শরীর ও স্বাস্থ্য

লিভারের রোগ কেন হয়? সমাধান কী?
ডাঃ অশোকানন্দ কোনার

শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভার। লিভারের সমস্যায় অনেকেই ভোগেন। এই অসুখের দুটি ভাগ অ্যাকিউট লিভার ডিজিজ আর ক্রনিক লিভার ডিজিজ। অ্যাকিউট হেপাটাইটিস হয় ভাইরাস থেকে। প্রায় সব বয়সেই এই অসুখ হতে পারে। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ই ভাইরাসগুলি সরাসরি লিভারকে আক্রমণ করে। জন্ডিস, ফ্যাটি লিভার থেকে সিরোসিস অব লিভার পর্যন্ত হতে পারে নানা কারণে। সঠিক লাইফস্টাইল মেনে চললে অসুস্থ লিভারকে সুস্থ রেখে দিব্যি দীর্ঘ জীবন কাটানো যায়। কীভাবে? লিভার ঠিক রাখার বিভিন্ন চিকিৎসা, ব্যায়াম আর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বললেন ডাঃ অশোকানন্দ কোনার, ডাঃ আশীষ শাসমল, ডাঃ অঞ্জন গোস্বামী, পুষ্টিবিদ মীনাক্ষী মজুমদার ও ব্যায়ামবিদ পরিতোষ কুমার হাজরা।

লিভারের অসুখকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। অ্যাকিউট লিভার ডিজিজ, ক্রনিক লিভার ডিজিজ।

অ্যাকিউট লিভার ডিজিজ কী?
অ্যাকিউট হেপাটাইটিস প্রধানত হয় ভাইরাস থেকে। প্রায় সব বয়সেই এই অসুখ হতে পারে। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ই ভাইরাসগুলি সরাসরি লিভারকে আক্রমণ করে। তার মধ্যে হেপাটাইটিস এ এবং ই দু’টিই জলবাহিত ভাইরাস। অর্থাত্‍ এই দুটি অসুখ হয় বর্ষাকালে। কারণ বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে রাস্তাঘাটে জল দাঁড়িয়ে যায়। ফলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে পানীয় জলের লাইনের সঙ্গে সুয়ারেজ লাইনের সংযুক্তি ঘটে। অর্থাত্‍ যে জল আমরা পান করি সেই জলের শুদ্ধতা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই কোনওভাবে একজন ব্যক্তি সংক্রামিত জল পান করলে তাঁর হেপাটাইটিস এ বা ই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। গ্রামেগঞ্জে এখনও যেমন দেখা যায়, পুকুরে যে জলে স্নান করা হচ্ছে, কাপড় কাচা হচ্ছে সেই জলই আবার পান করা হচ্ছে। এমন জল যে আসলে দূষিত সেই সম্বন্ধে অনেকরই ধারণা নেই।
হেপাটাইটিস এ আবার একটু কম বয়সে অর্থাত্‍ ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই বেশি হতে দেখা যায়। হেপাটাইটিস ই সব বয়সেই হতে পারে। হেপাটাইটিস ই নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ সন্তানসম্ভবা মহিলাদের মধ্যে এই ধরনের অসুখ বিপুল জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
হেপাটাইটিস ই ভাইরাসে আক্রান্তর প্রাণহানির হার খুব কম, একেবারে ১ শতাংশেরও কম। তবে গর্ভবতী মা এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে তাঁর ক্ষেত্রে প্রাণহানির হার অনেক বেশি হতে পারে।
রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে বলা যায়, হেপাটাইটিস এ-এর ভ্যাকসিন কিন্তু বাজারে আছে। বাচ্চাদের হেপাটাইটিস এ ভ্যাকসিন দেওয়া হয় তার ফলে একটা রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে ওঠে। আর হেপাটাইটিস ই-এর ভ্যাকসিন সর্বজনীন নয়। তবে গর্ভবতী মহিলাদের এই ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রচলন শুরু হচ্ছে। চীন, নেপালে এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হয়েছে। তবে আমাদের দেশে এখনও অবধি এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন অমিল। তাই গর্ভবতী মায়েরা সবসময় বিশুদ্ধ পানীয় জল পান করার চেষ্টা করুন। জল ফুটিয়ে পান করুন। রান্না করুন শুদ্ধ জলে।

