ঘরে বা পথেঘাটে পড়ে গিয়ে শরীরে বড় আঘাত পেতে পারেন। আমদানি রপ্তানির ব্যবসা ভালো হবে। ... বিশদ
পয়লা বৈশাখই এখন শুধু বাংলায় আসে, বাংলা তারিখ মেনে পালিত হয়। শুনে হয়তো কেউ হা-হা করে উঠবে। বলবে, কেন পঁচিশে বৈশাখ? হ্যাঁ, কবির জন্মদিনও বাংলা তারিখ মেনে পালিত হয়। অবশ্যই তা সীমিত পরিসরে, কবি-অনুরাগীমহলে। পয়লা বৈশাখ সমাজের সর্বস্তরে, পালিত হয় সাড়ম্বরে । বাংলা ক্যালেন্ডারের ব্যবহার এখন কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। ঠাম্মা শুধু একাদশী-পূর্ণিমা খুঁজতে বাংলা ক্যালেন্ডার খোঁজেন। বাংলা ভাষার ছিরিছাঁদও কেমন বদলে গিয়েছে। অকারণে চলে ইংরেজি শব্দের আনাগোনা। বদলেছে পোশাক-আশাকও।
গল্প নয়, ষোলোআনা সত্যি। পাশের বাড়ির মৌটুসিকে সেদিন উপেন্দ্রকিশোরের ‘টুনটুনির বই’-এর কথা বলছিলাম। অবন ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’-র কথা বলছিলাম। দক্ষিণারঞ্জনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কথা সবে বলতে শুরু করেছি, সে আমায় থামিয়ে দিয়ে বললে, ‘জানো না বোধহয়, আমি বাংলা পড়তে পারি না!’
আজ আমরা বাংলা নববর্ষ হই-হই করে পালন করব। ‘পয়লা বৈশাখ’ না বলে ‘১লা বৈশাখ’ বললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আগামী কাল থেকে দাবদাহময় বৈশাখ একলাই পড়ে থাকবে। ভুলেও আমরা ‘বৈশাখ’ বলব না, বলব ‘এপ্রিল’। ইংরেজি মাস-তারিখেই চলবে দৈনন্দিন কাজকারবার।
বাংলা ভাষা অনাদরে অবহেলায় এভাবে থাকতে চায় না। সব্বাইকে, বিশেষত ছোটদের ডাকছে। তারা কাছে আসুক। আরও ভালোবাসুক। আমাদের প্রতিমুহূর্তে পথ দেখায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরবাড়ির সকলেই বাংলা ভাষাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। বাংলা নববর্ষের দিনে ভাষার প্রতি তাঁদের ভালোবাসা কত গভীর ছিল, সে গল্পই
না হয় শোনাই।
পিতা হিসেবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন অসাধারণ। ছেলেমেয়েদের বাড়তি সচ্ছলতার মধ্যে বড় করেননি। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে অসীম সম্ভাবনা, তা তিনিই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন। স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে পুত্রকে চেনাতেন রাতের আকাশ। পিতা হিসেবে তিনি ছিলেন দায়িত্ববান, স্নেহ- ভালোবাসাময়। বাংলা ভাষার প্রতিও তাঁর ছিল গভীর ভালোবাসা। বানানো সাহেবিয়ানারও ছিলেন ঘোরতর বিরোধী। প্রপৌত্র সৌম্যেন্দ্রনাথের নামকরণ মহর্ষিই করেছিলেন। ‘যাত্রী’ নামে আত্মকথা লিখেছেন সৌম্যেন্দ্রনাথ। সে বইতে আছে একটি ঘটনার কথা, যা জানার পর, পড়ার পর আমরা নিশ্চিত প্রাণিত হব। দেবেন্দ্রনাথকে এক আত্মীয় চিঠি লিখেছিলেন ইংরেজিতে। চিঠিটি ইংরেজিতে লেখা বুঝতে পারার পরই মহর্ষি পত্রবাহককে দিয়ে তা ফেরত পাঠিয়েছিলেন। পত্রগ্রহণ করেননি।
কেন মহর্ষি চিঠি ফেরত পাঠালেন, যিনি লিখেছিলেন সে চিঠি, ফেরত পেয়েও তা প্রথমে বুঝতে পারেননি। বুঝতে পেরেছিলেন একটু তলিয়ে ভাবার পর। বুঝতে পেরে খুব লজ্জা পেয়েছিলেন। কেন অকারণে ইংরেজিতে লিখতে গেলেন ভেবে খুব অনুশোচনা হয়েছিল।
সাহেবি-পোশাক পরে সৌম্যেন্দ্রনাথ বেজায় রকম বকা খেয়েছিলেন পিতা সুধীন্দ্রনাথের কাছে। সাহেব-দোকান থেকে সাহেবি-পোশাক কিনে দিয়েছিলে এক নিকটাত্মীয়। নতুন পোশাক পেয়ে আহ্লাদে আটখানা, পরার পর সৌম্যেন্দ্রনাথকে সাহেব-বালকই লাগছিল। সে পোশাক পরে পিতার কাছে দাঁড়াতেই গলার টাই এক ঝটকায় খুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘কখনও এসব পরবে না।’ সৌম্যেন্দ্রনাথও বুঝতে পেরেছিলেন, অন্যায় করে ফেলেছেন। আত্মকথায় লিখেছেন, ‘সেই আমার জীবনে প্রথম ও শেষ সাহেব সাজা।’
ঠাকুরবাড়িতে গল্পের শেষ নেই। ঠাকুরবাড়ির বাঙালিয়ানা, বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা, একের পর এক বলে গেলে ‘গল্প’ বলেই এখন মনে হবে। বাংলা নববর্ষের দিনে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার এইসব গল্প বাঙালিকে নতুন করে ভাবাবে, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে শেখাবে।
অনেক ‘স্টাডি’, ‘লেকচার’-এর জন্য বিস্তর পরিশ্রম। হাসিমুখে এসব করলেন অবনীন্দ্রনাথ। উচ্চপদস্থ ইংরেজরা, আমলারা তো আর বাংলা বুঝবেন না, আশুতোষ বললেন, ‘বলতে হবে ইংরেজিতে।’
বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে কেন! শ্রোতার আসনে পড়ুয়ারাই থাকবে বেশি । তারা তো সবাই বাঙালি। অবনীন্দ্রনাথ জানিয়ে দিলেন, ইংরেজিতে নয়, তিনি বাংলাতেই বলবেন। সাহেবরা এলে বাংলাই শুনতে হবে। আশুতোষ আবারও জানিয়েছিলেন, লাট সাহেবের ইচ্ছে অন্তত প্রথম বক্তৃতাটা ইংরেজিতে হোক। না, অবনীন্দ্রনাথ রাজি হননি।
অবনীন্দ্রনাথের প্রথম দিনের বক্তৃতা শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলেন উপাচার্য। চেয়ারের হাতল চাপড়ে বলেছিলেন, ‘তুমি বাংলাতেই বলবে।...এমনটিই চেয়েছি।’
বাংলা নববর্ষের দিনে বাংলা ভাষার প্রতি এই ভালোবাসার কথা জেনে আমাদেরও বাংলা ভাষাকে আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে। আরও আরও ভালোবাসব।