প্রথমে একটি মেসেজ বা ই-মেল। তারপর ফোন। পুলিস, সিবিআই, ইডি বা শুল্ক বিভাগের আধিকারিকের পরিচয় দিয়ে ওপ্রান্ত থেকে বলা হচ্ছে, আপনার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, আর্থিক অনিয়ম বা নিয়মভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। তাই ‘ডিজিটাল গ্রেপ্তার’ জারি হয়েছে। এরপর কোনওরকম সন্দেহ দূর করতে ফোন থেকে ভিডিও কলে যোগ দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। তাতে গ্রাহক দেখতে পাবেন, থানা বা সরকারি দপ্তরে বসে থাকা সেই ব্যক্তিকে, নানাভাবে মানসিক চাপ তৈরির চেষ্টা করছে। শেষে গ্রেপ্তার এড়াতে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হবে। সমঝোতা মানে, ‘জরিমানা’ হিসাবে মোটা অঙ্কের টাকার দাবি। হতভম্ব গ্রাহক গ্রেপ্তার এড়াতে টাকার দাবি মেটাতেই ভিডিও কলের লাইন কেটে যাবে। ভ্যানিস হয়ে যাবে ফোনের সেই ব্যক্তি। পরে খোঁজ নিয়ে বোঝা যাবে, থানা বা সরকারি দপ্তরের হুবহু আদলে স্টুডিওতে বসে যে ব্যক্তি এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, সে আসলে প্রতারক। তখন অবশ্য কিছু করার থাকবে না। নরেন্দ্র মোদির ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’য় এ হল সাইবার জালিয়াতির নতুন সংযোজন, ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’। কেন্দ্রের সাইবার শাখার সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে গত দশ মাসে এই নয়া প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন দেশের এক লক্ষ নাগরিক। খোয়া গিয়েছে ২ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। মানে মাসে ২১৪ কোটি টাকা। ‘ডিজিটাল গ্রেপ্তারের’ ফোন আসছে মূলত থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, ও ভিয়েতনামের বেআইনি কল সেন্টার থেকে। তবে ফোনের সিম ব্যবহার করা হচ্ছে ভারতের। যারা গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলছে, সেই প্রতারকরাও অধিকাংশই ভারতীয়। খোয়া যাওয়া অর্থ প্রথমে জমা পড়ছে দেশেরই কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। মূলত গরিব, অশিক্ষিত মানুষদের ভুল বুঝিয়ে তাদের অ্যাকাউন্ট ‘ভাড়া’ নেওয়া হচ্ছে। তারপরে পুরো টাকাটাই ক্রিপ্টো কারেন্সিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
এতকাল চুরি, ডাকাতি করে টাকা লুটের কথা শুনেছে মানুষ। কিন্তু সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিতে অনলাইন জালিয়াতি বা সাইবার ক্রাইম এ দেশে এখন নতুন আতঙ্কের নাম। ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষকে বোকা বানিয়ে, ভয় দেখিয়ে বা হুমকি দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই এর একমাত্র লক্ষ্য। মোদি সরকারের ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের ‘কল্যাণে’ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা সহ প্রায় সবক্ষেত্রেই অনলাইন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই ডিজিটাল নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বাস্তব যে, দেশের বহু কোটি মানুষ এখনও এই আধুনিক প্রযুক্তিতে সড়গড় নন। তাঁরা অনলাইন লেনদেন করতেই জানেন না। বাধ্য হয়ে এই বিরাট অংশের মানুষ অন্যের শরণাপন্ন হন। বিশেষ করে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এই অজ্ঞ বা স্বল্পজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের কাছে অনলাইনে ট্রানজাকশন রীতিমতো মূর্তিমান বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সর্বোচ্চ ব্যাঙ্ক আরবিআই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বারো বছরে দেশে ডিজিটাল লেনদেন বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ২০১২-’১৩ সালে যেখানে ১৬২ কোটি ডিজিটাল পেমেন্ট হয়েছে, ২০২৩-’২৪ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৭১৬ কোটি পেমেন্ট। এই অনলাইন পেমেন্টের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার জালিয়াতি। ২০১৯-’২০ সালে দেশে অনলাইন জালিয়াতির সংখ্যা ছিল ৭৩ হাজার। ২০২৩-’২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২ লক্ষ ৯৩ হাজার। এই সময়ে জালিয়াতি করে টাকা লুট বেড়ে হয়েছে ২৪৪ কোটি থেকে ২ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। জালিয়াতির জালের (ট্রানজাকশনে) শীর্ষে রয়েছে যে পাঁচটি ব্যাঙ্ক, তার চারটিই বেসরকারি।
মজার কথা হল, সাইবার জালিয়াতির এই নয়া বিপদ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বলেছেন, ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ বলে কিছু হয় না। প্রতারণার খপ্পরে পড়ে যে বহু মানুষ তাঁদের কষ্টার্জিত উপার্জন হারাচ্ছেন, তাও মেনে নিয়েছেন মোদি। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন ও সতর্ক থাকার কথা বললেও মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়া এই জালিয়াতি ঠেকাতে নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকার কী ভাবছে— তা নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি তিনি। কিন্তু ডিজিটাল বিপ্লব নিয়ে ঢাক পেটালে তো এর অন্ধকার দিকটা নিয়েও মুখ খুলতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ জ্ঞানের অভাবে সাইবার অপরাধের ঝুঁকির তালিকায় রয়েছেন। একই কথা প্রযোজ্য বয়স্ক নাগরিকদের ক্ষেত্রেও। এমনকী জালিয়াতির নিখুঁত পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিয়ে শিক্ষিত শ্রেণির একটি অংশও বোকা বনে যাচ্ছেন। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, শুধু সচেতনতা ও সতর্কতার পাঠ দিয়েই কি দায় এড়াতে পারে সরকার? নাকি এই আধুনিক প্রযুক্তির রন্ধ্রপথ দিয়ে ঢুকে পড়া জালিয়াতি আটকাতে নিরাপত্তার দ্রুত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে?