কোনও রাজ্যে পুলিস যা পারে না, সিবিআই-ইডি তা অনায়াসে করে দেখায়। একটা সময়ে এই দুই তদন্তকারী সংস্থা সম্পর্কে এমনই ‘মিথ’ ছিল। এক যুগ আগেও এই দুই সংস্থার উপর অগাধ আস্থা-ভরসার কথা শোনা যেত রাজনৈতিক দল থেকে আদালতের মুখে। সেসব এখন অতীত। মোদি জমানায় এই দুই স্বাধীন পেশাদার সংস্থা এখন চরম উপহাস ও করুণার পাত্র হয়ে উঠেছে যেন। আদালতের ভাষায় ‘খাঁচাবন্দি তোতা’। সিবিআই-ইডি মানে এখন প্রতিবাদী নাগরিক থেকে বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা, চূড়ান্ত হেনস্তার রোজনামচা। সাফল্যের হার যাদের তলানিতে ঠেকেছে। একদা ‘ফার্স্টবয়’ এখন পাশ মার্ক তুলতেও হিমশিম খাচ্ছে। গর্বের জায়গা নিয়েছে নিদারুণ লজ্জা। কেন এই হাল, সেই উত্তর লুকিয়ে আছে সরকারের দেওয়া তথ্যেই। তাতে জানা যাচ্ছে, চার বছর আগে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিবিআইয়ের হাতে মামলা ছিল প্রায় দশ হাজার। এর এক তৃতীয়াংশ মামলার বয়স দশ বছর। শ’পাঁচেক মামলার নিষ্পত্তি হয়নি কুড়ি বছরেও। বেশ কিছু মামলায় রয়েছে আদালতের স্থগিতাদেশ। সিবিআই এই তথ্য আদালতে পেশ করলেও মামলায় কতজন সাজা পেয়েছে, কতগুলো মামলায় চূড়ান্ত পর্যায়ের শুনানি চলছে তা খোলসা করেনি তারা। সন্দেহ নেই, তারপর থেকে গত চার বছরে ব্যর্থতার এই তালিকায় আরও অজস্র মামলা যুক্ত হয়েছে। ধরা যাক, আরও এক তদন্তকারী সংস্থা ইডির কথা। ২০১৪ সাল থেকে গত দশ বছরে এই সংস্থা বেআইনি অর্থ তছরূপের মামলা করেছে ৫২৯৭টি। এর মধ্যে মামলা শেষ হয়েছে মাত্র ৪৩টির। সাজা হয়েছে আরও কম, ৪০টির। বাকি মামলাগুলির বিচারপর্বই শুরু হয়নি! একই সময়ে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে ৮৭১৯টি মামলা করেছে ইডি। সাজা ঘোষণা হয়েছে, মাত্র ৭৮৯টি মামলায়। ৫৬৭টি মামলায় অভিযুক্তরা প্রমাণের অভাবে মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। চলে আসি বাংলায়। এ রাজ্যে শুধু সিবিআইয়ের মামলার সংখ্যাই ৫০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ২০ বছর আগের নোবেল চুরির মামলাও রয়েছে। মজার কথা হল, যাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণ করতে ইডি-সিবিআইকে কাজে লাগানো হয় বলে বিরোধীদের অভিযোগ, সেই মোদি সরকার এখন তোপ দেগে বলতে শুরু করেছে, এত মামলা! শাস্তি কোথায় হচ্ছে?
বাংলায় প্রবাদ আছে, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ঘটনাও তাই। কেন্দ্রে যে যখন ক্ষমতায়, সিবিআই যেন তার খাস পেয়াদায় অবতীর্ণ। গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একবার কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, সিবিআই হল ‘কংগ্রেস ব্যুরো অব ইন্ডিয়া’। ভাগ্যের পরিহাস, সেই মোদি সরকারের বিরুদ্ধেই বেছে বেছে বিরোধীদের হেনস্তা করতে দুই কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। এবং এসব এখন এতটাই নির্লজ্জভাবে হচ্ছে যে সিবিআইকে ‘খাঁচাবন্দি তোতা’ বলে কটাক্ষ শুনতে হয়েছে বিচারপতিদের থেকে। বিরোধীদের অভিযোগ ও আদালতের কটাক্ষ যে একেবারেই অমূলক নয় তার অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে গোটা দেশজুড়ে। গত বছরের মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দিয়ে দেশের ১৪টি বিরোধী রাজনৈতিক দল জানায়, ২০০৪-১৪ সালের দশ বছরে মনমোহন সিংয়ের জমানায় ৭২ জন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি। এর মধ্যে বিরোধীদলের ছিলেন ৪৩ জন। অথচ ২০১৪ থেকে ২৩-এ মোদি জমানার দশ বছরে তদন্তের আওতায় আসা ১২৪ জনের মধ্যে ১১৮ জনই বিরোধী পক্ষের। শতকরা হিসাবে ৯৫ শতাংশ। ওই পিটিশনে সঙ্গতভাবে প্রশ্ন তোলা হয়, পি চিদম্বরম, মণীশ সিসোদিয়া, সঞ্জয় রাউত, সত্যেন্দ্র জৈনদের মতো বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলে কেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা, নারায়ণ রানের মতো শাসক নেতারা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন? উল্টে দেখা গিয়েছে, আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হিমন্ত হয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী, সারদা চিটফান্ড কাণ্ডে অভিযুক্ত মুকুল রায় হয়েছিলেন বিজেপির সহ সভাপতি, নারদ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত একজন হয়েছেন বিজেপি নেতা। এই কারণেই বিরোধীরা ঠাট্টা করে বলে, ‘ওয়াশিং পাউডার ভাজপা।’
তবে কি সিবিআই-ইডি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর আরও গভীরে। ঘটনা হল, গোটা দেশে এই দুই তদন্তকারী সংস্থার উপর যে মামলার পাহাড় জমেছে তা সামলানোর মতো পরিকাঠামো এদের নেই। যেমন রাজ্যের এক মামলায় ইডির এক অফিসারকে আদালতে দাঁড়িয়ে হতাশ গলায় বলতে শোনা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তাদের ১৩১টি মামলা চলছে, একজন অফিসার ২২টি করে মামলা দেখছেন। তদন্তে গাফিলতির অভিযোগের জবাবে একথা জানিয়েছিলেন ওই ইডি অফিসার। এই ছবিটা শুধু বাংলায় নয়, গোটা দেশে সর্বত্র। কিন্তু মূল প্রশ্ন হল, সিবিআই-ইডি কি কেন্দ্রের হাতের পুতুল? নাকি তাদের পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছে? উত্তরটা অনেকেরই জানা। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যতদিন এই তদন্তকারী সংস্থাগুলি সম্পূর্ণ রাজনীতি মুক্ত হয়ে কাজ করতে না পারবে ততদিন শুধু মামলার পর মামলা জমতেই থাকবে। অধরা থেকে যাবে সাফল্য।