ক্রনিক লিভার ডিজিজই বা কী?
আরও দুটি ভাইরাসজনিত অসুখ আছে যা লিভারের ক্রনিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি-এর কথা বলা যায়। এই দুটি ভাইরাস জলবাহিত নয়। তবে দুটি ভাইরাসই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। রক্তের মাধ্যমে বা আগে ব্যবহৃত ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দুটি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে। কারও কারও বেনামী জায়গা থেকে ট্যাটু করানোর ফলে সূঁচের মাধ্যমে শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করার আশঙ্কা থেকে যায়। এই ভাইরাসগুলি শরীরে একবার ঢুকলে সহজে শরীর থেকে বেরতে চায় না। অথচ ভাইরাসগুলির প্রভাবে ক্রনিক লিভার ডিজিজ হয়। এই জন্য শেষ পর্যন্ত এ থেকে লিভার সিরোসিস হতে পারে এবং লিভার ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।
সমগ্র পৃথিবীতেই হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি, লিভার ক্যান্সারের মূল কারণ। তার মধ্যে এশিয়া এবং আফ্রিকায় হেপাটাইটিস বি এবং ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড বা পশ্চিমী দেশগুলিতে (ইউরোপ, আমেরিকা) হেপাটাইটিস সি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।
হেপাটাইটিস বি অ্যাকিউট ইনফেকশনও তৈরি করতে পারে মিসম্যাচড ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে। হেপাটাইটিস সি-এর ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে। তবে হেপাটাইটিস সি-এর ক্ষেত্রে অ্যাকিউট অবস্থা অনেকসময় ধরা যায় না। রোগী বেশিরভাগ ক্ষেত্রই ক্রনিক সমস্যা নিয়েই চিকিত্‍সকের কাছে হাজির হন।
এছাড়া লিভারের অসুখের পিছনে কারণগুলি নিয়ে আমাদের এই আলোচনায় একটি বিশেষ উপাদান নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়। তা হল অ্যালকোহল। অ্যালকোহল সেবনের মাত্রা সমগ্র পৃথিবীতেই অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। আমাদের দেশেও অ্যালকোহল থেকে ক্রনিক লিভার ডিজিজে আক্রান্তর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেশি।
এছাড়াও আরও কতকগুলি কারণে লিভারের অসুখ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় যেমন ড্রাগ ইনডিউসড লিভার ডিজিজ বা ওষুধ থেকে লিভারের রোগ। আসলে এখন নানা রোগের উপশমে একাধিক ধরনের ওষুধ বেরিয়েছে। ওষুধগুলি শরীরে কাজ করতে পারে হয় কিডনি না হলে লিভারের মাধ্যমে। কিছু ওষুধ আছে যার কুপ্রভাব লিভারের উপর অত্যন্ত বেশি। সেই ওষুধগুলি দীর্ঘদিন ধরে সেবন করলে তা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে লিভারের উপরে।
আবার অন্যান্য ধরনের অসুখ যেমন নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ-এর সংখ্যাও বাড়ছে হু হু করে। অসুখটির নামের মধ্যেই মূল সমস্যাটির উল্লেখ আছে। এই রোগে লিভারের কোষগুলি ফ্যাট গ্লোবিউলস-এ ভরতি হয়ে যায়। কিছু কিছু ব্যক্তির মধ্যে এই ফ্যাট প্রদাহের সৃষ্টি করে। তখন এই ধরনের লিভারের অসুখকে বলে স্টিটোহেপাটাইটিস। স্টিটো শব্দের অর্থ ফ্যাট আর হেপাটাইটিস শব্দের অর্থ হল লিভারের অসুখ। সঠিক ব্যবস্থা না নিলে প্রায় ২০ ভাগ ক্ষেত্রে অসুখটি লিভার সিরোসিসে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সমগ্র পৃথিবীতে এই অসুখটিই প্রধানতম অসুখ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

রোগ প্রতিরোধ ও চিকিত্‍সা
জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে অনেকক্ষেত্রেই লিভারের অ্যাকিউট সংক্রমণগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। লাইফস্টাইল মডিফিকেশন দিয়ে জল পান সঠিকভাবে করে হেপাটাইটিস ভ্যাকসিন এ, ই ইত্যাদিও সঠিকভাবে নেওয়া হল, ত্রুটিপূর্ণ ব্লাড ট্রান্সফিউশন হল না, ওষুধের ব্যাপারে আমরা সচেতন হলাম এবং প্রধানতম লাইফস্টাইল ডিজিজ অর্থাত্‍ এই যে অলসভাবে দিন কাটানো, মাত্রাতিরিক্ত ফ্যাটযুক্ত খাদ্যগ্রহণ, অ্যালকোহল পান ইত্যাদি বিষয়ের ফলাফল হল ফ্যাটি লিভার। ফ্যাটি লিভার থেকে যে অসুখ হয় তাকে প্রথমে বলা হয় স্টিটোহেপাটাইটিস ও তা থেকে লিভার সিরোসিস। পশ্চিমের দেশে বেশিরভাগ লোকই স্থূলকায়। আর সেটাই প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে লিভার প্রতিস্থাপনের। তাহলে আস্তে আস্তে যেখানে কমিউনিকবল ডিজিজ কমে যাচ্ছে সেখানে নন কমিউনিকেবল বা লাইফস্টাইল ডিজিজ-এর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। 
মূলত অ্যালকোহল এবং ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজই লিভারের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমস্যাগুলোতে লিভারের ক্ষতি হচ্ছে, এমনকী শেষ পর্যন্ত সিরোসিস হচ্ছে। কারও কারও লিভার প্রতিস্থাপনেরও প্রয়োজন হচ্ছে।

লিভার ডিজিজ-এর লক্ষণ
লিভারের অসুখের উপসর্গ বোঝা বেশ শক্ত। অতিপরিচিত উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে জন্ডিস, পেটে ব্যথা।
অ্যাকিউট ইনফেকশনের ক্ষেত্রে জন্ডিস হয় ও কিছু রক্ত পরীক্ষা করলে তা পরিষ্কারভাবে জানা সম্ভব। লিভার ফাংশন টেস্ট-এ অস্বাভাবিকত্ব নজরে আসে। তা থেকেই চিকিত্‍সক লিভারের সমস্যা সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারেন। এরপর আরও কিছু টেস্ট করা হয় যেমন ভাইরাসের মার্কার করা হয়। করা হয় আলট্রাসাউন্ড। তাতে লিভারের অবস্থাটা বোঝা যায়। অর্থাত্‍ সিরোসিস হয়েছে কি না, বা পেটে জল জমেছে কি না। অথবা অনেক ক্ষেত্রে লিভারে কোনও টিউমার তৈরি হচ্ছে কি না।

রোগ প্রতিরোধের উপায়
যেমনভাবে নিজের জীবন চালাবেন সেভাবেই প্রকাশ পাবে লিভারের অসুখ। নিজের জীবনযাত্রার পরিবর্তন ছাড়া এই সমস্যার প্রতিকার ও প্রতিরোধ অসম্ভব।

কী করবেন
খাদ্যগ্রহণের দিকে রাখতে হবে কড়া নজর। অতিরিক্ত মাত্রায় চর্বিজাতীয় খাদ্য খাওয়া চলবে না। অ্যালকোহল পান হবে পরিমিত। পরিত্যাগ করতে পারলেই ভালো, এছাড়া ভ্যাকসিন নিতে পারলে খুবই ভালো হয়। আর একটা কথা আমাদের দেশের মানুষদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বলতেই হবে, তা হল নিজেই নিজের চিকিত্‍সা করবেন না।
দোকান থেকে চেয়েচিন্তে ওষুধ এনে খাবেন না। বহু বাজারচলতি ওষুধেরই দুরন্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে যা থেকে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্‍সকের পরামর্শ নিন। বহু ওষুধ রয়েছে যা আপনাকে সুস্থ রাখতে, রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে।
অনুলিখন: সুপ্রিয় নায়েক
27d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বিদ্যা শিক্ষা ও কাজকর্মে দিনটি শুভ। বন্ধুসঙ্গে বিপদ হতে পারে। অধ্যাপনায় অগ্রগতি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৪ টাকা৮৪.৯৮ টাকা
পাউন্ড১০৭.৮৯ টাকা১১১.৮৫ টাকা
ইউরো৮৯.৯১ টাকা৯৩.৪৯ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা