আগেই নাম উঠেছে গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের। এবার কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নিয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠল ডাবল ইঞ্জিনের আরেক রাজ্য অসমের বিরুদ্ধে। কৃষকদের আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য গোটা দেশে পিএম কিষান সম্মাননিধি প্রকল্প চালু রয়েছে। এই প্রকল্পে একজন কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে বছরে তিন কিস্তিতে মোট ৬ হাজার টাকা জমা করে কেন্দ্র। অসমে এই প্রকল্পে ব্যাপক নয়ছয় হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বয়ং ‘ক্যাগ’। দুর্নীতির অঙ্কটাও চোখে পড়ার মতো, ৫৬৭ কোটি টাকা! অসম বিধানসভায় রিপোর্ট পেশ করে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল দেখিয়েছে, এই প্রকল্পের ১৫ লক্ষ সুবিধাভোগী আর্থিক সাহায্য পাওয়ার যোগ্য নন। এঁদের মধ্যে ভুয়োই আবার ৭২ শতাংশ। সংখ্যায় ১১ লক্ষ ৩১ হাজার ১৫২ জন। কীরকম ভুয়ো? ক্যাগ বলছে, প্রাপক অনেকে চাষিই নন। ভুয়ো তালিকায় সরকারি কর্মচারী, পেনশনভোগীও রয়েছেন। উপভোক্তাদের অনেকের আবার খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। ক্যাগের এই রিপোর্ট ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। বিস্ময়ের কথা হল, এখন ক্যাগ যা বলছে, ২০২০ সালে তদন্ত করে একই অভিযোগ তুলেছিল খোদ অসম সরকারই। সে বছর টানা তিন মাসের তদন্তে উঠে আসে, মোট ৩১ লক্ষ ২০ হাজার ৪৩০ জন অনুমোদিত সুবিধাভোগীর মধ্যে ৩৭ শতাংশ অযোগ্য। তবু তাঁরা টাকা পেয়েছেন! হিমন্ত বিশ্বশর্মার সরকার ভুয়ো প্রাপকদের তালিকা পেয়েও হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে!
কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ে অসমকে অবশ্য টেক্কা দিয়েছে বিজেপি শাসিত অন্যান্য রাজ্য। ধরা যাক, মধ্যপ্রদেশের কথা। এই রাজ্যে গ্রামীণ, আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ আনে ক্যাগ। অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মধ্যপ্রদেশে অন্তত দেড় হাজার ‘অযোগ্য’ ব্যক্তির কাছে গ্রামীণ আবাস যোজনার ১৫ কোটি টাকা পৌঁছে গিয়েছে। এছাড়া আরও ৮ হাজার ব্যক্তিকে নিয়মবহির্ভূতভাবে এই প্রকল্পের আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বঞ্চিত হয়েছেন রাজ্যের তফসিলি জাতি-উপজাতি গোষ্ঠীর গ্রামবাসীরা। ধরা যাক, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নিজের রাজ্য গুজরাতের কথা। অথবা যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ। এই দুই রাজ্যের বিরুদ্ধে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ উঠে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বয়ানেই। গত বছর তৎকালীন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী সংসদে পেশ করা রিপোর্টে জানিয়েছিলেন, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে গোটা দেশে মোট ৫ কোটি ১৮ লক্ষ ভুয়ো জবকার্ড বাতিল করা হয়েছে। তার আগের বছর সংখ্যাটা ছিল ১ কোটি ৪৯ লক্ষ। আর ২০২৩-এর অক্টোবর পর্যন্ত সংখ্যাটা প্রায় ৭ কোটি ছাড়িয়েছে! যেসব রাজ্য থেকে ভুয়ো জবকার্ড উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ছাড়াও রয়েছে ডাবল ইঞ্জিনের রাজ্য গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে শুধু গুজরাতেই ৪ লক্ষ ৩০ হাজার ভুয়ো জবকার্ড বাতিল হয়েছে।
একটা বিষয় পরিষ্কার, কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ নিয়ে একাধিক রাজ্যে নয়ছয়ের ঘটনা ঘটেছে। এই রোগ বহুদিনের পুরনো। প্রশাসন ও শাসকদলের প্রত্যক্ষ মদত ও আশকারা ছাড়া যে এই আর্থিক তছরূপ সম্ভব নয়, তা জলের মতো পরিষ্কার। সরকারি অর্থ, মানে জনগণের করের টাকা নিয়ে এভাবে নয়ছয়ের অভিযোগ উঠলে কেন্দ্র কঠোর পদক্ষেপ করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ঘটনা হল, বাংলায় আবাস ও ১০০ দিনের প্রকল্প নিয়ে আর্থিক তছরূপের অভিযোগ ওঠায় এই দুই প্রকল্পের টাকা দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে মোদি সরকার। অথচ এই অভিযোগের কাঠগড়ায় থাকলেও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির টাকা আটকে নেই! এর কারণ অবশ্য বলে দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যেটা বলার তা হল, একজন প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর সরকার এমন দ্বিচারিতা করতে পারেন কি না? আসলে বাংলার মতো দেশের প্রতিটি বিরোধী শাসিত রাজ্যকে বেকায়দায় ফেলার সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, এই আমলে সবার উপরে রাজনীতি সত্য। সন্দেহ নেই, কদর্যতার নিরিখে এই দ্বিচারিতা মোদি জমানায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দুর্নীতির পক্ষে কেউ নয়। সে দুর্নীতি ১০০ দিনের কাজে হোক বা বিশেষ কোনও শিল্পপতিকে অন্যায্য সুযোগ পাইয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু রাজনৈতিক হাতিয়ারকে সরকার ব্যবহার করলে তা ঘোর অন্যায় হয়, যা সমানে করে চলেছে মোদি সরকার। তাছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে টাকা বন্ধ করে দিয়ে কেন প্রকৃত উপভোক্তাদের বঞ্চিত করা হবে— সেই প্রশ্নেরও সদুত্তর পাওয়া উচিত। বন্ধ হওয়া দরকার কেন্দ্রের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আদৌ যা বাঞ্ছনীয় নয়।