ্যালিসা। নাসার মহাকাশচারী হিসেবে এই বছরেই স্বীকৃতি পেতে পারে সে। পৌঁছে যেতে পারে নিজের স্বপ্নের আরও কাছাকাছি। অ্যালিসার জন্য রইল শুভেচ্ছা।
মহাকাশে মহিলারা
• ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন। প্রথম মহিলা হিসেবে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষক পরিবারের সন্তান ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা। মহাকাশযানের নাম ছিল ভস্তক-৬।
• ১৯৮৩ সালে স্যালি রাইড হলেন প্রথম আমেরিকান মহিলা যিনি মহাকাশে যান।
• ১৯৯৭ সালে নাসার মহাকাশযান ‘কলম্বিয়া’য় করে মহাকাশে পাড়ি দেন হরিয়ানার মেয়ে কল্পনা চাওলা। তিনি হলেন মহাকাশে যাওয়া দ্বিতীয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ২০০৩ সালে আবার মহাকাশে যান কল্পনা।
• ২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর। নাসার মহাকাশযান ডিসকভারিতে চড়ে মহাশূন্যে যান সংস্থার বিজ্ঞানী তথা ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনীতা উইলিয়ামস। সবচেয়ে বেশি সময় মহাকাশে কাটিয়ে রেকর্ড করেন তিনি। ২০০৭ সালের ২২ জুন তিনি পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
• ২০১৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথম রাশিয়ান মহিলা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে যান ইয়েলেনা সেরোভা।