যত গুড়, তত মিষ্টি। প্রচলিত এই কথাটা একটু পাল্টে অনায়াসে বলা যায়, যত যাত্রী, তত কমিশন। বেসরকারি বাসের ড্রাইভার কনডাক্টরের জন্য ‘কুখ্যাত’ সেই কমিশন প্রথা উঠে গিয়ে এবার কি বেতন ব্যবস্থা চালু হবে? গত মঙ্গলবার মায়ের স্কুটারে চেপে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে সল্টলেকের দু’নম্বর গেটের কাছে বাসের ধাক্কায় এক চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি ফের সামনে এসেছে। অভিযোগ, দুটি বাসের বেপরোয়া রেষারেষির বলি হয়ে বাচ্চাটিকে প্রাণ দিতে হয়েছে। দুই বাসের চালককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিস। এমন নয় যে, শুধুমাত্র রেষারেষির কারণে পথ দুর্ঘটনা ঘটে। বরং অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, পথচারীদের অবিবেচনা, উদাসীনতা, অকারণ ঝুঁকি নেওয়ার মাশুল দিতে হয়েছে কোনও তরতাজা প্রাণকে। কিন্তু দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ যে যাত্রী তোলার জন্য বেসরকারি বাসের মধ্যে রেষারেষি— তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বেশি যাত্রী মানে বেশি কমিশন। সেই বাড়তি কমিশনের লোভে জনবহুল রাস্তায় বেপরোয়া গতির প্রতিযোগিতায় নামে বহু বেসরকারি বাস। প্রতিযোগিতায় জিততে বিপজ্জনক ওভারটেক, সিগনাল অমান্য সহ পথ আইন ভাঙার প্রবণতা দেখা যায় আকছার। আর এই রেষারেষির প্রতিযোগিতায় প্রায় নিত্য প্রাণ যায় আট থেকে আশির, সাম্প্রতিক যার শিকার কলকাতার ওই পড়ুয়া বাচ্চাটি। ফলে স্বাভাবিক কারণে ওই ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এরপর এই প্রাণঘাতী কমিশন প্রথা তুলে দেওয়ার যে প্রত্যয় শোনা গিয়েছে সরকারের দুই মন্ত্রীর কথাতে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনও নাগরিক তাকে স্বাগত জানাবে। মন্ত্রীরা আরও জানিয়েছেন, বাসের ধাক্কায় মৃত্যু হলে এরপর চালকের বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের মামলা রুজু করা হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতিটি বাসে জিপিএস সিস্টেম চালুর ভাবনা আছে। এই প্রতিটি পদক্ষেপের ঘোষণাই আশার আলো দেখায়। এমন উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে তাকে স্বাগত।
অবাক করা বিষয় হল, এই কমিশন ব্যবস্থা বর্তমানে শুধু কলকাতা ও সংলগ্ন দু’তিনটি শহরতলিতেই চালু রয়েছে। দেশের অন্যান্য রাজ্যের তো বটেই, এ রাজ্যের অধিকাংশ জেলাতেও কমিশন প্রথা উঠে গিয়ে ড্রাইভার কনডাক্টরদের বেতন ব্যবস্থা চালু আছে। রেষারেষির এই পুরনো রোগ উপশমে কমিশনের পরিবর্তে বেতন চালু করতে বাম আমলে কয়েকবার চেষ্টা হয়েছিল। এই আমলেও ২০১৮ সালে বেতন চালু করতে অনড় মনোভাব দেখিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু তা কার্যকর করা যায়নি। বাস মালিকদের বিভিন্ন সংগঠনের যুক্তি, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরগুলিতে বাসের সংখ্যা জেলার তুলনায় অনেক বেশি। রুট-পরিকল্পনার অভাবে একই রুটে একাধিক বাস চলে, শহরে বাস কর্মীর সংখ্যা কম। একই বাস একাধিক ব্যক্তি চালানোয় বেতন ব্যবস্থা কার্যকর করা দুরূহ। তাছাড়া কমিশন প্রথায় একজন চালক ও কনডাক্টর মাসে যে টাকা রোজগার করেন, বেতন চালু হলে অনেক বাস মালিক তা দিতে রাজি হবেন না। কারণ, বেশি কমিশনের আশায় বেশি যাত্রী তুলতে যে তৎপরতা দেখান কিছু ড্রাইভার কনডাক্টর, মাস-মাইনে চালু হলে সেই গরজ তাঁরা নাও দেখাতে পারেন। বাস মালিকদের কিছু দাবি অবশ্যই সরকারের বিবেচনায় থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এর কোনওটাই কমিশন প্রথা টিকিয়ে রাখার পক্ষে যুক্তি হতে পারে না। যে কোনও মূল্যে বাসের বেপরোয়া রেষারেষি বন্ধ করতেই হবে।
পথ দুর্ঘটনার জন্য শুধুমাত্র বেসরকারি বাসের চালকরা দায়ী, এই ধারণা পোষণ করলে তা খুবই সরলীকরণ হয়ে যাবে। বিশেষত কলকাতা শহরের রাস্তার পরিসর বেশ কম। উপরন্তু শহরের অনেক ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় পথচারীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হন। কিন্তু এসব কারণের ঊর্ধ্বে হল পথচলতি মানুষের সচেতনতার অভাব। পথ আইন ভাঙা, সিগনাল না মানা, দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মোবাইল কানে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া— এও সব রাজপথের নিত্যদিনের ছবি। অথচ এই নাগরিকরাই ‘জরিমানা’-র ভয়েই হোক বা অন্য কোনও কারণে পাতাল রেলে প্রবেশ করলেই অন্যরকম সচেতনতা দেখান! তাই পথ দুর্ঘটনা এড়াতে পরিবহণ চালকদের সঙ্গে পথচারীদেরও সমানভাবে সচেতনতার পাঠ নেওয়া জরুরি। শোনা যাচ্ছে, সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফের পাঠ স্কুলের পাঠ্যক্রমে চালু করার কথা ভাবছে রাজ্য। নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক ভাবনা। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ কর্মসূচির কারণে পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। তাই এই কর্মসূচিকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। কিন্তু ড্রাইভার কনডাক্টরদের ক্ষেত্রে কমিশনের বদলে বেতন ব্যবস্থা চালু করার বিষয়টিতে এবারেও কোনও অজানা কারণে সরকার পিছিয়ে যাবে না তো? আবারও কাউকে রেষারেষির বলি হতে হবে না তো? ব্যবস্থা দরকার, যাতে আর কেউ দু’টি বাসের প্রতিযোগিতার বলি না হয়।