মুখুয্যে—হরি (বাগবাজারের হরিবাবু) আপনার কালকের কথা শুনে অবাক! বলে, ‘সাংখ্যদর্শনে, পাতঞ্জলে, বেদান্তে—ওসব কথা আছে। ইনি সামান্য নন।’
শ্রীরামকৃষ্ণ—কৈ, আমি সাংখ্য, বেদান্ত পড়ি নাই। “পূর্ণজ্ঞান আর পূর্ণভক্তি একই। ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে বিচারের শেষ হলে ব্রহ্মজ্ঞান।—তার পর যা ত্যাগ করে গিছিল, তাই আবার গ্রহণ। ছাদে উঠবার সময় সাবধানে উঠতে হয়। তার পর দেখে যে, ছাদও যে জিনিসে—ইট চুন সুরকি—সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারি! “যার উচ্চ বোধ আছে, তার নীচু বোধ আছে। জ্ঞানের পর, উপর নীচে এক বোধ হয়।
“প্রহ্লাদের যখন তত্ত্বজ্ঞান হতো, ‘সোঽহং’ হয়ে থাকতেন। যখন দেহবুদ্ধি আসত ‘দাসোঽহম্’ ‘আমি তোমার দাস’ এই ভাব আসত। “হনুমানেরও কখনও ‘সোঽহং’, কখনও ‘দাস আমি’ কখনও ‘আমি তোমার অংশ’ এই ভাব আসত।
“কেন ভক্তি নিয়ে থাকা?—তা না হলে মানুষ কি নিয়ে থাকে। কি নিয়ে দিন কাটায়। “ ‘আমি’ তো যাবার নয়, ‘আমি’ ঘট থাকতে সোঽহং হয় না। সমাধিস্থ হলে ‘আমি’ পুছে যায়—তখন যা আছে তাই। রামপ্রসাদ বলে, তার পর আমি ভাল কি তুমি ভাল, তা তুমিই জানবে। “যতক্ষণ ‘আমি’ রয়েছে, ততক্ষণ ভক্তের মতো থাকাই ভাল। ‘আমি ভগবান’ এটি ভাল নয়। হে জীব ভক্তবৎ ন চ কৃষ্ণবৎ! তবে যদি নিজে টেনে লন, তবে আলাদা কথা। যেমন মনিব চাকরকে ভালবেসে বলছে, আয় আয় কাছে বোস আমিও যা তুইও তা। “গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউয়ের গঙ্গা হয় না!
“শিবের দুই অবস্থা। যখন আত্মারাম তখন সোঽহং অবস্থা,—যোগেতে সব স্থির। যখন ‘আমি’ একটি আলাদা বোধ থাকে তখন ‘রাম! রাম!’ করে নৃত্য। “যাঁর অটল আছে, তাঁর টলও আছে। “এই তুমি স্থির! আবার তুমিই কিছুক্ষণ পরে কাজ করবে। “জ্ঞান আর ভক্তি একই জিনিস।—তবে একজন বলছে ‘জল’, আর একজন ‘জলের খানিকটা চাপ’।
দুই সমাধি—সমাধির প্রতিবন্ধক—কামিনীকাঞ্চন
“সমাধি মোটামুটি দুই রকম।—জ্ঞানের পথে, বিচার করতে করতে অহং নাশের পর যে সমাধি, তাকে স্থিত সমাধি বা জড় সমাধি (নির্বিকল্প সমাধি) বলে। ভক্তিপথের সমাধিকে ভাব সমাধি বলে। এতে সম্ভোগের জন্য, আস্বাদনের জন্য, রেখার মতো একটু অহং থাকে। কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি থাকলে এসব ধারণা হয় না।
“কেদারকে বললুম, কামিনীকাঞ্চনে মন থাকলে হবে না। ইচ্ছা হলো, একবার তার বুকে হাত বুলিয়ে দি—কিন্তু পারলাম না। ভিতরে অঙ্কট বঙ্কট। ঘরে বিষ্ঠার গন্ধ, ঢুকতে পারলাম না। যেমন স্বয়ম্ভূ লিঙ্গ কাশী পর্যন্ত জড়। সংসারে আসক্তি—কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি, থাকলে হবে না।’’ “ছোকরাদের ভিতর এখনও কামিনীকাঞ্চন ঢোকে নাই; তাইত ওদের অত ভালবাসি। হাজরা বলে, ‘ধনীর ছেলে দেখে, সুন্দর ছেলে দেখে—তুমি ভালবাস’। তা যদি হয়, হরিশ, নোটো, নরেন্দ্র—এদের ভালবাসি কেন? নরেন্দ্রের ভাত নুন দে খাবার পয়সা জোটে না।
“ছোকরাদের ভিতর বিষয়বুদ্ধি এখনও ঢোকে নাই। তাই অন্তর অত শুদ্ধ। “আর অনেকেই নিত্যসিদ্ধ। জন্ম থেকেই ঈশ্বরের দিকে টান। যেমন বাগান একটা কিনেছে। পরিষ্কার করতে করতে এক জায়গায় বসানো জলের কল পাওয়া গেল। একবারে জল কলকল করে বেরুচ্ছে।”
স্বামী শিবপ্রদানন্দ সম্পাদিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবতীর্থ বলরাম মন্দির’ থেকে