অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
আজ তোমাদের শোনাব এমন একজনের জীবনের কথা, যিনি ছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের সশস্ত্র বিপ্লবের এক অন্যতম কারিগর ও কাণ্ডারী। তাঁর নাম বারীন্দ্রকুমার ঘোষ।
১৮৮০ সালের ৫ জানুয়ারি। বিলেতগামী একটি জাহাজ তখন ভেসে চলেছে মাঝ সমুদ্রের ওপর দিয়ে। সেই উত্তাল সমুদ্রবক্ষেই জন্ম নিলেন বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ভারতবর্ষের সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাস যাঁকে ছাড়া হয়তো অসম্পূর্ণই রয়ে যেত!
উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সাংস্কৃতিক ‘নবজাগরণ’ ঘটেছিল। বাংলা তখন সারা ভারতের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিল। প্রাচ্য সভ্যতার আদর্শ ও পাশ্চাত্য সভ্যতার বাস্তবতার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সেই ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর অন্যতম উত্তরসাধক ছিলেন ডঃ কৃষ্ণধন ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষের বাবা। মা স্বর্ণলতাদেবী ছিলেন মনীষী রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। দাদা ছিলেন ঋষি অরবিন্দ। সুতরাং উত্তরাধিকারসূত্রেই বারীন্দ্রকুমার পেয়েছিলেন স্বদেশ প্রেমকে।
শৈশবে এক বছর বয়স অবধি লন্ডনের ক্রয়ডনে থাকার পর মা এবং দিদির সঙ্গে তিনি ফিরে এলেন ভারতবর্ষে। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি যদিও ছিল কোন্নগরে, কিন্তু তাঁরা থাকতেন দেওঘরে। দেওঘর বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন বারীন্দ্রকুমার।
তখন জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে আবির্ভাব ঘটেছে রাষ্ট্রগুরু স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যােয়র। শহর কলকাতা থেকে অনেক দূরের সেই দেওঘরেও এই জাতীয়তাবাদের ঢেউ এসে লেগেছিল। কিশোর বারীন্দ্রকুমারের মধ্যে বোধহয় ঘুমন্ত ছিলেন ভবিষ্যতের এক মহান বিপ্লবী! তিনি বিশিষ্ট কয়েকজন শিক্ষকদের সংস্পর্শে এলেন, যাঁরা নিজেরাই ছিলেন জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ। তাঁরাই যেন জাগিয়ে তুললেন কিশোর বারীন্দ্রকুমারের ভেতরের সেই বৈপ্লবিক সত্ত্বাকে!
বারীন্দ্রকুমার তাঁর শিক্ষকদের কাছে পরাধীন ভারতবর্ষের শোচনীয় অবস্থার কথা জানার পর থেকেই সবসময় অন্যমনস্ক থাকতেন। তাঁর বন্ধুরা যখন হুল্লোড় করত, তখন তিনি চুপচাপ আকাশের দিকে চেয়ে গভীর চিন্তা করতেন, হয়তো তখনই মনস্থির করে ফেলেছিলেন দেশের জন্য স্বার্থত্যাগ করবার!
প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে পাটনা কলেজে এফ এ পড়ার পর, ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। কলেজের কাছেই খুললেন একটি চায়ের দোকান। দাদা অরবিন্দ ঘোষ (ঋষি অরবিন্দ) তখন বরোদায়। সেখানে চলে গেলেন বারীন্দ্রকুমার ব্যবসার মূলধনের আশায়। কিন্তু অরবিন্দের অনুপ্রেরণায় দীক্ষিত হলেন বিপ্লবীমন্ত্রে! মনের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে যুক্ত হলেন পূর্ণ ভাবে স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে।
১৯০২ সালে ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে একটি গুপ্ত সমিতি স্থাপিত হল, যার সভাপতি ছিলেন পি মিত্র। তিনি ছিলেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবশিষ্য। বঙ্কিমের অনুশীলনবাদকে অনুসরণ করে তিনি গুপ্ত সমিতির নাম রাখলেন ‘অনুশীলন সমিতি’। অরবিন্দের ইচ্ছায় সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেন বারীন্দ্রকুমার।
মানিকতলার মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে ‘যুগান্তর’ দলের গোপন কেন্দ্র স্থাপিত হল। বারীন্দ্র এসে এই কেন্দ্রের সাংগঠনিক প্রধান হলেন। অবিনাশ ভট্টাচার্য, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করে তুললেন।
বারীন্দ্রকুমারের দায়িত্ব ছিল সংগঠনের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, গুপ্ত সমিতিতে শিক্ষার্থীদের লাঠিখেলা, তলোয়ার চালনা, সাইকেল চালনা, ঘোড়ায় চড়া, বক্সিং, বন্দুক ছোড়া শেখার প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখা, ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরের মধ্য দিয়ে অস্ত্র আমদানি করার চেষ্টা করা। এমনকী ওড়িশা ও অসমে ভ্রমণ করে সংগঠন গড়ার জন্য ঘাঁটি তৈরি করার ব্যবস্থা করতেও তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।
সেই সময় পূর্ববঙ্গের ছোটলাট ছিলেন অত্যাচারী ব্যামফিল্ড ফুলার। তাঁর আদেশে স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা নির্যাতিত হতেন। বারীন্দ্র তীক্ষ্ম নজর রাখলেন ফুলারের ওপর। তারপর নির্বাচন করে পাঠালেন তরুণ বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকিকে ফুলারকে হত্যা করতে। কিন্তু ব্যর্থ হলেন প্রফুল্ল!
মজঃফরপুরের ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য নির্বাচন করলেন আবার সেই প্রফুল্ল চাকিকেই। এবার সঙ্গে রইলেন ক্ষুদিরাম বসুও। তাঁরা যদিও সফল হলেন না, কিন্তু ক্ষুদিরাম শহিদ হয়ে তোলপাড় করে দিলেন ভারতবর্ষকে!
পুলিস মামলা করল। মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি তল্লাশি করে বোমার কারখানা আবিষ্কার করল। বারীন্দ্রকুমারের নেতৃত্বেই যে এই বোমা কারখানা তা জানতে পেরে গ্রেফতার করল সবাইকে!
বিচারে বারীন্দ্রকুমার ও উল্লাসকর দত্ত’র ফাঁসির হুকুম হল। কিন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রবল প্রচেষ্টায় তাঁরা আন্দামানে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা পেলেন।
১৯০৯ থেকে ১৯২০ সাল অবধি আন্দামানের সেলুলার জেলে অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করলেন, খাবার পেতেন শুধু ফ্যান!
মুক্তির পর পণ্ডিচেরীতে ঋষি অরবিন্দের আশ্রমে চলে এলেন। প্রকাশ করলেন ‘বিজলী’ পত্রিকা। পরে ‘দ্য ডন অফ ইন্ডিয়া’ ও ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদনাও করলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রামানন্দ লেকচারার’ হলেন। বই লিখলেন ‘আমার আত্মকথা’, ‘দ্বীপান্তরের বাঁশি’, ‘শ্রীঅরবিন্দ’, ‘দ্য টেল অফ মাই এক্সাইল’ ইত্যাদি।
বারীন্দ্রকুমার চেয়েছিলেন দেশবাসীকে বিপ্লব প্রচেষ্টার কথা জানাতে, তাই স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘মাই মিশন ইজ ওভার’।
১৯৫৯ সালের ১৮ এপ্রিল তাঁর প্রয়াণ ঘটে।