মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
বর্তমানে বিজ্ঞান বিভাগে যে যে বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ আছে ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স তার মধ্যে একটি ‘লুকানো রত্ন’। আমাদের অনেকের জ্ঞানের সীমা-পরিসীমার বাইরে এই বিষয়ের অনেক অধ্যায়ই থেকে গিয়েছে। ইলেক্ট্রনিক্স বিষয়টি তখন সারা বিশ্বে একটি নতুন সম্ভাবনার সন্ধান দিচ্ছে ফলিত বিজ্ঞানের অংশ হিসাবে। যোগাযোগ, অটোমেশন, বিনোদন বিভিন্ন দিকে এর ব্যবহার ও ব্যাপ্তি বাড়ছে। সামান্য কিছু উন্নত ও প্রযুক্তি নির্ভর দেশ বুঝতে পারছে এর বিপুল বাজারকে।
গত শতাব্দীর আটের দশকে তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক এ দেশকে কেবল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী রাষ্ট্রের থেকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যেতেই এই বিষয়ে গবেষণার উপর জোর দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতি, ১৯৮৪ সালে সরকারের উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) দেশের মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স বিষয়টি স্নাতকোত্তর বিষয় হিসাবে পড়ানোর সুযোগ দেয়। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল— দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় ও পুনে বিশ্ববিদ্যালয়। মনে রাখতে হবে বিষয়টি কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে চালু করা হয়, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিষয় হিসাবে নয়। কারণ, তার আগে থেকেই এ দেশে বহু সংস্থাতেই ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো শুরু হয়ে গিয়েছিল।
এবার প্রশ্ন আসতে বাধ্য, পার্থক্য কী আছে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স-এর মধ্যে? কেনই বা আলাদা করে চালু করা হয়েছিল এই বিষয়টিকে? ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিষয়টির ব্যবহারিক দিক আলোচিত হতো। যে তত্ত্ব ছিল তার উপযোগিতা বিচার করে সফলভাবে ব্যবহার করা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লক্ষ্য। কিন্তু ইলেক্ট্রনিক্সের পিছনে লুকিয়ে থাকা বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোকে তুলে আনা, নতুন নতুন তথ্য সৃষ্টি করে তার ভিত্তিতে বিষয়টাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং স্বদেশি পেটেন্ট করে দেশকে বাণিজ্যিকভাবেও এগিয়ে দেওয়ার পথ তৈরি করাই ছিল এই বিষয়ের লক্ষ্য। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক হেনরি পেট্রোসিক এক রচনাতে বলেন, ‘Engineering is not Science.’ কোনও বিষয়কে ছোট বা বড় করতে নয়, বাস্তবতার ধারণা দিতে তিনি এই কথা বলেছিলেন। যাই হোক, ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স কেন ইঞ্জিনিয়ারিং নয় এবং এর মূল উদ্দেশ্য যে কী সেটা মনে হয় পাঠকের কাছে কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে।
১৯৮৪ সালে স্নাতকোত্তরে সামান্য কয়েকটি আসনে ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স পড়ানো শুরু হয়। একটু খেয়াল করবেন— বিষয় ভিত্তিক নামটা কিন্তু ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স থেকে ইলেক্ট্রনিক্স-এ বদলে গেল। যাঁরা বিএসসি ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে পাশ করলেন তাঁরা কিন্তু চাকরিরও বেশি সুযোগ পেলেন। ফলে রাজ্য সরকার ১৯৯৬-এ বিএসসি অনার্সেও বিষয়টি সংযুক্তি করল। নতুন বিষয় পাশাপাশি প্রচারের অভাব কিন্তু ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাকে প্রভাবিত করতে পারল না। প্রচুর ভালো পড়ুয়ারা বিষয়টি পড়তে চলে আসেন।
২০০০-’০১ সালের আগে পর্যন্ত গোটা দেশে তথা আমাদের রাজ্যে যথেষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিল না। এর ফলে বহু ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক ছাত্রছাত্রী চাকরি পেতেন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। এমএসসি পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা তো উচ্চপদেই আসীন হতেন। কিন্তু যখন সারা বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা দেখা দিল, তখন পুরো ব্যাপারটায় ছন্দপতন হল। চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ইঞ্জিনিয়ারদের জোগান এসে গেল।
ইলেক্ট্রনিক্স বিএসসির মূল উদ্দেশ্য কিন্তু কখনওই চাপা পড়ে যায়নি। এবার একটু আলোচনা করা যাক কী কী সুযোগ আছে এই বিষয়ের স্নাতকদের জন্য—
বিএসসি পাশ করে ইলেক্ট্রনিক সায়েন্সে এমএসসি করে বিভিন্ন পথ খুলে যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে এমসিএ এবং আরও কিছু ফলিত বিষয়ে স্নাতকোত্তরের সুযোগ রয়েছে।
অন্য যে কোনও বিষয়ের মতো স্নাতকস্তরের সমস্ত সরকারি, আধা সরকারি, ব্যাঙ্ক ইত্যাদির পরীক্ষা দেওয়া যায়। বহু ছাত্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত।
এই বিষয়ের ছাত্রদের দেশে-বিদেশে এমএসসি এবং ইন্টিগ্রেটেড পিএইচডি-র সুযোগ অন্যদের তুলনায় বেশি।
ম্যানেজমেন্টের কোর্স করে কিংবা এমবিএ-ও করা যায়।
বড় বড় শিল্পে সিস্টেম অ্যানালিস্ট বা সহযোগী হিসেবে কাজের সুযোগ রয়েছে।
প্রতিবছর বহুজাতিক কোম্পানিগুলিও ক্যাম্পাস ইন্টারভিউের মাধ্যমে পড়ুয়াদের কাজে বহাল করে।
কয়েকবছর ধরে বিএসএনএলের টিটিএ পদে এবং রেলের বিভিন্ন টেকনিক্যাল পদে বিএসসি ইলেক্ট্রনিক্সদের নেওয়া হচ্ছে।
এবার এমএসসি ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স পড়ে কী কী সুযোগ আছে দেখা যাক—
নেট বা সেট/ স্লেট পরীক্ষা দিয়ে ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণার সুযোগ কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পাওয়া যায়।
গেট পরীক্ষা দিয়ে দেশের সেরা আইআইটি, এনআইটি কিংবা বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে এমটেক / এমই পড়ার সুযোগ থাকে যেমন, তেমনই গেট স্কোরের ভিত্তিতে বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে গবেষণার সুযোগ থাকে।
ডিআরডিও, ইসরো সহ বিভিন্ন কেন্দ্রে বৈজ্ঞানিক পদে কাজের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে চন্দ্রযান উৎক্ষেপণের পর যে বাঙালির নাম মিডিয়ার সামনে উঠে এসেছিল, তিনি এই বৈদ্যুতিন বিজ্ঞান অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক সায়েন্সেরই প্রাক্তনী।
বিএসএনএলের জিটিও, রেলের উচ্চপদ, কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ ক্যাবিনেট সচিব পদে এই বিষয়ের এমএসসিদেরই নির্দিষ্ট করে চাকরির সুযোগ থাকে।
সরকারি-বেসরকারি ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি কলেজে পড়ানোর ছাড়পত্রও আছে এই বিষয়ের স্নাতকোত্তর পড়ুয়াদের। স্কুল সার্ভিসেও বর্তমানে এই বিষয়ের এমএসসিরা পদার্থবিজ্ঞানের সহ-শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন।
মেডিক্যাল টেকনোলজি ও ইনস্ট্রুমেন্টেশন এই বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
দেশে-বিদেশে বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানিতে আর অ্যান্ড ডি-র কাজে এই বিষয়ের পড়ুয়াদের সাফল্য অন্য যে কোনও বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ঈর্ষনীয়।
বিষয়টি কোথায় পড়ার সুযোগ আছে তা জানা প্রয়োজন—
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী সময় বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ও বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন কলেজে স্নাতকস্তরে ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স পড়ানো হয়। এছাড়া স্বনির্ভর মেদিনীপুর কলেজেও বিষয়টি পড়ানো হয়।
স্নাতকোত্তরস্তরে পড়ার জন্য কলকাতা, বারাসাতের পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যাদবপুর ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।
রাজ্যের বাইরেও প্রায় সমস্ত রাজ্যে এই বিষয়টি বিএসসি কিংবা এমএসসি স্তরে পড়ানো হয়।
(লেখক: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর)