তথাগত রায় ও দিলীপ ঘোষ দু’জনই আরএসএস ঘরানার মানুষ। দু’জনই বঙ্গ বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি। কিন্তু, সম্পর্কটা মোটেই মধুর নয়, অহি-নকুলের। অনুপম হাজরা আবার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের খুঁটি ছাড়াই বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক। তাঁদের অবস্থান কখনওই সরলরেখায় ছিল না। বরং তিনজনের অবস্থান ত্রিভুজের তিন বিন্দুতে। তবে, তাঁদের মধ্যে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন, তাঁরা সকলেই একটি বিষয়ে একমত, বঙ্গ বিজেপি ব্যর্থ। আর সেটা বলাতেই বঙ্গ বিজেপিতে শুরু হয়ে গিয়েছে মুষল পর্ব। তাদের খেয়োখেয়ি কলতলার ঝগড়াকেও হার মানাচ্ছে।
এই মুহূর্তে বাংলায় বিজেপির দ্বন্দ্বের কথা বলার জন্য গোপন বা দলীয় সূত্রের দরকার নেই। কাদা ছোড়াছুড়ি এখন প্রকাশ্যে। তাতে একে একে শামিল হচ্ছেন বঙ্গ বিজেপির রথী মহারথীরা। কখনও নাম উহ্য রেখে, কখনও নাম করেই নিক্ষেপিত হচ্ছে বাক্যবাণ। বিজেপির রাজ্য সভাপতি তা উপেক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু মুখে বলা যতটা সহজ, করা যে ততটাই কঠিন! তাই সুকান্তবাবুও উপেক্ষা করতে পারছেন না। জবাব দিচ্ছেন। কারণ কেন্দ্রীয় সম্পাদক এমন কিছু প্রশ্ন তুলছেন যেগুলি সাধারণ বিজেপি কর্মীদের মনের কথা। তাই তাকে খণ্ডন না করে উপায়ও থাকছে না। তবে, সুকান্তবাবু অনুগামীদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, দিল্লিতে সব জানানো হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ফল দেখতে পাবেন।
সুকান্তবাবু বললেই দিল্লির নেতৃত্ব তা শুনবেন, এমনটা নাও হতে পারে। কারণ তাঁর আমলে বিজেপি বাংলায় সাফল্যের মুখ দর্শন করেনি। একের পর এক নির্বাচনে হেরেছে। এবং হেরেই চলেছে। দিলীপ ঘোষের কথায়, বাংলা বিজেপি হারতে হারতে ‘হারাধন’ হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও সুকান্তবাবু এখনও রাজ্য সভাপতি। বাংলায় ‘হারাধন বিজেপি’র প্রভাব না থাকলেও দিল্লিতে খুঁটির জোর বেশ ভালোই। দলীয় সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই জেপি নাড্ডার কাছে অনুপমবাবুর বিরুদ্ধে যাওয়া অভিযোগের সংখ্যা প্রায় পৌনে দু’শো।
তর্কের খাতিরে ধরেই নেওয়া গেল, নির্বাচনের আগে কলতলার ঝগড়া থামাতে দল অনুপমবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল। তাতে কি বঙ্গ বিজেপির খুব লাভ হবে? তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে বাংলায় পাঠানোর পিছনে দিল্লির একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। কী সেই উদ্দেশ্য? দিল্লির সমস্ত রকম সহযোগিতা সত্ত্বেও বাংলায় বিজেপির বিস্তার ঘটেনি। উল্টে দিনদিন ব্যর্থতাই প্রকট হয়েছে। তাই তাঁর চোখ দিয়ে দিল্লি বাংলার প্রকৃত অবস্থা জরিপ করতে চেয়েছিল। দিল্লির সেই সিদ্ধান্ত বঙ্গ বিজেপির পছন্দ হয়নি।
কেন উঠছে একথা? সাধারণত দল কাউকে নতুন দায়িত্ব দিলে তাঁকে স্বাগত জানানোটাই প্রথা। সুকান্তবাবু রাজ্য সভাপতি হওয়ার পর দিলীপ ঘোষ তাঁকে নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরেছিলেন। অনুপমবাবুর ক্ষেত্রে তেমনটা হল না। উল্টে তাঁকে গুরুত্ব না দিয়ে শুরু হল এড়িয়ে চলা। কারণ তিনি ভিনরাজ্যের প্রতিনিধিদের মতো কানে দেখবেন না।
অনুপমবাবু বাংলায় ফিরেই বিভিন্ন জেলায় বসে যাওয়া বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলেন। একসময় তাঁরাই ছিলেন বিজেপির মুখ। কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে বসে গিয়েছেন। বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে, নাকি বঙ্গ বিজেপিকে টাইট দেওয়ার জন্য, সেটা বলা কঠিন। কারণ বাংলায় বিজেপির শক্তিক্ষয়ের প্রধান কারণ বামপন্থীদের ঘরওয়াপসি। বিজেপিতে পাত্তা না পেয়ে অনেকেই সিপিএম ও তৃণমূলে ফিরেছেন। তাই দলের ভাঙন আটকাতে বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা দিল্লির কৌশলও হতে পারে। বিক্ষুব্ধরা সক্রিয় হতেই বিজেপির আরোপিত নেতারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছেন।
বীরভূম জেলাতেই বিজেপি প্রথম মাথা তুলেছিল। যাঁদের হাত ধরে বিজেপির উত্থান হয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশই এখন দলে পাত্তা পান না। অনেকেই অভিমানে বসে গিয়েছেন। অনুপমবাবু নতুন দায়িত্ব পাওয়ায় তাঁরা ফের সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। তাঁদের কেউই অনুপমবাবুর অনুগামী বা ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। কিন্তু অনুপমবাবু দায়িত্ব পাওয়ায় রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিতে বসা লোকগুলো ফের বিজেপি করার স্বপ্ন দেখছেন। তাতে লাভ বিজেপিরই। তা সত্ত্বেও দেওয়া হচ্ছে পদে পদে বাধা।
অনুপম এমন কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন যেটা বিজেপি কর্মীদের মনে ছিল, কিন্তু মুখে আনতে পারছিলেন না। সেই কথাগুলিই বলছেন বরাবরের ঠোঁটকাটা অনুপম। ফলে তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিজেপি কর্মীদের কাছে সহজেই ‘আমি তোমাদেরই লোক’ হয়ে যাচ্ছেন। সেটা বঙ্গ বিজেপির একাংশের গা জ্বালার অন্যতম কারণ। তবে, তারচেয়েও বড় কথা হল, তিনি হাটের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে দিচ্ছেন।
শোনা যাচ্ছে, খয়রাশোলে অনুপমের মঞ্চ ভাঙার কারণও নাকি হাটে হাঁড়ি ভাঙার আতঙ্ক। বিজেপি সূত্রের খবর, খয়রাশোলে দাঁড়িয়ে অনুপম ফাঁস করে দিতেন কোন নেতা মারফত বেআইনি কয়লার কালো টাকা কলকাতায় পৌঁছয়। মঞ্চ ভাঙাটা যে মারাত্মক ভুল হয়ে গিয়েছে, সেটা বঙ্গ বিজেপির নেতারাও মানতে বাধ্য হচ্ছেন। এই ঘটনায় বিজেপির দিকে উঠছে প্রশ্ন, এরপর গেরুয়া শিবিরের নেতারা কোন মুখে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সভা করতে না দেওয়ার অভিযোগ তুলবেন?
বঙ্গ বিজেপির একাংশ অনুপমবাবুকে ‘তৃণমূলের লোক’ প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছে। তাতে দিল্লির নেতাদের কান ভারী করা সহজ হবে। সেই লক্ষ্যেই অনুব্রত মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মাছের ঝোল ভাত খাওয়ার কথা বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আর রাজ্য সভাপতির মতে, ‘ব্লক সভাপতি হোন বা কেন্দ্রীয় সম্পাদক, তাঁর কথায় বিজেপির ক্ষতি আর তৃণমূলের লাভ হলে বুঝতে হবে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’
অনুপমবাবু যে ভাষায় সুকান্তবাবুকে আক্রমণ করেছেন তা হজম করা সত্যিই কঠিন। বালুরঘাট পুরসভা নির্বাচনে সুকান্তবাবু তাঁর বুথে বিজেপিকে জেতাতে পারেননি। সেটা মানুষ ভুলতে বসেছিল। কিন্তু অনুপমবাবু তাঁর ২০জন সঙ্গীর মধ্যে ১৮জনই নিরাপত্তারক্ষী বলায় সেইসব তথ্য নতুন করে চর্চায় উঠে আসছে। তাতে সুকান্তবাবু বেজায় চটেছেন। অনুপম শুধু বঙ্গ বিজেপির রাজনৈতিক যোগ্যতা নিয়েই কটাক্ষ করেননি, তিনি গেরুয়া শিবিরের আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। এরপরেও অনুপমবাবু স্বপদে এবং স্বমহিমায় বহাল থাকলে সুকান্তবাবুদের নাক কাটা যাবে। তাই তাঁরা যে কোনও মূল্যে এর একটা হেস্তনেস্ত করতে চাইবেন।
তবে, অনুপমবাবুকে সরিয়ে দিলে বা সেন্সার করলেও বঙ্গ বিজেপিতে স্বস্তি ফিরবে না। কারণ প্রায় প্রতিদিনই সামনে আসছে ক্ষোভ বিক্ষোভের ঘটনা। তাতে মানুষের মনে বিজেপির স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় ঘনীভূত হচ্ছে। সম্প্রতি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে পুজোর অনুদানের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সামনে এসেছে। দিলীপ ঘোষের সামনেই দলীয় কর্মীদের হাতে হেনস্তা হয়েছেন জেলা নেতা। তাতেই উঠেছে প্রশ্ন, দলের অনুদানের টাকা যারা আত্মসাৎ করে তারা সরকারি ক্ষমতা পেলে কী করবে? এখন যা অবস্থা তাতে আত্মরক্ষাই বঙ্গ বিজেপির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আক্রমণের দায়িত্বটা সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সির ঘাড়ে।
অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় এজেন্সি নির্ভরতাই বঙ্গ বিজেপিকে ‘নাবালক’ করে রেখেছে। তথাগত রায়ের আক্ষেপটা সেখানেই। তাঁর কথায়, বিজেপি নেতারা মাঝেমধ্যে সংগঠন সংগঠন বলে চিৎকার করেন। কিন্তু সংগঠন করতে গেলে মানুষকে ধরে রাখতে হয়। সেই মানুষ ধরে রাখার ভাবনাটাই বিজেপির মধ্যে নেই।
দিল্লিও বঙ্গ বিজেপির দুর্বলতার জায়গাটা জানে। তার জন্যই বাড়ানো হয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তৎপরতা। রাজ্যের কোণায় কোণায় চলছে এজেন্সির হানা। উদ্দেশ্য, বিরোধী শিবিরকে ভয় পাইয়ে দেওয়া। তারপর পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন মিটলেই শুরু হয়ে যাবে দিল্লির বিজেপি নেতাদের বাংলায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দৌলতে বাংলার মাটিতে ফের একবার আছড়ে পড়বে গেরুয়া উচ্ছ্বাস। কিন্তু তা দিয়ে কি ঢাকা যাবে বঙ্গ বিজেপির দ্বন্দ্ব, খেয়োখেয়ি? বন্ধ হবে কি নিষ্কণ্টক হওয়ার অভিলাসে আস্তিনের নীচে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি?
তথাগতবাবুর কথাতেই আছে তার উত্তর, ‘বঙ্গ বিজেপিতে দল নয়, পদই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সাফল্য আসছে না।’ সেটা দিল্লির বিজেপি নেতারাও টের পাবেন। লোকসভা ভোটের ফল বেরলেই বুঝতে পারবেন, এতদিন ধরে তাঁরা বাংলায় ভস্মে ঢেলেছেন ঘি।